খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

ভারত বর্ষের প্রথম মুসলমান

মুফতি আনিস বিন ওমর

সূর্য যখন উদিত হয়, অন্ধকার দূর করে তার আলো ছড়িয়ে পড়ে দূর-দুরন্তে, দিক-দিগন্তে। যে আলোর প্রত্যাশায় থাকে তাকেও আলোকিত করে, আবার সূর্যের সাথে শত্রুতা পোষণ করে যে চামচিকা তাকেও আলো থেকে বঞ্চিত করে না।

জাহেলী অন্ধকার যুগে সত্য আর মানবতার মুক্তির বার্তা নিয়ে উদিত হওয়া ইসলামের সূর্য তার আলোক রশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছিল পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।

বাগানে ফুল ফুটলে যেমন মধু অন্বেষী মৌমাছি খবর পেয়ে যায়। তদ্রুপ সত্য বিকশিত হলে তার নির্মল হাওয়ায় উদ্বেলিত সত্যান্বেষী হৃদয় গুলো আলোড়িত হয়। আজ আমরা তেমনই এক সত্যানুরাগী হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তির গল্প শুনবো।

মালাবার। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের দীর্ঘ, সরু এক উপকূলীয় সমভূমি এলাকার নাম মালাবার। বর্তমানে এটি ভারতের ‘কেরল’ ও ‘কর্ণাটক’ অঙ্গরাজ্যে বিস্তৃত। এই এলাকায় বসবাস করতো হিন্দু ধর্মাবালম্বী ‘মাপ্পিলা’ সম্প্রদায়। ‘চেরা’ বা ‘চেরামন’ হল এই এলাকার রাজবংশের শাসকদের উপাধি। এই রাজবংশের শেষ শাসক ছিলেন ‘চেরামন পেরুমল’।

নবী মুহাম্মাদ স. এর আগমনের পূর্ব থেকেই আরব বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ উন্নত ছিল। তাদের বাণিজ্য বহর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতো। আরবদের বাণিজ্যিক রুটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল মালাবার। মালাবার-আরবীয়দের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মজবুত। ‘মাপ্পিলা’ হিন্দু সম্প্রদায় হলেও আরব বণিকদের সাথে তারা খুব ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতো।

ইসলামের সূর্য যখন তার পূর্ণ জ্যোতি নিয়ে উদিত হলো। তার স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি ঠিকরে পড়েছিলো মালাবারের মাপ্পিলা সম্প্রদায়ের উপর। সত্যানুরাগী হৃদয়গুলো হয়েছিল আকর্ষিত। তাওহিদের অমিয় সুধা পান করতে হয়েছিল তৃষ্ণার্ত। নববী দরদের স্নিগ্ধ পরশে ধন্য হতে উদ্যেলিত হয়েছিল অনেক জড়ভক্ত হৃদয়।

চেরামন পেরুমল ছিলেন মাপ্পিলা সম্প্রদায়ের শেষ রাজা। এদিকে সর্বত্র গুঞ্জরিত হচ্ছেন তুন ধর্ম-মতাদর্শ, নতুন নবীর প্রশংসা আর সফলতার কথা। আরব বণিকদের সুবাদে সে সংবাদ অনেক আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল মালাবারে ঘরে ঘরে। এরই মাঝে একদিন প্রকাশ পেল রসুল স. এর মুজিজা- চন্দ্র দিখন্ডিত হওয়ার ঘটনা। মক্কার মুশরিকরা ঈমান না আনলেও এ ঘটনাকে আল্লাহ তা’আলা মালাবারের চিত্র বদলের মাধ্যম বানিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিকদের মতে-চেরামন পেরুমল এক পূর্ণিমা রাতে দেখেন-চন্দ্র দিখন্ডিত হচ্ছে।তিনি স্বচক্ষে দর্শন করেন এবং নিজের রোজনামচায় লিখে রাখেন। (তারিখে ফিরিশতা, বাংলা হাদিস) অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায় তিনি স্বপ্নে দেখেন ‘আকাশের চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়েছে’। ব্যাখ্যা জানতে চাইলে কেউ এর সদুত্তর দিতে পারে না। রাজার মন অস্থির রয়ে যায়। কিছুদিন পর আরব বনিকদের কাছে মুহাম্মাদ স. কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার ঘটনা শুনে বুঝতে পারেন ঐ স্বপ্নে তিনি এই ঘটনার ইঙ্গিত পেয়েছেন। তিনি নবী মুহাম্মাদকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। (roar media)।

রাজ্য ছেড়ে তিনি বণিকদের সাথে আরবে হিজরত করেন। কোন বর্ণনায় আছে তিনি তার রাজ্য ভাগ করে দিয়ে যান।শান্তির বার্তা বাহক মুহাম্মাদে আরাবির দরবার মক্কায় উপস্থিত হন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা.সহ আরো অনেক বড় বড় সাহাবির উপস্থিতিতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ধন্য হন এবং প্রাথমিক পর্যায়ের সাহাবিদের অন্যতম সৌভাগ্যশালী সদস্য হন।

ইসলামের জন্য রাজ্য উৎসর্গ ও ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ তা’আলা তাকে মহা সৌভাগ্য দান করেছেন। রসুল স. কে তিনি দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ‘আদার আচার’ হাদিয়া দেন। ইসলাম গ্রহণ ও আদার আচার পৃথিবীর মানুষের কাছে আজও তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন (আমরা রসুলের দরবারে ছিলাম) হিন্দুস্তানের এক রাজা রসুল স. এর কাছে এক বয়াম [প্রশস্ত মুখ বিশিষ্ট বোতল] আচার নিয়ে আসলো। তার মধ্যে আদা ছিল। রসুল সা. সাহাবিদের টুকরা টুকরা ভাগ করে দিলেন। আমাকেও এক টুকরা দিয়েছিলেন। মুসতাদরাকেহাকেম -৭১৯০।

নবীয়ে রহমত তাঁর নতুন নাম রাখেন ‘তাজুদ্দিন’। রসুলের দরবারে তিনি ১৭ দিন অবস্থান করেন। কথিত আছে তিনি ভারতগামী বণিকদের হাতে মাপ্পিলা সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দেন, যেখানে তিনি মুসলমানদের সাথে ভাল ব্যবহার করা ও মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদানের উপদেশ দিয়েছিলেন।

১৭ দিন অবস্থান করার পরবর্তী ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে ইতিহাসের বর্ণনা ধারায় মনে হয় তিনি দীর্ঘদিন আরবে অবস্থান করেন। ইরাকের কুফার বিখ্যাত তা’বেঈ মালেক ইবনে দিনারের’ বোনকে বিবাহ করেন। দীর্ঘ দিন পর মালেক ইবনে দিনারকে সাথে নিয়ে নিজের জন্মভূমি মালাবারের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পতিমধ্যে ওমানের ঝিফর (সালালাহ) পৌঁছে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। এক বর্ণনা মতে ওমানের ‘সালালায়’ তাজুদ্দিন রা. এর কবর আছে।

মৃত্যুর পূর্বে তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী চেরামন রাজার জন্মভূমি মালবার (বর্তমান কেরলার) মেথেলায় নির্মাণ করেন ভারতের প্রথম মসজিদ। যা আজও ‘চেরামন জুম্মা মসজিদ’ নামে বিদ্যমান আছে।

চেরামন পেরুমল থেকে হয়ে গেলেন সাহাবী তাজুদ্দিন। ঐতিহাসিকভাবে ইনিই ভারত বর্ষের প্রথম ধর্মান্তির মুসলমান। রাজি আল্লাহু আনহু॥

মসজিদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা হলো-প্রশিদ্ধ মতে ‘চেরামন জুমা মসজিদ’ ৬২৯ খৃষ্টাব্দে নির্মিত। যদি এ মত সঠিক হয় তাহলে এটি ‘মালেক বিন দিনার’ নির্মাণ করেননি। অন্য কোন আরব বণিক বা বণিকদের দাওয়াতে ইসলামী দীক্ষায় ধন্য হওয়া কোন সৌভাগ্যবান নির্মাণ করেছেন। কেননা ততদিনে মালাবারের অনেক মানুষ মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।

আর যদি মালেক বিন দিনার মসজিদটি নির্মাণ করে থাকেন তাহলে ৬২৯ খৃষ্টাব্দের বর্ণনা সঠিক নয়। তবে তিনি ভারতবর্ষে অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন এ কথা সত্য ও প্রমাণিত।

মসজিদের ভেতরে অবস্থিত একটি ফলকে মসজিদটির প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে ৬২৯ হিজরী লেখা আছে। যদিও ফলকটি সম্ভবত পরবর্তী কোন সময় স্থাপন করা। তবে মসজিদ ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ সাইদ বলেন ‘এটাই ভারতে নির্মিত প্রথম মসজিদ’। (roar media)

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!