আজ ১৯ আগস্ট বিশ্ব আলু দিবস। যুক্তরাষ্ট্রে দিনটি জাতীয়ভাবে পালিত হয়। আলু একটি শ্বেতসারসমৃদ্ধ কন্দ। এটি আমেরিকার স্থানীয় একটি মূল সবজি। বন্য আলুর প্রজাতি আমেরিকা জুড়ে কানাডা থেকে দক্ষিণ চিলি পর্যন্ত পাওয়া যায়। জানা যায় ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে স্পেনীয়রা আমেরিকা থেকে আলু ইউরোপে প্রবর্তন করে। বর্তমানে আলু বিশ্বের অনেক দেশে একটি প্রধান খাদ্য এবং বিশ্বের বেশিরভাগ খাদ্য সরবরাহের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০১৪ সালের এক হিসাবে, ভুট্টা, গম ও ধানের পরে আলু ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্য শস্য। আলুর প্রায় ৪০০০টি জাত রয়েছে। আলুর দোষ যতই থাক না কেন, গুণ কিন্তু কম নয়! অন্তত চিকিৎসক এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা তেমনটাই বলে থাকেন। গোটা বিশ্বে আলুর মতো জনপ্রিয় খাবার খুব কমই চোখে পড়ে। আলুর রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। আলুতে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি। এছাড়া আলুর খোসাতে আছে ভিটামিন এ, পটাশিয়াম, আয়রন, অ্যান্টি-অক্সাইড, ফাইবারসহ প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশের আলুর আদিজাত হচ্ছে মিষ্টি আলু। আর গোল আলুর আদিজাত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী কালে তা পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আলুর চাষ শুরু হয়। জানা যায় দেশে প্রায় ২০০ বছর আগে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলায় প্রথম আলুর আবাদ শুরু হয়। আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা হল্যান্ডের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করা শুরু করে। নব্বই দশকের শেষের দিকে দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত কৃষকরা চাষ শুরু করে। দেশে উদ্ভাবিত তিন মাসে ফলন হয় এমন আলুর জাত উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে। রংপুরে দেশের এক- চতুর্থাংশ আলু উৎপাদিত হয়। তবে রপ্তানি-মানের আলু উৎপাদনে সেরা জেলাগুলোর একটি ঠাকুরগাঁও।
আলু বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। সস্তা ও টেকসই হওয়ায় অর্থনীতিতে আলু ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বিশ্বে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দেশে এখন প্রায় ৫ লক্ষ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ৩ লক্ষ মে. টন আলু উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৭৫-৮০ লক্ষ মে. টন। প্রতিবছর দেশ থেকে থেকে আলু রপ্তানি করা হচ্ছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, রাশিয়াসহ ১১টি দেশে আলু রপ্তানি করা হয়। তবে আলুর সবচেয়ে বেশি চাহিদা মালয়েশিয়ায়। হিসেব মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আলু রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ১১.৬৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১০০ কোটি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ১১ মিলিয়ন টন আলু উৎপাদন করেছে। এরমধ্যে ০.৮ মিলিয়ন টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে। এশিয়ায় চীন ও ভারতের পর এটিই সবচেয়ে বেশি। যেসব আলু বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সানশাইন, সান্তানা, গ্রানোলা, লরা, এলুয়েট ও ডায়মন্ড জাতের আলু। দেশে বর্তমানে যেসব জাতের আলু উৎপাদিত হচ্ছে, তার চাহিদা বিদেশে অনেক কম। সে জন্য রপ্তানিযোগ্য ও শিল্পে ব্যবহার উপযোগী আলুর জাত সম্প্রসারণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারিভাবে বিএডিসির মাধ্যমে বিদেশ থেকে অনেকগুলো উন্নত জাত আনা হয়েছে, সেগুলো কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের কাজ চলমান আছে।
