এক দশক আগে বনানীর কড়াইল বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহকারী দুলাল সরদার বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। তাঁর স্ত্রী নুর বানু ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই ব্যবসায়ী মোমিন বক্স গুম হন। চার দিন পর ১২ জুলাই কালশী ব্রিজের পাশে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নার্গিস আক্তার বাদী হয়ে ১৬ জুলাই মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। এখনো এই দুটি মামলার তদন্ত চলমান। ভুক্তভোগী দুই পরিবারের কেউ মামলার সর্বশেষ কী অবস্থা সেই খোঁজও রাখেননি। শুধু এই দুটি মামলা নয়, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলার বিচার নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের মধ্যে অনীহা কাজ করছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, দুটি কারণে বিচার নিয়ে অনীহা দেখা দেয়। একটি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা এবং আরেকটি ধৈর্য, শক্তি ও সাহস। এর মধ্যে শক্তি হচ্ছে আর্থিক সক্ষমতা। আইন কর্মকর্তাকে টাকা না দিলে ভালোভাবে সাক্ষ্য নেন না, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।
কিন্তু কেউ এটা স্বীকার করেন না। রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের কারণে সাক্ষী টিকে থাকতে পারেন না। সাহস না থাকায় ক্ষমতার কাছে হার মানতে বাধ্য হচ্ছেন। এক পর্যায়ে বিচার নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের ধৈর্য থাকে না। তারা ভাবতে থাকে, এই বিচার দিয়ে কী হবে?
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে আইনের প্রক্রিয়া জটিল।
সাধারণ মানুষ আইনের বিষয়ে অজ্ঞ। অনেক দেশে বিচারপ্রার্থীদের জন্য কাস্টমার সার্ভিস থাকে, যা আমাদের দেশে নেই। এটার অভাব বোধ করি। কোর্টের তরফ থেকে তথ্যকেন্দ্র থাকা দরকার। এতে ভুক্তভোগী পরিবার মামলার বিষয়ে তথ্য নিতে পারবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ৩৬ লাখ ৮২ হাজার মামলা। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার সংখ্যা সাত লাখ ৩৫ হাজার ৩৬২। দেওয়ানি চার লাখ ২৪ হাজার ৭৪৭ এবং ফৌজদারি মামলা তিন লাখ ১০ হাজার ৬১৫টি। এসব মামলার শুরুতে ভুক্তভোগী পরিবার বা ব্যক্তি বিচার পেতে শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো কার্পণ্য দেখান না। তাঁদের প্রথম চাওয়াই থাকে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় মামলার তদন্ত কার্যক্রমে আসামিদের প্রভাব, মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে বাদীপক্ষকে অন্ধকারে রাখা এবং রাষ্ট্রপক্ষের অসহযোগিতায় হতাশ হয়ে পড়ে ভুক্তভোগী পরিবার। বিচার চাইতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ে। একটা পর্যায়ে তদন্ত শেষে বিচার শুরু হলেও সাক্ষীরা আদালতে হাজির হতে চান না। সন্তোষজনক টাকা না পেলে অনেক সময় আইন কর্মকর্তারাও ভালোভাবে সাক্ষ্য নিতে সহযোগিতা করেন না। আবার আসামিরাও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারকে ভয়ে রাখেন। মামলার বাদীও একসময় কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আদালতে এসে মামলা তদারকির ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এই সুযোগে আসামিরাও জামিনে কারামুক্ত হন। আসামিপক্ষ বারবার সময় চেয়ে মামলার বিচারকাজ প্রলম্বিত করে।
গত এক যুগে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। একই অবস্থায় গত ১০ বছর ধরে ইসলামী বক্তা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম আটকে রয়েছে। গত এক দশকেও রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। ৯ বছরেও ব্লগার নাজিম উদ্দীন ও ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়নি। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে গোপালগঞ্জের শ্রমিক নেতা বাসু হত্যামামলা ঝুলে রয়েছে। গত আট বছরেও মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। এ ছাড়া সদরঘাটে মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবে নিহত ৩৪, চূড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ড, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধসের মামলার বিচারকাজ ঝুলে আছে।
দুলাল সরদার হত্যা মামলার বাদী নূর বানুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এ ছাড়া মোমিন হত্যা মামলার বাদী নার্গিসকে কল দিলেও মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে ফোন কেটে দেন। মিল্কী হত্যা মামলার বাদী রাশেদুল হক খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে নুরুল ইসলাম ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, ‘বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মামলার এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। আমরা হতাশ ও ব্যথিত।’
বাসু হত্যা মামলার বাদী জাসু শেখ বলেন, ‘ভাই হত্যার বিচার নিয়ে শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেছি। মামলা তুলে নিতে অনেক হুমকি দেওয়া হয়েছে। বিচার পাব কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি।’
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, বাংলাদেশে পরিবর্তন এসেছে। ঝুলে থাকা পুরনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। সাক্ষী না পাওয়ায় অনেক মামলার নিষ্পত্তি হয় না। তদন্তে অনেক সময় চলে যায়। যে কারণে বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হয়ে যান। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে নতুন আইন করা উচিত। পাশাপাশি প্রতিটি আদালতের তথ্য ডিজিটাইজ করা উচিত। এটি হলে বিচারপ্রার্থীরা মামলার তথ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। বিগত সরকারের আমলে বিচারব্যবস্থায় নানা প্রতিকূলতা ছিল। নতুন বাংলাদেশে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এখন বিচার নিয়ে কোনো হতাশা, অনীহা থাকবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে চলবে। আগের সরকার নিজেদের লোকদের (অপরাধী) বিচার করতে দেয়নি।
খুলনা গেজেট/এইচ