খুলনা, বাংলাদেশ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ২০১৮’র রাতের ভোটের দায় স্বীকার করে সাবেক সিইসি নুরুল হুদার জবানবন্দি
  শেখ হাসিনাসহ তিনজনের পক্ষে অভিযোগ গঠনে সময় আবেদন, পরবর্তী শুনানি ৭ জুলাই

বাবুর্চি কালু, কনস্টেবলের চাকরি ও পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট

এ এম কামরুল ইসলাম

বরিশাল পুলিশ ক্লাবের বাবুর্চি কালু। ছোটখাটো মানুষ। দীর্ঘদিন পুলিশ ক্লাবের বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতে করতে তখন বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছে; কিন্তু পুলিশ ক্লাবের মায়া ছাড়তে পারছিলো না। তার ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিরা তাকে বাইরে থাকতে দিতে চায় না। এদিকে আমরাও কালুকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম না। অবসর সময়ে কালুর কাছে শত শত পুলিশ অফিসারের গল্প শুনতে বেশ ভাল লাগতো। সারাজীবন সে পুলিশ ক্লাবে থেকে পুলিশ অফিসারদের রান্না করে খাইয়েছে৷ মাঝে মাঝে সেসব অফিসাররা বিভিন্ন কাজে বরিশালে গেলে পুলিশ ক্লাবে কালুকে দেখতে যেতেন। কেউ কেউ কালুর জন্য উপহার নিয়ে গেলে বা কিছু বকশিস দিলে কালু মহানন্দে গ্রহণ করতো। কালুর মুখে কোনদিন কেউ কোন পুলিশ অফিসারের বদনাম শোনেনি। আমরা সকলেই কালুকে মনেপ্রাণে ভালবাসতাম।

একদিনের কথা মনে পড়ে। বিশেষ কাজে সেদিন বাইরে থাকায় আমার দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। ফিরতে ফিরতে বিকাল হয়ে গিয়েছিল। দ্রুত খাবার খেয়ে আবার বাইরে যেতে হবে। সাথে একজন মেহমান ছিল। মেহমান নিয়ে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি কোন খাবার নেই। কালুকে কয়েকবার ডাকার পর সে অনেক দেরিতে হাজির হলো। আমি বললাম,

‘এত সময় কোথায় ছিলি? জলদি আমাদের খাবার দে। আমরা এখনই বাইরে যাবো।’

‘খাবার কোনহানতে দিমু। সব শেষ হইয়ে গেছে। মনোয়ার স্যার ও মোতালেব স্যার আজ আরো বেশি খাইছে। আমি আগেই কইছিলাম তাগোরে এট্টু টাহা বারাইয়া দিতে কন। হেরা দুইজনে বেশি বেশি খায়। আপনের খাওনের জন্যি আমার রান্দন লাগে না। হগ্গলের খাওনের লগে আপনের খাওন হইয়ে যায়।’

আমার পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা। এখনই খেয়ে আবার বাইরে যেতে হবে। মেহমানের সামনে অপমান! সবকিছু মিলে আমি ভীষণ রাগান্বিত হয়ে কালুকে মারলাম এক চড়। কালু নীরবে বসে পড়লো। আমিও মারাত্মক ভুলের জন্য মর্মাহত হলাম। মনের দুঃখে দ্রুত বাইরে চলে গেলাম। রাতে ক্লাবে ফিরে কালুকে জড়িয়ে ধরে বার বার ক্ষমা চাইলাম। সেই রাতে বা কালুর জীবদ্দশায় আমাকে মন থেকে ক্ষমা করেছিল কিনা তা জানিনা। তবে চরম অপরাধবোধ আজও আমাকে তাড়া করে। কালু অনেক আগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আজ আবারও সবাইকে অবহিত করে কালুর কাছে নিঃশর্তে ক্ষমা চাই। আল্লাহ যেন আমার এই মহাপাপ ক্ষমা করেন!

