খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৪ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

বোকা রাজা ও চালাক মালির গল্প

মোঃ জিল্লুর রহমান শেখ

রাজা মশাই একদিন ভ্রমণে বের হবেন। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রাজা প্রধান ফটকে এক যুবককে দাঁড়ানো দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে যুবক, তুমি এখানে কী চাও?

যুবক বলল- আমি এক ভিনদেশি মালী। আমি রাজবাড়িতে এমন এক আজব ফলের গাছ লাগাই যে, ফল খেলে রাজপরিবারের সবাই জ্ঞানী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রাজাই এ ফল খেয়ে থাকেন। কারণ তাঁকে মন্ত্রীদের চালাতে হয়। রাজা জ্ঞানী হলে মন্ত্রীগণ রাজার মতের আনুগত্য করে। আর মন্ত্রীগণ যা বলেন জনগণ তাই পালন করে। এভাবে রাজ্যে শান্তির বন্যা বয়ে যায় ।

গাছটির আর কী বিশেষত্ব আছে- জানতে চাইলেন রাজা মশাই। যুবক বলল-  গাছটির বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য হলো এটা আরো প্রমাণ করতে সক্ষম -আপনার মন্ত্রীদের জ্ঞানের প্রখরতা কতখানি!

মালির কথায় রাজা মহাখুশী। রাজা মশাই বুঝতেই পারলেন না যে, লোকটা আসলে মস্ত বড় চালাক। রাজা মশাই দেরি না করে মালিকে ভিতরে নিয়ে বললেন, আমাকে কী করতে হবে তাই বল। আমার কোনো করণীয় আছে কি?

মালি বলল- কিছুই না, শুধু আমাকে উপযুক্ত বকশিশ দিলেই হবে।

রাজা মালির কথায় রাজি হয়ে গেলেন। জায়গা প্রস্তুত করা বাবদ মালি টাকা নিল পাঁচ লাখ। কিন্তু খরচ করল মাত্র বিশ হাজার। দুদিন বাদে আবার টাকা চাইল বিদেশ থেকে বীজ আনতে হবে বলে। রাজা টাকা দিলেন। বীজ বপন হলো। প্রতিদিন সেখানে পরিচর্যার নামে শুধু হাতের গায়ের কাজের অভিনয় চলে। নিয়মিত পানি ঢালা হয়। আগাছা পরিষ্কার করা হয়।

একদিন রাজা এলেন গাছ দেখতে। অথচ কিছুই সেখানে দেখতে পেলেন না। দেখবেনই বা কী? সেখানে তো মূলত কিছুই ছিল না। শুধু দেখলেন গাছের পরিচর্যায় মালির ব্যস্ততা।

রাজা বললেন- মলি,গাছ কই? আমিতো গাছ দেখছি না!

মালি বলল- রাজা মশাই,যার জ্ঞানের চক্ষু নেই সে কিন্তু এ গাছ দেখতে পায় না।

রাজা হঠাৎ ভড়কে গেলেন,পরে হেসে বললেন, এইতো, আমি যে গাছ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। মালি মুচকি হাসল।

কদিন পর রাজা তার ঘনিষ্ঠ কজন মন্ত্রীকে পাঠালেন গাছ দেখতে। ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে- এ গাছ দেখতে নাকি জ্ঞানচক্ষুর দরকার হয়। যাদের জ্ঞান কম তারা এ গাছ দেখতে পায় না। মন্ত্রীরা গাছ দেখে গেলেন আর রাজার কাছে গিয়ে গাছের খুব প্রশংসাও করলেন।

মালির বিবরণে দিনে দিনে গাছ বড় হয়ে উঠল। তাতে ফলও ধরল। মালির তো গাছের পরিচর্যা বাবদ টাকা নিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।

রাজা মশাই মালিকে ডেকে বললেন – মালি,ফল খাওয়াবে কবে?

মালি বলল- সবাইকে তো ফল খাওয়ানো দরকার। কারণ জ্ঞানী রাজার জ্ঞানী পরিষদ হবে এটাইতো স্বাভাবিক। তবে প্রথমে আপনি একা খাবেন। দেখবেন আপনার বিচক্ষণতা কত বেড়ে গেছে। সবাই মুগ্ধ হবে। পরে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন , আমি নিজেই সবাইকে ফল পরিবেশন করে খাওয়াব।

মালি চালাকি করে রাজাকে ফল খাওয়াল ইশারা ইঙ্গিতে। রাজা ভাবলেন আমিত এবার বড় জ্ঞানী হয়ে গেছি, কাজেই নতুন কিছু একটা করে জ্ঞানের পরিচয় তো দিতেই হবে। যে ভাবনা সেই কাজ।

রাজা তাঁর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, আমার প্রাসাদের ছাদ কেটে বড় একটা জানালা তৈরি করে দিতে হবে। আমি শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখব, আমার হৃদয়টা আকাশের মত বিশাল হবে। মন্ত্রী বললেন, হুজুর এ তো চমৎকার চিন্তা। এটাতো সবারই করা উচিৎ। রাজা মশাই বললেন ,হ্যাঁ,সবাইকে একাজ করতে বলো। কথা মত রাজ্যে অনেকেই এ কাজ করল।

