বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের বিশেষ আইন পাস হওয়ার পর বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে গত ১৩ বছরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) বাবদই গুনতে হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। যদিও দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হলে বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হতে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ এবং এ খাতের কর্মকর্তারা।
প্রতিযোগিতা ছাড়া বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ কেনার ফলে কী পরিমাণ অর্থের তছরুপ হয়েছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাতে এর পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকার মতে হতে পারে।
তীব্র বিদ্যুৎ-সংকট মোকাবিলায় ২০১০ সালে দুই বছরের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ নামে একটি আইন করেছিল সরকার। এই আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবেও পরিচিত পেয়েছে। তিন দফা মেয়াদ বৃদ্ধি ও সংশোধনের পর ২০২৬ সাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা রয়েছে। গত এক দশকে বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে উদ্বৃত্তর দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে শতভাগ মানুষ। তারপরও আইনটি চালু রয়েছে এখনো।
গত এক যুগে এ আইনের আওতায় বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। অস্বচ্ছতার পাশাপাশি এসব চুক্তির ক্ষেত্রে অতি গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। প্রতিযোগিতা না থাকায় বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান ইচ্ছেমতো দাম আদায় করছে।
২০১০ সালে আইনটি পাসের সময়ই সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে যখনই এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, তখনই আপত্তি উঠেছে। কিন্তু কোনো আপত্তি, বিরোধিতায় এই আইন বাতিল হয়নি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, আইনটি কার্যকর হওয়ার পর গত ১৩ বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৯১টি বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে, যার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র থেকে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৩ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে এ সময় আনুমানিক ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার বিদ্যুৎ কেনা হতে পারে। এটি বিবেচনায় নিলে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো থেকে মোট প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনেছে সরকার। সে হিসেবে ক্যাপাসিটি চার্জও বাড়বে। পাশাপাশি ভারত থেকেও বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ক্ষমতাধর বিনিয়োগকারী গোষ্ঠীর স্বার্থের সুরক্ষা দিচ্ছে এ আইন। এখানে সরকারি ক্রয় বিধিমালা লঙ্ঘন করে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গাটি উপেক্ষিত। ক্রয় প্রক্রিয়ায় অসচ্চতা কিংবা যেকোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও আদালতে যাওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার অভাবে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সর্বোচ্চ ভ্যালু ফর মানিপ্রাপ্তির সুযোগ নেই। এতে ব্যয় বাড়ছে। দিন শেষে সেই বোঝা জনগণকেই বহন করতে হচ্ছে। কাজেই আমরা মনে করি, এই আইন এখনই বাতিল করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের আদানির সঙ্গে এত বড় একটা অস্বচ্ছ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি হয়ে গেল কিন্তু সমালোচনা ছাড়া আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বিদ্যুৎ, জ্বালানির বিশেষ আইন তা নিষিদ্ধ করে রেখেছে। একই অবস্থা রামপাল ও অন্যান্য আরও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে। এসব প্রকল্পের বিষয়ে জনগণের জানার বা জনগণের কাছে জবাবদিহির সুযোগ নেই, যে কারণে বাস্তবে এসব প্রকল্পের নানা অস্বচ্ছতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির বিচারহীনতা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের যে সাফল্যের দাবি, তা এই নীতি-দখলের কারণে ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়েছে।’
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ১৪ বছরে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রায় ৫৭ হাজার ৭০৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ সময় বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কেনা হয়েছে ৪০ হাজার ৬৮১ কোটি ইউনিটেরও বেশি বিদ্যুৎ।
২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৫৩৯ কোটি ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। আর বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে কেনা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৩৭ কোটি ইউনিট। অর্থাৎ বেসরকারি থেকে কেনা হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
পরের তিন অর্থবছরে সরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ আরও কমতে থাকে। বিপরীতে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়তে থাকে এবং ওই তিন বছরে তা বেড়ে ১ হাজার ৮১৭ কোটি ইউনিট ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সরকারি ও যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৬৩৭ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হয়। অন্যদিকে বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে কেনা হয় প্রায় ২ হাজার ৯ কোটি ইউনিট। এরপরের সাত বছর সরকারি যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্র থেকে প্রতিবছরই বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৯৯২ কোটি ইউনিট। আর ব্যয় হয় ৭ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও যৌথ উদ্যোগের কেন্দ্র থেকে ২৩ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার বিনিময়ে ২ হাজার ৩৭৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে কেনা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮২ কোটি ইউনিটেরও বেশি বিদ্যুৎ। এতে ইউনিটপ্রতি গড়ে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ৯ দশমিক ৮৫ এবং ১২ দশমিক ৯৫ টাকা।
পিডিবির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ১৪ বছরে দেশে সরকারি ও যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎকেন্দ্র তুলনামূলক অনেক কম নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তখন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে জনজীবন ও অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। সেই সক্ষমতা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। যদিও এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। মোট সক্ষমতার মধ্যে মাত্র ১১ হাজার মেগাওয়াট সরকারি খাতের, বাকি বিদ্যুৎ বেসরকারি, যৌথ উদ্যোগ এবং আমদানি করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি ও যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মনোযোগী হলে বেসরকারি খাতের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল হতে হতো না। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও খুব বেশি বাড়ত না। ২০০৯-১০ সালে সরকারও বলেছিল, ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ বিদ্যুতের দাম আর না বাড়িয়ে বরং কমানো সম্ভব হবে। কিন্তু গত ১৪ বছরে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৩ বার। এর মধ্যে গত বছরই তিন দফায় ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসেবে বিদ্যুতের দাম ৭৮ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পিডিবি।
ভোক্তা অধিকারবিষয়ক সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশেষ আইন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে ব্যাপক অর্থের তছরুপ করা হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিনিয়োগকারীকে নানাভাবে লাভবান করার এটি একটি অন্যতম কৌশল।’
তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রতিযোগিতামূলক হলে উৎপাদন ব্যয় অনেক কমে আসত। বিভিন্ন অযৌক্তিক ব্যয় কমানো গেলে বছরে এ খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব এটি ২০২২ সালে আমরা সরকারকে হিসাব করে দেখিয়েছিলাম। এ খাতে বিপুল পরিমাণ যে ঘাটতি দেখানো হচ্ছে, তা থাকত না, বরং উদ্বৃত্ত অর্থ থাকত। বেসরকারি খাতের ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুতের দাম এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রথম তিন বা পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের বিনিয়োগ ব্যয় উঠে গেছে। পরে এ মেয়াদ বৃদ্ধি করে টাকা দেওয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইন অনুযায়ী, একটা লুণ্ঠন ব্যয়।’
ক্যাপাসিটি চার্জ ১ লাখ কোটিরও ওপরে
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন মেয়াদে গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৩টি আইপিপি (স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী) ও ৩০টি রেন্টাল (ভাড়ায় চালিত) বিদ্যুৎকেন্দ্রকে প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সামিট গ্রুপ। কোম্পানিটি ৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভাড়া পেয়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল সাত কেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ইউনাইটেড গ্রুপ ছয়টি কেন্দ্রের বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে ৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।
খুলনা গেজেট/এইচ