আলুকে গণতান্ত্রিক সবজি বলা হয়। কারণ বাঙালির এমন কোনো রান্নাঘর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আলুর উপস্থিতি নেই। বলা যায় রান্নাবান্নায় আলুর একক আধিপত্য। মাছ থেকে মাংস তরকারি যা-ই হোক, তাতে আলু থাকা চাই। সর্বত্র, সবার সঙ্গে আলু সহজে মিশে যায়। যেমন, পুরি, শিঙাড়া, পরোটা, ভর্তা, ভাজি, তরকারি- এসব তো আছেই। শুধু আলুকেই কেন্দ্র করে রয়েছে নানা পদের মুখরোচক খাবার। যেমন আলুর চপ, আলুর লুচি, আলুর চিপস, আলুর পাকোড়া, আলুর কাটলেট, আলুর চটপটি, আলুর দম ইত্যাদি। আবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের কথা তো আলাদা করে না বললে নয়। দেশের সকল অভিজাত হোটেলে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই একটি অধিক প্রচলিত খাবার। দিনে দিনে আলুর কদর বাড়ছেই। নতুন নতুন রেসিপি তৈরি হচ্ছে। আলুর পায়েস, আলুর হালুয়া, আলুর পোস্ত, আলুর দোলমা, আলুর চাটনি, রসমালাই, রসগোল্লা সব স্বাদেই আলোকিত আলু। কাচ্চি বিরানি বা তিহারিতে আস্ত আলু অনেকের কাছেই আকর্ষনীয় খাবার হিসেবে পরিচিত।
আলু নিয়ে রয়েছে নানা কান্ড। অষ্টাদশ শতকের বাভারিয়ার ক্ষমতা দখলের যে যুদ্ধ, তা পটেটো ওয়ার নামেই খ্যাত। ২০০৫ সালে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই আইভানভ বলেছিলেন, গণতন্ত্র আলু নয় যে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে নিয়ে লাগাবেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জাম্বিয়ার প্রধান বিরোধী দলের নেতা ফ্রাঙ্ক বোয়ালিয়া সে দেশের প্রেসিডেন্ট মাইকেল সাটাকে মিষ্টি আলু বলে পাঁচ বছরের কারাদন্ডযোগ্য এবং অজামিনযোগ্য একটি অপরাধ করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আলু নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের একটি হচ্ছে ‘দ্য পটেটো ইটার্স’, ভ্যান গগের আঁকা। আলু নিয়ে অনেক গান ও কবিতা শোনা যায়। যেমন জনপ্রিয় ফোক গায়িকা মমতাজ-এর একটি গান-
“আলুতে হয় চপ, আবার আলুতে হয় পুরী
আলুতে সিংগাড়া, আবার আলুতে খিচুরি
বস্তায় বস্তায় পাঠাইয়া দেয় আমার জন্য দুলাভাই”
মানুষের আলুর দোষ থাকলেও আলুর কখনো মানুষের দোষ থাকে না। দোষ তো আলুর নয়, দোষ মানুষের। সুতরাং দোষের দায়ভার মানুষের উপরে না চাপিয়ে আলুর উপরে চাপানোর নজির তৈরি হয়েছে। সবকিছুর সঙ্গে নিঃসংকোচে আলু মিশে যায়। আবার ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’ বিশেষ সময়ে চালু হওয়া এই প্ক্তি তো সবার জানা।
আলুর প্রতি মানুষের পক্ষপাতিত্বের কিছু যৌক্তিক কারণ আছে। প্রথমত, এর সহজলভ্যতা। দ্বিতীয়ত, এর পুষ্টিগুণ। আলু রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, ত্বক ভালো রাখে, মস্তিষ্ককে কর্মক্ষম রাখে, হজমে সহায়তা করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তবে নিশ্চয়ই মাত্রাতিরিক্ত আলু খেলে ওজন বাড়ার ঝুঁকি থাকে। রূপচর্চার কাজেও আলু ব্যবহার করা যায়। চোখের কোলের কালি তুলতে আলুর রসের প্যাক খুব কার্যকর। আলুর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন সি যা ত্বকের যে কোনো কালো ছোপ কমাতে সাহায্য করে। ত্বকের রুক্ষতা কমাতে দুধ বা দইয়ের সঙ্গে আলু কোরা মিশিয়ে ফেস প্যাক লাগালে উপকার পাওয়া যায়। কোলাজেন ত্বক টানটান, কোমল রাখতে সহায়তা করে।
আলুর গুণের কোনো শেষ নেই। স্ট্যাপল ফুড হিসেবে সবচেয়ে ভারসাম্য রক্ষাকারী খাবার হচ্ছে আলু; সবচেয়ে কম জায়গাতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ক্যালোরির জোগান দিতে পারে আলু। তাই ওয়ার্ল্ড পটেটো কংগ্রেস বলছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সঙ্গে তারা ২০২৪ সাল থেকে ৩০ মে আন্তর্জাতিক আলু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যাক, এ বছর কিন্তু আজকের দিনেই দিবসটি পালিত হচ্ছে।
লেখক: সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসুদন কলেজ, যশোর।
খুলনা গেজেট/ বিএম শহিদুল