বিদায়ী বছরে যশোরে কলেজ ও স্কুলছাত্র, ইজিবাইক চালক, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ চাঞ্চল্যকর ১২টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সদর উপজেলা এলাকায় এসব হত্যার সাতটির তদন্ত কার্যক্রমে অগ্রগতি হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটির হত্যা রহস্য উন্মোচিত করতে পেরেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
এছাড়া পাঁচটি খুনের আসামি শনাক্ত হলেও তাদের অনেকে রয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। এসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম হতাশাব্যঞ্জক বলে ভূক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে। স্বামী, সন্তান ও ভাইহারা এসব পরিবারের সদস্যরা হত্যাকারীদের দ্রুত আটকে সরকারের উচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
সূত্র জানায়, গত ১৯ ডিসেম্বর দুপুরে যশোরের শংকরপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সাব্বির হোসেন (৩০) নামে এক চা দোকানীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এসময় তার পরিচিত আকাশ, স্বাধীনসহ ৩ জন প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে নিয়ে যায়। পরে তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এ হত্যাকান্ডের সব আসামিই চিহ্নিত। কিন্তু তবুও তারা আটক আজো আটক হয়নি।
১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরতলীর বকচর হুঁশতলা কবরস্থানপাড়ার মৃত লিটু সরদারের ছেলে রাকিব সরদারকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। বকচর মোড়ে একটি ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করা রাকিব এদিন সন্ধ্যায় মাঠপাড়ার শহিদুল ইসলামের দোকানে চটপটি খেতে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ওই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার অধিকাংশ আসামি র্যাব-৬ যশোর ক্যাম্পের সদস্যরা আটক করে।
১২ ডিসেম্বর যশোরে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয় ইজিবাইক চালক আলামিন হোসেন (২২)। দুর্বৃত্তরা এদিন রাতে তার ইজিবাইক ভাড়া করে নিয়ে গলায় মাফলার পেচিয়ে হত্যার পর গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে। এ হত্যা মামলার আসাসিরা আজো ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে।
৫ নভেম্বর দিনে-দুপুরে যশোর শহরের ধর্মতলায় রং মিস্ত্রি আবু কালাম (৪২) খুন হয়। পূর্ব শত্রতার জের ধরে প্রতিপক্ষরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। প্রকাশ্যে এ ঘটনা গত দেড় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও হত্যাকারীরা আজো আটক হয়নি। কালাম হত্যায় কোতোয়ালি থানায় মামলা হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তার নিরবতায় আসামিরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গত ১৭ নভেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় বকচর এলাকার নারায়ন চন্দ্র ঘোষের চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় আব্দুল হামিদের ছেলে সাবেক তাঁতীলীগ নেতা কাঁকনকে। হত্যার ঘটনায় পরিবারের পক্ষে বলা হয়, একদল সন্ত্রাসী তাকে ছুরি মেরে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলা হয়। তবে হত্যাকারী কাউকে আটক বা শনাক্ত করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
যশোরের আলোচিত সুলতানপুর গ্রামের ইজিবাইক চালক আব্দুল্লাহ খুনের দ্বায় স্বীকার করেছে আটককৃতরা। আটক আরিফ হোসেন বুকে ও গলায় ছুরিকাঘাত করে। হাসিবুর রহমান টেনে হিঁচড়ে মাঠে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করে বলে ১১ নভেম্বর থানা পুলিশ ও আদালতে জবাদবন্দী দেয়। ১০ নভেম্বর কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত আসামি করে মামলার পর পুলিশি অভিযানে আটক হয় ওই তিন জন। গত ৯ নভেম্বর রাতে শহরতলীর সুলতানপুরের মুজাদ্দুজ্জামানের ছেলে কলেজছাত্র ও ইজিবাইক চালক আব্দুল্লাহকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর ইজিবাইকটি নিয়ে চলে যায় খুনীরা।
যশোরের শহরতলী বোলপুরের আব্দুল মালেকের ছেলে সিএনজি চালক রাশেদ আহমেদকে (২৮) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারে বাধা দেয়ায় একই গ্রামের সুদখোর খোকনের ছেলে আলোচিত মাদক কারবারী মনিরুল ইসলাম ও তার সহযোগিরা এ হত্যাকান্ড ঘটায়। এ ঘটনায় নিহতের বোন রিক্তা বেগম থানায় মামলা করলে পুলিশ প্রধান আসামি মনিরুলের বাবাকে আটক করতে সক্ষম হয়। আর মনিরুল পলাতক রয়েছে। আত্মগোপনে থেকে নানা হুমকি দিচ্ছে বাদী ও ভুক্তভোগী পরিবারকে।
