বুলিং বা র্যাগিং প্রতিরোধে প্রচলিত বিধিবিধানে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াও ফৌজদারি আইনে মামলা করার বিধান রেখে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং/র্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’ জারি করেছে সরকার। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সদস্য, শিক্ষার্থী সবার জন্যই এই বিধান রাখা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৪ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং (Bullying)/র্যাগিং (Ragging) প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’ প্রকাশ করে। গত ২ মে নীতিমালাটিতে স্বাক্ষর করা হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিংয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় নীতিমালায়। এতে বলা হয়, কাউকে উদ্দেশ করে মানহানিকর, অপমানজনক এমন কিছু বলা, লেখা যা খারাপ কোনও কিছুর প্রতি ইঙ্গিত বহন করে এমন কিছু করাকে বুলিং বা র্যাগিং বোঝাবে। যেমন, উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন করা বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা, গালিগালাজ করা, শিস দেওয়া, হুমকি দেওয়া, শারীরিক অসমর্থতা নিয়ে উপহাস করা বা অনুরূপ কাজ।
শারীরিক বুলিং বা র্যাগিং : শারীরিক বুলিং বলতে কাউকে কোনও কিছু দিয়ে আঘাত করা, চড়-থাপ্পড় মারা, শরীরে পানি বা রঙ ঢেলে দেওয়া, লাথি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা দেওয়া, থুতু মারা, বেঁধে রাখা, কোনও বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে/বসে বা বিশেষ অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া অথবা কোনও কিছু করতে বা না করতে বাধ্য করা, কারও কোনও জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা, মুখ দিয়ে অশালীন ও অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা বা অনুরূপ কাজ করাকে বোঝানো হয়েছে।
সামাজিক বুলিং বা র্যাগিং : কারও সম্পর্কে গুজব ছড়ানো; প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা; ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, পেশা, গায়ের রঙ, অঞ্চল বা জাত তুলে কোনও কথা কলা বা অনুরূপ কাজকে সামাজিক বুলিং বা র্যাগিং হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
সাইবার বুলিং ও র্যাগিং : কারও সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটু কিছু লেখা বা ছবি বা অশালীন ব্যঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট করে তাকে অপদস্থ করা বা অনুরূপ কাজকে বোঝানো হয়েছে।
সেক্সুয়াল বুলিং বা র্যাগিং : ইচ্ছাকৃত শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিজনকভাবে স্পর্শ করা বা করার চেষ্টা করা, ইঙ্গিতবাহী চিহ্ন প্রদর্শন করা, আঁচড় দেওয়া, জামা-কাপড় খুলে নেওয়া বা খুলতে বাধ্য করা বা অনুরূপ কাজ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যান্টি বুলিং কমিটি : বুলিং বা র্যাগিং প্রতিরোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিন থেকে পাঁচ সদস্যের অ্যান্টি বুলিং কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে নীতিমালায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আত্মহত্যা, বুলিং, র্যাগিং সংক্রান্ত যেকোনও ধরনের ইনজুরি প্রতিরোধে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বুলিং প্রতিরোধে কমিটি প্রতি তিন মাস অন্তর একবার শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের সভা, মতবিনিময়, সেমিনার, সিমপোজিয়াম, ওয়ার্কশপ আয়োজন করবে। কমিটি র্যাগিং ও বুলিং হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে কমিটি প্রতিষ্ঠানে রাখা অভিযোগ বক্স/ডিজিটাল ড্রপ বক্স রাখার ব্যবস্থা করবে এবং অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
শাস্তি বা ব্যবস্থা : বুলিং ও র্যাগিংয়ে কোনও শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন/বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বুলিং ও র্যাগিংয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটি, অ্যাডহক কমিটি, বিশেষ কমিটির কোনও সভাপতি, সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিধি, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে।
কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের করণীয় : বুলিং এবং র্যাগিং উৎসাহিত হয় এমন কোনও কার্যকলাপ/সমাবেশ/অনুষ্ঠান করা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেসব জায়গায় বুলিং ও র্যাগিং হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেসব জায়গায় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা করবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (আবাসিক হলসহ) কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে বুলিং ও র্যাগিংয়ের ঘটনার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করবে; অন্যথায় নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী হবে।
বুলিং ও র্যাগিংয়ের উদাহরণ এবং পরিণতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ ওয়েবসাইটে এবং প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারণা চালাবে।
শিক্ষাবর্ষের শুরুতে একদিন ‘বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে বুলিং ও র্যাগিংয়ের কুফল সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবে।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী/শিক্ষক/অভিভাবকদের শপথ নিতে হবে। পাঠকৃত শপথ পালনে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করাবেন এই মর্মে যে তারা কখনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বুলিং ও র্যাগিং করবেন না, কাউকে বুলিং ও র্যাগিংয়ের শিকার হতে দেখলে রিপোর্ট করবেন, প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।
বুলিং ও র্যাগিংয়ের কুফল সম্পর্কিত সিনেমা, কার্টুন, টিভি সিরিজ প্রদর্শন, অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণের ব্যাপারে কর্মশালা ইত্যাদিসহ সহপাঠ্যক্রমিক কর্মশালা আয়োজনের জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।
কর্তৃপক্ষ বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে’ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। যেমন, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, গণিত অলিম্পিয়াড, বই পড়ার প্রতিযোগিতা, দাবা খেলা, ক্যারম খেলা ও বিভিন্ন খেলাধুলা আয়োজন করবেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহমর্মিতা এবং সহানুভূতিশীলতার শিক্ষা দিতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কাজে নিযুক্ত করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা বুলিং/র্যাগিংয়ের কুফল কিংবা এর ফলে কীভাবে একজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য এবং সে সঙ্গে বুলিং ও র্যাগিং সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান তারা নিজেরাই বের করতে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শিক্ষকরা উপস্থাপন করবেন।
সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুনির্দিষ্ট কোনও শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাউন্সিলিংয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। তাদের ‘কাউন্সিলর’ হিসেবে অভিহিত করা হবে।
বুলিং ও র্যাগিং নীতিমালা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত বুলিং ও র্যাগিং বিষয়ে পরিবীক্ষণ করবেন এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন।
খুলনা গেজেট/কেডি