পাকিস্তানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ার রাজধানী পেশোয়ারের পুলিশ লাইন্স এলাকায় মসজিদে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করেছে দেশটির নিষিদ্ধঘোষিত সশস্ত্রগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। সোমবারের এই বিস্ফোরণে অন্তত ৫৯ জন নিহত এবং ১৪৭ জন আহত হয়েছেন বলে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জিও নিউজ বলছে, সোমবার যোহরের নামাজের সময় পুলিশ লাইন্স এলাকার মসজিদের সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলেন আত্মঘাতী হামলাকারী। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
এদিকে আত্মঘাতী এ হামলার দায় স্বীকার করেছে দেশটির নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)।
পুলিশ বলছে, বিস্ফোরণে মসজিদের ইমাম সাহেবজাদা নূর উল আমিনও মারা গেছেন।
দেশটির সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে জিও নিউজ বলছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনে যাচ্ছেন।
বিস্ফোরণে মসজিদের একাংশ ধসে যাওয়ায় অনেকে ধ্বংস্তূপের নিচ চাপা পড়েছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে পেশোয়ার পুলিশের কর্মকর্তা এজাজ খান বলেছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেক পুলিশ সদস্য আটকে রয়েছেন। যে কারণে এখনই হতাহতের ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে উদ্ধার অভিযানে মনোনিবেশ করেছি। আমরা এখনই নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। তবে মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরকের গন্ধ পাওয়া গেছে। যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানে পেশোয়ার পুলিশ, সিটিডি, এফআরপি, এলিট ফোর্স এবং টেলিযোগাযোগ বিভাগের সদর দপ্তর রয়েছে।
বিস্ফোরণে হতাহতের তথ্য নিশ্চিত করে পেশোয়ারের কমিশনার রিয়াজ মেহসুদ ডন নিউজকে বলেছেন, মসজিদের ভেতরে উদ্ধার অভিযান চলমান আছে। অনেকেই মসজিদের ধ্বংস্তুপের নিচে আটকে পড়ায় হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।
দেশটির জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা বলেছেন, শহরের সব হাসপাতালে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করা হয়েছে। বিস্ফোরণে আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। মসজিদে বিস্ফোরণে আহতদের উদ্ধার করে পেশোয়ারের লেডি রিডিং হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। আহতদের রক্তদানে সহায়তায় এগিয়ে আসতে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
খাইবার পাখতুনখোয়ার তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ আজম খান পেশোয়ারের সব হাসপাতালে চিকিৎসা বিষয়ক জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। অন্তর্বর্তীকালীন এই মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধারকারী সব সংস্থাকে ত্রাণ তৎপরতার গতি ত্বরান্বিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, বিস্ফোরণের সময় তিনি মসজিদে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ ছিল। বিস্ফোরণের পর সর্বত্র ধোঁয়া উড়ছিল।
পেশোয়ারের যে এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেখানে পেশোয়ার পুলিশ, সিটিডি, এফআরপি, এলিট ফোর্স ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সদর দপ্তর রয়েছে
এই প্রত্যক্ষদর্শী আরও বলেন, মসজিদের ভেতরে ২০০ জনের বেশি মানুষ নামাজ আদায়ের সময় বিস্ফোরণটি ঘটেছে। এটা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ। কারণ বোমা হামলাকারী মসজিদের ভেতরে ছিলেন। নামাজ শুরু হওয়া মাত্রই বিস্ফোরণটি ঘটেছে। আহতদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশ সদস্য বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের কারণে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরে চেতনা ফেরার পর দেখেন, মসজিদের ছাদ ধসে গেছে।’
মসজিদটিতে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন সিভিল সেক্রেটারিয়েট অ্যাসোসিয়েশন পেশোয়ারের সভাপতি তাসাভুর ইকবাল। তিনি বলেন, পুলিশ লাইন্স এলাকায় সবসময় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পরিচয়পত্র এবং দেহ তল্লাশি ছাড়া কেউই এই মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না।
পেশোয়ারের এই বাসিন্দা বলেন, আজকের এই ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা অনেক বড় মসজিদ। একসাথে ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। বিস্ফোরণে ভবনের একাংশ ধসে গেছে।
পাকিস্তানি তালেবান কারা?
আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন সশস্ত্র তালেবানগোষ্ঠীর মতোই পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করে নিজেদের সরকার গঠন করতে চায় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। পাকিস্তানজুড়ে শরিয়া আইন চালুর দাবিতে বেশ কয়েক বছর ধরে তৎপরতা চালিয়ে আসছে তেহরিক-ই-তালেবান। এর আগে কয়েকবার টিটিপি ও পাকিস্তানের সরকারের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে সেসব উদ্যোগ।
দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছরের ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত উভয়পক্ষের অস্ত্রবিরতি কার্যকর ছিল।
পাকিস্তানজুড়ে শরিয়া আইন চালুর দাবিতে বেশ কয়েক বছর ধরে তৎপরতা চালিয়ে আসছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের নারী শিক্ষা অধিকার কর্মী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি পায় টিটিপি। রয়টার্সের তথ্যমতে, টিটিপির একের পর এক আত্মঘাতী হামলা ও বোমা হামলায় এরই মধ্যে পাকিস্তানের কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
‘দুটি পুলিশ চেকপোস্ট পেরিয়ে মসজিদে যান হামলাকারী’
দেশটির সাংবাদিক কাইসার ব্যাখ্যা করে বলেন, পুলিশ লাইন্স এলাকাটি পেশোয়ারের ক্যান্টের অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থিত। এই এলাকায় ২৪ ঘণ্টাই আইনপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার ব্যাপকসংখ্যক সদস্য ও এফসি কর্মীরা উপস্থিত থাকেন।
তিনি বলেন, খাইবার পাখতুনখোয়ার কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট (সিটিডি) ও পুলিশের তদন্ত বিভাগের কার্যালয় এখানে অবস্থিত। সাধারণত পুলিশের এই সদর দপ্তরে এক হাজার পুলিশ কর্মী উপস্থিত থাকেন।
পাকিস্তানি এই সাংবাদিক বলেন, ওই এলাকাটির ভেতরে যেতে হলে অন্তত দু’টি পুলিশি তল্লাশিচৌকিতে থামতে হয়। অন্তত তিনবার তল্লাশি এড়িয়ে বোমা হামলাকারী ভেতরে ঢুকতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে বোমাটি আগে থেকেই মসজিদে পেতে রাখা হয়েছিল নাকি এটি আত্মঘাতী হামলা— তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন দেশটির পুলিশ কর্মকর্তারা। বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের সব সড়ক ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইসলামাবাদেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, মসজিদে বিস্ফোরণের এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরণ প্রমাণ করে, হামলায় জড়িতদের ‘ইসলামের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই।’
মসজিদে হামলার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে তিনি বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব পালনকারীদের লক্ষ্য করে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে।’
দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খান এক টুইটবার্তায় এই ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদী আত্মঘাতী হামলা’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছেন। হতাহতদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন তিনি।
খুলনা গেজেট/ এসজেড