দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ১২৫ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ ইউনিট চালু হয় ২০০৭ সালে। চীনা ঠিকাদারের তৈরি কয়লাচালিত কেন্দ্রটি শুরু থেকেই ভোগাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। চালুর পর থেকে কেন্দ্রটি পূর্ণ ক্ষমতায় চলেছে খুব কম সময়। যান্ত্রিক ত্রুটিতে প্রায়ই বন্ধ থাকছে কোনো না কোনো ইউনিট। ঠিক একই দিকে এগোচ্ছে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
ভারত-বাংলাদেশ যৌথ মালিকানার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে ২০২২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। এর ১০ মাস পর গত ১ নভেম্বর চালু হয় দ্বিতীয় ইউনিট। উৎপাদনে আসার পর ১২ মাসে যান্ত্রিক ত্রুটিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয় সাতবার। তাছাড়া পূর্ণ ক্ষমতায় চলে খুব কম সময়। এমন পরিস্থিতিতে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাচালিত এই কেন্দ্রের যন্ত্রপাতির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন উঠেছে প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘ফিশনার’কে দিয়ে যন্ত্রপাতির মান যাচাই নিয়েও।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি পিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির মধ্যে এ নিয়ে একটি চুক্তি হয়। গঠন হয় বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল)। প্রকল্পের ব্যয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশ ঋণ হিসেবে দিয়েছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। ঠিকাদার সে দেশের প্রতিষ্ঠান ‘ভেল’।
যান্ত্রিক ত্রুটিতে বন্ধ বারবার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর দফায় দফায় বন্ধ হয়েছে মূলত দুটি কারণে। একটি কারণ হলো– কয়লা সংকট, অপরটি যান্ত্রিক ত্রুটি। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়েছে সাতবার।
প্রথম যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় গত ১৫ এপ্রিল। চালুর পর এটিই উৎপাদন বন্ধের প্রথম ঘটনা। এর পর গত ৩০ জুন রাতে জেনারেটর ইউনিটের প্রোটেকশনে ত্রুটির কারণে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ত্রুটি সারিয়ে ১০ দিন পর অর্থাৎ গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় উৎপাদনে ফেরে কেন্দ্রটি। কিন্তু চার দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৩ জুলাই রাতে আবার কারিগরি সমস্যা দেখা দেয়, উৎপাদন বন্ধ থাকে ৯ ঘণ্টা। এর পর ১৬ জুলাই দুপুরে গ্ল্যান্ডফিলে লিকেজের কারণে আবার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ সেপ্টেম্বর ত্রুটি দেখা দেয় ছাই নির্গমন প্রক্রিয়ায়। ৫ নভেম্বর কারিগরি ত্রুটির কারণে এটি বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ গতকাল সোমবার সকালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লারের কারিগরি সমস্যার কারণে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া তিনবার কয়লা সংকটে উৎপাদন বন্ধ থাকে।
পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদনে জটিলতা
বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার পর সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে রামপালের দুই ইউনিট। প্রতিটি ইউনিটের সর্বোচ্চ সক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট হলেও দৈনিক গড়ে ৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এই কেন্দ্রের একটি সূত্র জানায়, ৬০০ মেগাওয়াট লোডে দীর্ঘ সময় উৎপাদনে থাকলে বয়লারের টিউব লিকেজ হচ্ছে। বিআইএফপিসিএল প্রকল্প পরিচালক সুভাষ চন্দ্র পাণ্ডে সম্প্রতি এ বিষয়ে বলেন, ‘টিউব দীর্ঘ সময় গুদামে পড়ে থাকায় সমস্যা হচ্ছে। এমন সমস্যা ভারতের বিভিন্ন কেন্দ্রেও হয়েছে। কয়েক বছর পর এটি থাকবে না।’
যন্ত্রপাতির মান নিয়ে প্রশ্ন
যেসব যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো টারবাইনে সমস্যা, বয়লার টিউব লিকেজ, কুলিং হিটারে লিকেজ, হাইপ্রেশার স্টিম লিকেজ, অয়েল লিকেজ ও গ্ল্যান্ডফিল লিকেজ। পিডিবির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রেই শুরুতে নানা জটিলতা থাকে। ধীরে ধীরে ত্রুটি সারিয়ে সেগুলো পূর্ণ ক্ষমতায় চলতে পারে। তবে বয়লার ও টারবাইনে সমস্যা হলে তা বড় ধরনের কারিগরি দুর্বলতা। এ সমস্যা বারবার হলে চিন্তার কারণ আছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক প্রকৌশলী বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে ২০২০ সালে। চালু হয়েছে বরিশাল পাওয়ার প্লান্ট ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে তৈরি এস আলমের পাওয়ার প্লান্ট। তিনটি কেন্দ্রই চলছে কয়লা দিয়ে এবং কোনোটিতে রামপালের মতো বারবার ত্রুটি দেখা দিচ্ছে না। এ জন্যই রামপালে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রামপালে যে মানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কথা ছিল তা করা হয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
তবে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার মনে করেন, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পর সেটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো কেটে যায়।
ভুগবে পিডিবি
বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরোনো দুটি ইউনিটে নির্মাণজনিত ত্রুটি থাকায় সেটি পিডিবিকে ভোগাচ্ছে। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করায় টঙ্গীতে গ্যাসচালিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পিডিবির জন্য ‘শ্বেতহস্তী’তে পরিণত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক প্রকৌশলী বলেন, রামপালের কাজ এখনও ঠিকাদার পুরোপুরি বুঝিয়ে দেননি। তাই কোনো ত্রুটি থাকলে তার স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। কেননা, বিদ্যুৎ না পেলেও চুক্তি অনুসারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে। এতে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান বাড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়লাচালিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ৪ দশমিক ৮৫ সেন্ট। কেন্দ্রটি যান্ত্রিক ত্রুটিতে না চলেও পিডিবিকে এই চার্জ পরিশোধ করতে হবে।
যন্ত্রপাতির মান যাচাইয়ে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে জার্মানির প্রতিষ্ঠান ‘ফিশনার’। বারবার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে ওই প্রতিষ্ঠানকেই যন্ত্রপাতির মান যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফিশনার কাজটি করে জানায়, সব ঠিক আছে।
কিন্তু ফিশনারকে দিয়ে যন্ত্রপাতির মান যাচাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ফিশনার প্রকল্পের পরামর্শক, কী ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়েছে সেটি তারা জানে। তাদের তদারকিতেই কাজ হয়েছে। এখন তারাই যদি যন্ত্রপাতির মান যাচাই করে, সেটি ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ বা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হয়ে যায়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বারবার যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায় রয়েছে। আর দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে হয়তো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে যন্ত্রপাতির মান যাচাই করা হয়েছে।’
সূত্র : সমকাল