খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব : আমাদের জাতীয় চেতনার বাতিঘর

ওমর খালেদ রুমি

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য বঙ্গবন্ধু পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়া সত্তেও যিনি বলতে গেলে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে আলোচনার বাইরেই রয়ে গেছেন। সেই মহিয়সী নারী আর কেউ নন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্ন্ছো মুজিব। অথচ ১৯৩৮ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এই মানুষটি পর্দার আড়ালে থেকে তার সারাটা জীবন বাংলার মানুষের কল্যাণ আর মুক্তির জন্যে উৎসর্গ করে গেছেন।

বললে অত্যুক্তি হবে না যে, শেখ মুজিবের “মুজিব ভাই” থেকে “বঙ্গবন্ধু” হয়ে ওঠার যে নন্দিত গল্প তার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে এই মহিয়সী নারীর ত্যাগ আর তিতিক্ষা। বলতে দ্বিধা নেই বঙ্গবন্ধু যখন ছাত্র রাজনীতি করতেন, তখন তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করতেন। জীবনের প্রতিটি জঠিল বাঁকে যখনই বঙ্গবন্ধুর পথ হারানোর কিংবা বিভ্রান্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি এসেছে, তখনই শক্ত হাতে হাল ধরেছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। লেখক আফজাল হোসেন তার “বঙ্গমাতা বেগম মুজিব স্মরণে” লেখায় একথাগুলোই লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুর ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে শাহাদাতবরণ পর্যন্ত ছায়ার মতো সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডে পাশে ছিলেন বেগম মুজিব। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং পরবর্তী সময় দেশ গড়ার সংগ্রামে বেগম মুজিব অনেক কষ্ট করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ছাত্র রাজনীতি করার সময়ও বেগম মুজিব তার পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়মিত সহযোগিতা করতেন। রাজনৈতিক কাজে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতার এই মনোভাব তার আমৃত্যু ছিল। দেশমাতৃকার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তাঁর গহনা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।’’

১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় বেগম মুজিব স্বামীকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি শুধু আমার স্বামী হবার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্য জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর আমার ভার ছেড়ে দিন।’ ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট জন্মের হিসাবে বেগম মুজিবের বয়স তখন বড় জোর ১৬ বছর।

১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সেই ক্রান্তিকালের কথাই ধরা যাক না। সবাই যখন বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুব খানের গোল টেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের পক্ষে বেগম মুজিব তখনও অনড় রইলেন, তার নিঃশর্ত মুক্তির পক্ষে। অবশেষে তাই হয়েছিল। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও তুলে নেয়া হয়। সেদিন তিনি জেলখানায় থাকা বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতিতে আপোষ করলে ছেড়ে যাবার পর্যন্ত হুমকি দিয়েছিলেন।

বাংলার মানুষকে তিনি চিনতেন ও জানতেন। জানতেন বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব হয়েছিল। জেলগেট থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নেতাকর্মীদের জন্য তিনি যেমন নির্দেশ নিয়ে আসতেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুকেও সমস্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবহিত করতেন। তার কারণেই, তার ধৈর্য্য আর ত্যাগের কারণেই, তার শ্রম আর নিষ্ঠার কারণেই ধানমন্ডির ৩২নং বাড়িটি আওয়ামী লীগের অঘোষিত কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল।
কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাই যথার্থই বলেছেন- “মাথায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বহুদিনের আত্মগোপনকারী ছাত্রনেতা কিংবা রাজনৈতিক কর্মী অভুক্ত অস্নাত অবস্থায় মাঝ রাতে এসে ঢুকেছেন বত্রিশের বাড়িতে, তাকে সেই রাতে নিজের হাতে রেঁধে মায়ের স্নেহে, বোনের মমতায় পাশে বসে খাওয়াচ্ছেন বেগম মুজিব। এই দৃশ্য একবার নয়, কতবার দেখেছি।’’

সারাটা জীবন যে নারী এই দেশ, এই মাটি, এই মানুষকে ভালোবেসে নিজের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, ভুলে গিয়েছিলেন নিজের নিজেকে ঘাতকের বুলেট শেষ পর্যন্ত তাকেও ছাড়েনি। ৭৫’র ১৫ আগষ্টের সেই কালো রাতে মাত্র পয়তাল্লিশ বছর বয়সে এই মহিয়সী রমণীকে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। যে বাংলাকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন; এতোটাই যে রাজনীতিতে আপোষ করলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে যাবার পর্যন্ত হুমকি দিয়েছিলেন- সেই বাংলার মাটি তার রক্তে লাল হয়েছিল।

আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি তাও প্রায় অর্ধ-শতাব্দী হল। এই দীর্ঘ সময়েও আমরা এই মহিয়সী নারীর ত্যাগের মূল্যায়নই করতে পারিনি। বর্তমান প্রজন্মকে জানাতেও ব্যর্থ হয়েছি পর্দার অন্তরালে থেকেও তিনি কিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয় তুল্য হতে সাহায্য করেছিলেন। কিভাবে আজীবন জেল জুলুম খাটা শেখ মুজিবের সংসার সামলেছেন। কিভাবে পার করেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবহীন অসহায় দিনগুলো পার করেছেন। তিনি তো জানতেনই না শেখ মুজিব বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হওয়ার আগের সময়টাতে কি অনিশ্চয়তার জীবন তাকে যাপন করতে হয়েছে আমাদের তা জানা উচিত। আশা করি আগামী দিনগুলোতে এ জাতি তার সঠিক মূল্যায়ন করবে।

খুলনা গেজেট/এআইএন




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!