যশোরের কান্না ভবদহ পাড়ের মানুষের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ দেখা গেছে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ পানির নিচে বসবাস করছে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। জানা যায়, এই অঞ্চলের প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন। স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশংকায় এখন দিন কাটছে তাদের।
গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের তিন-চার দিনের টানা বৃষ্টির পানিতে তলিয়েছে এ অঞ্চলের অন্তত ৫৫টি গ্রাম।এরপর সেপ্টেম্বরের বৃষ্টিতে এই গ্রামের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। এসব গ্রামে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা হয়েছে বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, ধর্মীয় উপাসনালয়। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার মাছের ঘের। এখনো বিলগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে পানি। আর এতে আরও কয়েকমাস জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা। নিরাপদ চলাফেরার পাশাপাশি গোখাদ্য, সুপেয় পানির অভাব আর নাজুক স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে অনেকেই এলাকা ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। বিভিন্ন রাস্তাঘাটে ওই স্কুলে।
প্রভাষক সমীরন সরকার বলেন, তিন উপজেলার ২৭ বিলের পানি ভবদহের ২১, ৯ ও ৩ ভেন্টের স্লুইস গেট দিয়ে হরি নদীতে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু পলিতে স্লুইস গেটগুলো অচল হয়ে থাকায় পানি যাচ্ছে না। বর্তমানে আবার স্লুইস গেটগুলো বন্ধ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচ পাম্প বসিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ পানি নিষ্কাশনের খাল থেকে নদী উঁচু। সে কারণে জলাবদ্ধতার মাত্রা বাড়ছে।
সড়াডাঙা গ্রামের বিকাশ মন্ডল বলেন, নদী খনন না করলে এ পানি কমবে না। টিআরএম প্রকল্প ছিল একমাত্র পরিত্রাণের উপায়। কিন্তু পলি জমে এখন যে অবস্থা তাতে নদী খনন ছাড়া উপায় নেই।
কপালিয়ায় তিন ভেন্ট এলাকার বাসিন্দা তাজমিনুর রহমান বলেন, পানির চাপে সেচ কোনো কাজে দিচ্ছে না। নদীর তলা উঁচু থাকায় পানি উপচে বাড়িতে ঢুকছে। পানি বাড়তে থাকায় স্থানীয়রা রাস্তার ওপর ঘর বেধে গবাদি পশু নিয়ে রাখছেন। কপালিয়া থেকে মশিহাটী পর্যন্ত যেতে এ অবস্থা দেখা যায়।
রাস্তার ওপর তৈরি গোয়াল ঘরে গরুকে খাবার দিচ্ছিলেন মালঞ্চ রানী বললেন, এত কষ্টে বেঁচে থাকা দায়!
কুলটিয়া গ্রামের নিমাই রায় বললেন, ‘আমাদের দুরবস্থা চলছে। চারদিকে জল। কাজ করার উপায় নেই। একবেলা খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে।
ধোপাদী গ্রামের রাজু আহমেদ জানালেন, প্রায় এক মাস জলাবদ্ধতা আমাদের অঞ্চলে। এরপর চার দিন যে বৃষ্টি হয়েছে তাতে জলাবদ্ধতা আরও বেড়েছে।
ডুমুরতলা গ্রামের কার্তিক বলেন, বাড়িঘর ফেলে ঠাঁই নিয়েছেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনে।
মর্জিনা বেগম জানালেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে বাড়িঘরে পানি উঠছে। উঠোনে এখন বুক সমান পানি। ঘরের পানি কোমর ছুঁই ছুঁই। তাই নিরূপায় হয়ে সপ্তাহখানেক আগে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্কুলে। গরু রেখে এসেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। শুধু তার পরিবার নয়, বিদ্যালয় ভবনটির দোতলায় আশ্রয় নিয়েছে আরও ৪০টি পরিবার। তাদের চোখে মুখে তাদের হতাশার ছাপ। কবে নিজের ভিটে মাটিতে ফিরতে পারবেন তা অনিশ্চিত।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতা রনজিত বাওয়ালি বলেন, দীর্ঘ ৪৪ বছর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই জনপদের মানুষ স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। টিআরএম প্রকল্প বাদ দিয়ে ২০২২ সাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে সেচ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল তা-ই এখন ভোগান্তির কারণ। অথচ ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি ও ১৫ নভেম্বর ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার সেচ প্রকল্প ও প্রস্তাবিত প্রায় ৪৫ কোটি টাকার ‘ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ’ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে যশোরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছিল ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনগণ উদ্ভাবিত টিআরএম প্রকল্প গণআন্দোলনে গৃহীত হলেও বিগত সরকার ২০১২ সালে ‘সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলার’ অজুহাতে বাতিল করে দেয়। এখন এই জনপদের মণিরামপুর, কেশবপুর বা অভয়নগর শুধু নয়, জলাবদ্ধতা বিস্তৃত হয়েছে খুলনার ডুমুরিয়া ও যশোর শহর পর্যন্ত।
পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যানার্জী বলেন, হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার পুনর্খনন কাজ চলমান। জলাবদ্ধতা নিরসনে বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরানোর কাজ চলছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম ইতোমধ্যে ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন।
তিনি জানান, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কাজ করছে। জলাবদ্ধ এলাকার পানি নিষ্কাশনে পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।
খুলনা গেজেট/এএজে