দীর্ঘ মানব স্রোত আর ব্যস্ততার হুড়োহুড়ি। কত দ্রুত সময়ে যাওয়া যায় সবার মাঝে যেন এমন প্রতিযোগীতা। পা বাড়ালেই বিদেশ। তাতে ঝুকি ঝামেলা, দুর্ভোগ কী বা যায় আসে। সুবিধাও তো কম নয় ? প্রতিবেশি দেশ ভারত যেতে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীর কোলাহলে পূর্ণ এখন দেশের প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোল। ঈদকে কেন্দ্র করে এ অবস্থা যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ভিসা পদ্ধতি সহজলভ্য হওয়ায় এ দেশের মানুষের ভারতে যাতায়াত উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর ও আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বেনাপোল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নগরী কোলকাতার দুরত্ব মাত্র ৮৮ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ায় অল্প খরচে স্বল্প সময়ে কোলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অনায়াসে যাওয়া যায়।
ঈদকে কেন্দ্র করে ভারত যাতায়াতের সংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েকগুন। গত ২৪ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল এক সপ্তাহে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২২ হাজার ৪৯৬ জন পাসপোর্টযাত্রী ভারতে যাতায়াত করেছে। এদের মধ্যে ভারতে গেছেন ১৫ হাজার ২৯৯ জন আর ভারত থেকে ফিরেছেন ৭ হাজার ১৯৭ জন। ৭ দিনের মধ্যে ২৯ এপ্রিল সব থেকে বেশি ৩ হাজার ১৭৮ জন পাসপোর্টযাত্রী ভারতে গেছেন। যা গত সপ্তাহ থেকে দ্বিগুন।
ঈদের কেনাকাটায় হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে ভারতে। আর দেশের ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত উঠেছে। বেনাপোলসহ আশেপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের ভিসা ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক সহজলভ্য হওয়ায় ঈদে একটু স্বচ্ছল মানুষ মাত্রই কেনাকাটা করতে ছুটেছেন ভারতে। সেখান থেকে পরিবারের জন্য মালামাল কিনে দলে দলে ফিরে আসছেন যাত্রীরা।
কোলকাতায় ঈদ বাজারে বাংলাদেশী ক্রেতা ধরতে ভারতে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বাজার। কোলকাতার নিউমার্কেট, বড় বাজার মীর্জা গালিব স্ট্রিট, বেলগাছিয়া, চিৎপুর, টালিগজ্ঞ পার্ক সার্কাস, এন্টালি, আনোয়ার শাহ রোড, মল্লিকবাজার, রাজাবাজার, ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদ চত্বর, মেটিয়ানুরুজ, খিদিরপুর, পাক স্ট্রিট, জাকারিয়া স্ট্রিট, বড় বাজার এলাকায় ইতোমধ্যে ঈদের জমজমাট বাজার শুরু হয়েছে। এসব এলাকায় অস্থায়ী ভিত্তিতে দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এর বাইরে বিভিন্ন সিটি মলে ঈদ উপলক্ষে কিছু নির্দিস্ট পণ্যের উপর বিশেষ ছাড়ও দেওয়া হচ্ছে। আর স্বল্প মূল্যে মালামাল কিনে সে কারণে হাজার হাজার পাসপোর্টযাত্রী এখন ফিরছেন বাংলাদেশে। এপারে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারলেও ওপারে ইমিগ্রেশন কাস্টমস ও বিএসএফের হয়রানিতে নাকাল বাংলাদেশী পাসপোর্টযাত্রীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রত্যেকে যদি সর্বনিম্ন এক হাজার ডলারের (বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮৬ হাজার টাকা) পণ্য কেনাকাটা করেন তাহলে দেশ থেকে এবারের ঈদে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি চলে যাবে।
অনেকে ভারতে গিয়ে দুই হাজার ডলার থেকে পাঁচ হাজার ডলার পর্যন্তও কেনাকাটা করছেন। এই হিসেবে দেশ থেকে অর্থ চলে যাওয়ার পরিমাণটাও আরও ব্যাপক।
বাংলাদেশে প্রতিটি পণ্যের দাম আকাশচুম্বি। সে কারণে ভারতে গিয়েছিলাম পরিবারের সবার জন্য কিছু কেনাকেটা করতে। কেনাকাটা করে দেশে ফিরছি বললেন, বেনাপোলের রেজাউল ইসলাম।
