আজ হতে অর্ধ শতাব্দীরও কিছু সময় আগে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালি জনতার নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অত্যাচারী পাকিস্তানি স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। মূলত ১৯৪৭ সাল হতে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক সকল দিক হতে বঞ্চনার শিকার হওয়া এবং মাতৃভাষা বাংলা ও বাঙালির স্বতন্ত্র সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের নজিরহীন নিপীড়নমূলক আচরণই বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। পরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধন শুরু করলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষেরও বেশি প্রাণ এবং দুই লক্ষেরও বেশি নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালির বহুলাকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ও বিজয়।
বর্তমানে বিশ্বে জাতিসংঘের স্বাধীন সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩ হলেও, তাদের মধ্যে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে খুবই অল্পসংখ্যক দেশ। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ইরিত্রিয়া, আলজেরিয়া, হাইতি, চিলি, বলিভিয়া, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস হতে দেখা যায়, ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব ব্যতীত করারোপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধে পর্যবসিত হয়। ১৭৭৬ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত প্রায় সাত বছর স্থায়ী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বাধীনতাযুদ্ধ।
আমেরিকা মহাদেশের আরেক দেশ হাইতিকে স্বাধীন হবার জন্য লড়াই করতে হয় স্পেনীয় ও ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে। স্পেনীয়দের হটাতে না পারলেও, ১৭৯১ সাল থেকে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতাযুদ্ধ করার পর ১৮০৪ সালে দেশটি ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন হতে মুক্তি লাভ করে। লাতিন আমেরিকার অপর দুই দেশ চিলি ও বলিভিয়াও প্রায় ষোল বছর স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
অপরদিকে ১৯৬১ সালে ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া মুক্ত হওয়ার পরপরই স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু করে ইরিত্রিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। পরে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ইথিওপিয়া ইরিত্রিয়াকে পৃথক ফেডারেশন হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইথিওপিয়া ইরিত্রিয়াকে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করলে শুরু হয় ত্রিশ বছর মেয়াদি ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধ। পরে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে ইরিত্রিয়া। আবার উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়াকেও সুদীর্ঘ আট বছর লড়াই করতে হয় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল থেকে মুক্তিলাভের জন্য।
কিন্তু এসব দেশের বহু বছর ধরে চলা স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপরীতে মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করেই বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে শুধু এদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের জন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণের এই ওতপ্রোত সম্পৃক্ততার ফলেই পাকিস্তানি বাহিনী স্বল্প সময়ের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের জনসম্পৃক্ততা অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাই বাংলার মানুষের এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অসীম আকাঙ্ক্ষা ও আবেগকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশ সরকার পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভের জন্য ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি।
বিজয় দিবস বাংলাদেশের একটি মহিমান্বিত জাতীয় দিন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের স্মরণ করার এক সোনালি দিন। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যাঁরা এত বড় ত্যাগ স্বীকার করলেন তাঁদেরকে কেন বছরের একটি বা গুটিকয়েক জাতীয় দিনে শুধু স্মরণ করতে হবে? কেন তাঁদের রক্তাপ্লুত গল্পগাঁথা থেকে আমরা শিক্ষাগ্রহণ করে দেশের সার্বিক কল্যাণে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হবো না? এসব প্রশ্ন আসলেই গভীর ভাবনার বিষয়।
বিজয়লাভের অর্ধ শতাব্দী পরে আমরা আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি, বিশ্বের অনেক জাতিই সে অবস্থানে এসে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি—এটা সত্য। তবু এরপরও আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আমাদের জাতীয় জীবনে আমাদের স্বাধীনচেতা জাতির আত্মত্যাগী সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি রোমন্থন করার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।