কিছুদিন বাদে রাজা নির্দেশ করলেন রাজপ্রাসাদের ভিতরে গভীর একটা কূপ খনন করতে। মন্ত্রী এর কারণ জানতে চাইলে রাজা বললেন, কূপের গভীরতার দিকে নজর দিলে জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি পায়। রাজার খেয়াল দেখে সবাই পঞ্চমুখ। তবে দু একজ মন্ত্রী বলাবলি করতে লাগল, ‘রাজাকে কোনো ভূতে পেয়েছে নিশ্চয়। এধরনের কাজ আরো দু একটা শুরু করে দিলে রাজ্য তো রঙ্গশালায় পরিণত হবে।’

এভাবে নানা জনে নানা রকম ব্যাঙ্গাত্বক মন্তব্য করতে শুরু করল। তাতে রাজার বা কী এসে যায়। রাজার সামনে তো কেউ বলছে না। সামনে শুধু প্রশংসার ফুলঝুরি।

একদিন প্রশংসা করতে করতে মন্ত্রীরা রাজার কাছে জ্ঞানফল খাওয়ার দাবি জানালো। রাজাও তাদের দাবিপূরণের জন্য তাঁর বাড়িতে বিরাট আয়োজন করলেন। সবাই অনুষ্ঠানে উপস্থিত। আসনে বসে পড়লেন সবাই। পরিবেশনের দায়িত্ব স্বয়ং মালির। মালি প্রত্যেকের সামনে একটা প্লেট আর তাতে একটা চামচ দিয়ে রাখল। সবাই চুপ করে বসে আছে। প্লেটে শুধু চামচ পড়ে আছে, ফল নেই। মালি রাজার কানের কাছে গিয়ে বলল, রাজা মশাই, সবার প্লেটে কিন্তু ফল দিয়েছি অথচ কেউ মনে হয় দেখতে পাচ্ছে না বিধায় খাচ্ছে না। এবার তাহলে বুঝেছেন আপনার মন্ত্রীদের জ্ঞানের পরিধি কতটুকু?

রাজা মশাই মালির কানের কাছে বললেন- ফল আমার প্লেটেও দিয়েছ নাকি?
মালি বলল- হ্যাঁ হুজুর, দিয়েছি।

মালির কথায় রাজা সহসা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও নিজেকে সামলিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন- আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনুন,আমি আপনাদের বিজ্ঞতা যাচাই করার জন্য এই ফলাহারের আয়োজন করেছি। আমি আজ বুঝতে পারলাম আমার পরিষদ কত বোকা। এত সুন্দর ফল অথচ কেউ খাচ্ছে না, এমনকি দেখতেও পাচ্ছে না, এই বলে রাজা চামচ হাতে নিয়ে ফল খাওয়া শুরু করলেন। রাজা চিবাচ্ছেন আর বলছেন,বাঃ,দারুণ স্বাদের ফল! এমন ফল জীবনে খাইনি।

ওদিকে মালি বসে মুচকি হাসছে।

এক মন্ত্রী দাঁড়িয়ে রাজাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মহারাজ, আপনি অনুমতি না দিলে আমরা তো শুরু করতে পারি না,তাই অপেক্ষা করছিলাম। রাজা এবার খুশী হয়ে অনুমতি দিলেন। সবাই খেতে শুরু করল। মন্ত্রীবর্গ ফল খাচ্ছে আর ফলের প্রশংসা করছে। আহ কী মজার স্বাদের ফলরে। জীবনেও খাইনি। রাজার সাথে রাজার একমাত্র পুত্রও ছিল । সবাই খাচ্ছে।

রাজার ছেলে বলছে – বাবা,আমিতো কারো প্লেটে ফল দেখছি না।

রাজা বললেন – তোমার বয়স সবেমাত্র পঁচিশ হয়েছ। তোমার এটা দেখার জ্ঞান হয়নি। খেয়ে নাও।

ছেলেটার মনে সন্দেহ দানা বাঁধল।সে মালিকে বলল- তুমি সবাইকে বোকা বানানোর ফন্দি আটছ। দাঁড়াও, আমি তোমার জ্ঞান চক্ষুর দাপট দেখব । এ কথা বলে ঘর থেকে কয়েক প্রকারের ফল নিয়ে এল রাজার ছেলে।

এবার মালিকে বলল- তোমার চোখদুটো বাঁধা হবে, তারপর তোমার মুখে আমি ফল তুলে দেব, স্বাদ নিয়ে বলতে হবে কোন ফলের নাম কী, আর কখন তোমার গালে জ্ঞানফল তুলে দেব সেটা স্বাদ নিয়ে বলতে হবে -বুঝলে?

মালি বুঝতে পারল তার চালাকি এবার যাতায় পিষ্ট হব , তার পর তাকেও পিষবে।

মালি হাত জোড় করে বলল- আমার জ্ঞান আর কতটুকুই বা, অহেতুক সময় নষ্ট করে এ যাচাই করার কী ই বা দরকার। যাচাই করতে হলে মহারাজকেই যাচাই করুন, মন্ত্রীদের জ্ঞান এমনিতেই যাচাই হয়ে যাবে।

(লেখক : সহকারি শিক্ষক,গাজী মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রূপসা,খুলনা)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!