যশোরের আমজাদ হোসেন জানান, যে শাড়ি থ্রিপিসের দাম এখানে ১০ হাজার টাকা সেই মাল কলকাতা থেকে কিনে এনেছি মাত্র ৪ হাজার টাকায়। পণ্যের মানও ভাল।
যাত্রী অন্নপূর্ণা জানান, আমি এক বছরের মাল্টিপল ভিসা পেয়েছি। বৃহস্পতিবার বিকেলে কলকাতা পৌছে অল্পকিছু কেনাকাটা করেছি। শুক্রবার ও শনিবার কেনাকাটা সেরে রবিবার (০১ জুন) সকালে ফিরে এলাম। আমাদের দেশীয় বাজারের তুলনায় অনেক কম মূল্যে কেনাকাটা করেছি।
তবে ভারত থেকে ফেরা যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে, ই-টোকেন কিংবা ভিসা ব্যবস্থাপনা ভারত সরকার আগের তুলনায় সহজলভ্য করলেও সীমান্তের ওপারেই রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। সেই সাথে ভারতের পেট্রাপোল চেকপোস্টে রয়েছে ভারতীয় ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিএসএফের চরম দুর্ব্যবহার। ভারত ঘুরে আসা অনেক বাংলাদেশী সেখানে দুর্ব্যবহার আর অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে এসে প্রতিদিন অভিযোগ করছেন।
ভারত ঘুরে আসা বরিশালের যাত্রী ধীমান সরকার জানান, ভারতীয় কাস্টমস এবং বিএসএফ বাংলাদেশের মানুষকে মানুষ বলে বিবেচনা করে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আসার সময় নোম্যান্সল্যান্ডে প্রতিটি ব্যাগ খুলে তল্লাশি করেছে। অপর এক যাত্রী যশোরের আশরাফ আলী জানান, কেউ প্রতিবাদ করলে কিংবা কোন ব্যাপারে প্রশ্ন ছুড়লে তার পাসপোর্ট আটকে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেয়া হয়। বয়স্ক মানুষও এ থেকে রেহাই পান না। কেউ কোন প্রশ্ন না বুঝে আবার জিজ্ঞাসা করলেও দুর্ব্যবহারের শিকার হন।
অভিযোগকারীরা আরো বলেন, বাংলাদেশীদের ভারতে যাওয়া এবং কেনাকাটা করায় ঐ দেশ হাজার কোটি টাকা আয় করছে। অথচ এদেশের মানুষ সেদেশে ঢোকা এবং বেরুনোর মুখেই চরম দুর্ব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে সেখানে দালাল চক্র অনেক যাত্রীর কাছ থেকে পাঁচশ থেকে এক হাজার টাকা করে ঘুষ আদায় করছে বলে তারা জানান।
খুলনার আতিয়ার রহমান নামের একজন যাত্রী জানান, বেনাপোল ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস থেকে বের হওয়ার পর প্যাসেজ্ঞার টার্মিনালের সামনে বিজিবি সদস্যরা আমার প্রতিটি ব্যাগ খুলে তন্ন তন্ন করে চেক করেছে। প্রত্যেক যাত্রীর ব্যাগ তারা চেক করছে। বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বিজিবি সদস্যরা আরও একবার চেক করেছে। তারপর কাস্টমস চেক করেছে। একই জায়গায় ৩ বার চেক করে আমাদের হয়রানি করছে।
ইমিগ্রেশন পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ রাজু আহম্মেদ বলেন, অন্যান্য মাসের তুলনায় চলতি মাসে বেনাপোল দিয়ে ভারতে পাসপোর্টযাত্রীদের যাতায়াত বেড়েছে কয়েকগুন। এবং যারা ফিরে আসছেন তাদের বেশিরভাগই ঈদের শপিং করে ফিরছেন। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে ভারতীয় হাইকমিশন ট্যুরিস্ট ভিসা চালু করায় আড়াই হাজার পাসপোর্টযাত্রী প্রতিদিন বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত করছে। আজ এবং কাল আরো যাত্রীর চাপ আর ও বাড়বে বলে তিনি জানান। সাধারণত ঈদের ছুটিতে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের ভারতে ভ্রমণে যাওয়ার আগ্রহ থাকে। এ জন্য ওই সময়ে চেকপোস্টে বাড়তি চাপ থাকে। তবে যাত্রীরা যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে পারেন সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাত্রীচাপ বেশি হওয়ায় আমাদের কাউন্টারের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে।