খুলনা, বাংলাদেশ | ২৩ আশ্বিন, ১৪৩১ | ৮ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  সুন্দরবনের বাঘশুমারির চূড়ান্ত ফল ঘোষণা আজ

বিদায়ী বছরে যশোরের চার রাজনীতিকের বিদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

যশোরের রাজনৈতিক অঙ্গনে ২০২১ সালে ছিল শোকের ছায়া। এ বছর যশোর হারায় চার রাজনীতিককে। এদের একজন বর্ণাঢ্য রাজনীতিক খালেদুর রহমান টিটো। অন্যরা হচ্ছেন, সাবেক মন্ত্রী মুফতি ওয়াক্কাস, সাবেক এমপি মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন ও অগ্নিকন্যা খ্যাত নেত্রী নুরজাহান ইসলাম নীরা।

খালেদুর রহমান টিটো : বছরের প্রথম মাসেই যশোরবাসীকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সাবেক মন্ত্রী খালেদুর রহমান টিটো। ১০ জানুয়ারি দুপুরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৪৫ সালের পহেলা মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রণ করেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী টিটো রাজনীতির বাইরেও যশোরের সামাজিক, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। পরিশেষে আপামর জনতার নেতা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।

এরশাদ সরকারের শেষ দিকে শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রীর পদ পাওয়া এ রাজনীতিবিদ তার রাজনৈতিক জীবনে অনেক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ইপিসিপি (এমএল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ), গণতান্ত্রিক পার্টি, জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার পদার্পণ ঘটে।

১৯৬৩ সালে যশোর সরকারি এমএম কলেজে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে রাজনীতিতে খড়ি হয় খালেদুর রহমান টিটোর। পরে বাম ধারার শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৪ সাল থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী-ন্যাপ) করা এ নেতা ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ন্যাপের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। পরে ১৯৮১ সালে ‘গণতান্ত্রিক পার্টি’ গঠিত হলে তিনি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হন। ১৯৮৪ সালে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন খালেদুর রহমান টিটো। পরে ৮৬ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকও হন তিনি।

এর আগে বিএনপিতে যোগ দিলেও সদর আসনে দল তাকে প্রার্থী না করায় তিনি বিএনপির রাজনীতি ছাড়েন। ১৯৯০ সালের মে মাসে এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টিটো। ১৯৯১ সালের পর জাতীয় পার্টি যখন বেকায়দায়, তখন টিটোকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর দল ত্যাগ করে আবার বিএনপিতে যোগ দেন টিটো। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে ফের দল ছাড়েন তিনি। ২০০৬ সালে খালেদুর রহমান টিটো আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ২০০৮ সালে নৌকার প্রার্থী হিসেবে যশোর সদর আসনে বাল্যবন্ধু সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মুফতি ওয়াক্কাস : এ বছর চিরবিদায় নেন যশোরের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও শায়খুল হাদিস মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। ২০২১ সালের ৩১ মার্চ ৭৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। ১৯৫২ সালের পহেলা নভেম্বর যশোরের মণিরামপুর উপজেলার বিজয়রামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ওয়াক্কাস।

মুফতি ওয়াক্কাস একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে হুইপ ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। মুফতি ওয়াক্কাস ১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মণিরামপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওইসময় জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে প্রথমে জাতীয় সংসদের হুইপ ও পরে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোট হলে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আরও একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন।
সরকার স্বীকৃত কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কো-চেয়ারম্যান ছিলেন মুফতি ওয়াক্কাস। তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সিনিয়র সহসভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। অবিভক্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরশাদের পতন হলে তিনি যোগ দেন জমিয়েত উলামায় ইসলামে। এছাড়াও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। বরেণ্য এই ব্যক্তির মৃত্যুতে যশোরের আলেম সমাজ যেমন তাদের অভিভাবককে হারায়, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গণ হারায় এক বরেণ্য নেতাকে।

মাওলানা সাখাওয়াত : ২০২১ সালে মারা যান যশোরের আরেক জনপ্রতিনিধি যশোর-৬ আসনের সাবেক এমপি মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন। ১১ ডিসেম্বর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মাওলানা সাখাওয়াত রাজনৈতিক জীবনে জামায়াত, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯১ সালে জামায়াতের মনোনয়নে যশোর-৬ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মাওলানা সাখাওয়াত। এরপর ১৯৯৫ সালে বিএনপিতে যোগদানের পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত এমপি হয়েছিলেন এবং একই সালের ১২ জুন আবারও সংসদ নির্বাচন হলে পরাজিত হন তিনি।

২০০১ সালে চারদলীয় জোটের মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রার্থী হন মাওলানা সাখাওয়াত। ওই নির্বাচনে মাত্র একশ’ ৬৪ ভোটে নৌকার প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। এরপর তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য হয়ে ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক এই এমপিকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ২০১৫ সালে আটকের পর কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি।

নুরজাহান ইসলাম নীরা : ২০২১ সালের ৩ জুন বছরের মাঝামাঝি সময় না ফেরার দেশে পাড়ি জমান যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নুরজাহান ইসলাম নীরা। টানা ৪১ বছর রাজনীতির কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে যশোরে তিনি অগ্নিকণ্যা হিসেবে পরিচিত। ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন নীরা। এর আগে ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৮০ সালে যশোর সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি তার। এরপর জেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। ৮০’র দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যশোরে তার নেতৃত্বে মিছিল, মিটিং ও বিক্ষোভে রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছে। তৎকালীন সময়ের মেয়েদের বাইরে বের হওয়া যেখানে দুঃসাধ্য, সেখানে নীরা তার নেতৃত্বের গুণে যশোরের রাজপথে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর স্বৈরাচারী শাসকের পতনের আন্দোলনে যশোরের রাজপথে অনন্য ভূমিকা রাখা এ নেত্রী অনেক বাঘা প্রার্থীকে পরাজিত করে যশোর পৌরসভায় বিপুল ভোটে ওয়ার্ড কমিশনার হন।

খুলনা গেজেট/ টি আই

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!