গত ২২ জুলাই রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত সাড়ে ১০টার মধ্যে যশোর শহরের শংকরপুর ছোটনের মোড় এলাকায় নুরুন্নবীর গলিতে শাওনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। ২৩ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় বাবা আব্দুল হালিম শেখ ৮ জনকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ শাওন (২৫) হত্যা রহস্য উদঘাটনসহ জড়িত ৩ জনকে আটক করে।
গত ৯ এপ্রিল যশোরের বসুন্দিয়া মীরপাড়ার সৈয়দ সরোয়ার হোসেন (৪৮) খুন হন তারই ছেলে নয়ন হেসেনের (২৫) হাতে। ওইদিন রাতে সৈয়দ সরোয়ার হোসেন দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন। এরপর তার সাথে স্ত্রী হাসিনা বেগমের একটি মেয়েলি ঘটনা নিয়ে গোলযোগ হয়। সরোয়ার হোসেন উত্তপ্ত কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাসিনাকে বেদম মারপিট করেন। এ সময় তাদের ছেলে নয়ন হোসেন ঘুমিয়ে ছিল। হাসিনা বেগম ঘুম থেকে ডেকে ছেলেকে মারপিটের বিষয়টি জানালে বাক-বিতন্ডায় লিপ্ত হয়ে পিটিয়ে হত্যা করে বাবাকে।
গত ২১ মার্চ সন্ধ্যায় চিহ্নিত একটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র যশোরের এনায়েতপুরে হাফিজুর রহমানের ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে (১৬) খুন করে। পূর্ব শত্রুতা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে এ খুন হয়। হাশিমপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র রাকিবুল ইসলামকে গেম খেলা সংক্রান্ত ঘটনায় তার পরিচিত সোহান এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। একদিন পরে ২২ মার্চ সোহানকে আটক করে পুলিশ।
৯ মার্চ রাতে যশোরের খোলাডাঙ্গায় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে খুন হন সতীঘাটা কামালপুরের বাচ্চু গাজী (৩৫)। খুনের কারণ সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ। যাত্রী সেজে রিকসা ভাড়ায় নিয়ে চালককে হত্যা চেষ্টার সময় উল্টো নিজের ছুিরতেই খুন হয় বাচ্চু। ছিনতাইকারী বাচ্চুর ছুরি কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে রিকসা চালক। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য জানিয়েছেন রিকসা চালক মোবারককাটির আলমগীর হোসেন। ওই ঘটনায় আরো কয়েকজন আটক হয়। ১০ মার্চ সকাল সাড়ে ১১ টায় খোলাডাঙ্গা এলাকার আশরাফ আলীর ধানক্ষেত থেকে তার লাশ উদ্ধার ও ঘটনাস্থল থেকে একটি চাকু উদ্ধারের ক্লু নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১ টায় যশোরের পুরাতন কসবা চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এমএম কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাসের বিপরীতে কাজীপাড়ার মৃত শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে কোরবান আলী পচাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চাঁদাবাজি সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের জের ধরে এ হত্যাকান্ড ঘটে। এ ঘটনায় খোলাডাঙ্গার সিরাজুল ইসলাম চুন্টুর ছেলে হত্যার নায়ক রোকন হাসান রনিকে (২৮) বগুড়া থেকে আটক করে যশোর ডিবি পুলিশ। একই সাথে খুনে ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রটিও উদ্ধার হয়। এরপর পুলিশ ১টি পালসার মটরসাইকেলসহ খোলাডাঙ্গার জন বিশ্বাসের ছেলে রিচার্ড বিশ্বাসকে আটক করে। রিচার্ড বিশ্বাস আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। কিন্তু অন্যান্য আসামিরা পলাতক রয়েছে।
এদিকে, বছরের আলোচিত ১২টি হত্যাকান্ডের সাতটির রহস্য পুলিশ উদঘাটন করতে পারলেও বাকি পাঁচটি রয়েছে অন্ধকারে। চাঞ্চল্যকর সাব্বির, কাঁকন, রাশেদ আবু কালাম ও আলামিন হত্যাকারীরা আজো রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যা নিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তাদের অভিযোগ হত্যাকারীরা রাজনৈতিক শেল্টারে থেকে স্বাভাবিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আটকে পুলিশি অভিযান ও তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেই বলে ভূক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন।
যশোরে গেল এক বছরে ঘটে যাওয়া এসব চাঞ্চল্যকর মামলার ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, মামলাগুলোর যথাযথ তদন্ত হয়েছে এবং কয়েকটি চলামন রয়েছে। অধিকাংশ হত্যা রহস্য উন্মোচন ও আসামি আটক করা হয়েছে। অবশ্য কয়েকটি হত্যা মামলার আসামিরা আত্মগোপনে আছে। সোর্স লাগিয়ে আটকের চেষ্টা চলছে। আর অনেক মামলার আসামি অজ্ঞাত। ওই মামলাগুলো তদন্তে সময় লাগবে। সেসব ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। থানা পুলিশ ছাড়াও চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো র্যাব-৬ যশোর ক্যাম্পের সদস্যরা, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই সহযোগিতা করেছে। চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডে জড়িত পলাতকদের আটকে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
খুলনা গেজেট/ এস আই