পুলিশ ক্লাব ছেড়ে কালু বিদায় নেবে। আমরা কেউ সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না। কালুর মনও পুলিশ ক্লাবের মায়া কাটাতে পারছিলো না। ইতিমধ্যে কালু নিজেই কয়েকজন ছেলেকে এনে তার সাথে কাজ শিখানোর চেষ্টা করেছিল; কিন্তু কেউ স্থায়ী হলো না। শেষ পর্যন্ত মোশাররফ নামের ১৮/১৯ বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে এলো। মোশাররফ ছিল কালুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মোশাররফের কাজে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট হওয়ার পর কালু তার দীর্ঘদিনের পেশা ছেড়ে মোশাররফের উপর দায়িত্ব অর্পণ করে চোখের পানি মুছতে মুছতে বিদায় নিলো। পুলিশ ক্লাবে অবস্থানরত আমরা সকলেই খুব কষ্ট পেলাম।

সুঠাম দেহের অধিকারী মোশাররফ কিছুদিনের মধ্যে তার চটপটে স্বভাবের জন্য সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলো। কালুর আত্মীয় হওয়ায় আমার পাপ মোচনের আশায় আমি তাকে একটু বেশি আদর করতাম। সেও আমাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে মনের সব কথা শেয়ার করতো।

একদিন মোশাররফ আমাকে ভয়ে ভয়ে বললো, ‘স্যার, হুনছি পুলিশে লোক নিবো। মোরে যদি এট্টু পুলিশের চাকরি দিতেন। তাইলে জনম ভর মনে হরতাম।’

‘তোর শরীরের মাপ, বয়স ঠিক আছে? লেখাপড়া কোন পর্যন্ত করেছিস্?’

‘স্যার, মুইতো হাইস্কুলে গেছেলাম। পাশ হরতে পারিনি।’

‘আচ্ছা, দেখা যাক। তুই দিনের দিন লাইনে দাঁড়াবি। আমরা চেষ্টা করবো।’

মোশাররফ খুশি হয়ে পুলিশ ক্লাবে অবস্থানরত সকল অফিসারের কাছে একই আবেদন করলো। তখন পুলিশ কনস্টেবলের চাকরির ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগতো অষ্টম শ্রেণি পাশ। আমরা সবাই মিলে ওর অষ্টম শ্রেণি পাশ সার্টিফিকেট যোগাড় করার পর এসপি সাহেবের কাছে অনুরোধ করে পুলিশের চাকরীতে ঢুকিয়ে দিলাম।

বেশ কয়েকবছর চলে গেল। আমিও বরিশাল জেলা থেকে বদলি হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাকরি করি। হঠাৎ একদিন মোশাররফ এসে আমাকে দাড়াম দিয়ে স্যালুট দিয়ে বললো,

‘স্যার আমি মোশাররফ। আমি হাবিলদার হইছি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এমটি ( মোটর ট্রান্সপোর্ট) সেকশনে আমার পোস্টিং।’

আমি ভীষণ খুশি হলাম। তাকে আমার বাসায় যাবার দাওয়াত দিলাম। তারপর থেকে সে নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে শুরু করে। আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে এবং আমার বাসায় যাতায়াত করতে থাকে। আমার পরিবারের সাথে তার পরিবারের সেতু বন্ধন সৃষ্টি করতে একদিন সে আমার স্ত্রী -সন্তানদের তার বাসায় দাওয়াত দেয়। আমরা সবাই তার বাসায় গিয়ে দাওয়াত খেয়ে সারাদিন হৈচৈ করি। তারা সবাই মহা খুশি হয়। একদিন আমার ব্যক্তিগত গাড়িটি বাসা থেকে জোর করে নিয়ে গিয়ে রাজারবাগ এমটি সেকশনের মিস্ত্রি দিয়ে বিনামূল্যে মেরামত করে দেয়। এভাবে আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হতে থাকে।

ইতিমধ্যে মোশাররফ তার দক্ষতাবলে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষ ড্রাইভার কাম মোটর মেকানিক হয়ে গেছে। এখন তার ইচ্ছে হলো একবার জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কাজ করার। তাই আমার কাছে বার বার ধর্ণা দিতে লাগলো। আমিও মনেপ্রাণে চেষ্টা করতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত সে ড্রাইভার হিসেবে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে চান্স পেয়ে গেল। এক বছর জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে বেশকিছু টাকা পেয়ে দেশে ফেরার পর ঢাকায় একটু জায়গা কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং যাত্রাবাড়ি এলাকায় সুযোগমতো তিন কাঠা জায়গা কিনলো। বরিশালের গ্রামের বাড়িতেও ঘর বানালো।

সুদক্ষ পুলিশ হাবিলদার মোশাররফ একদিন আমাকে জানালো, তার মেয়ে ‘মৌ’ আইএ পাশ করেছে। একটা ছেলে তাকে পছন্দ করে। ছেলেদের ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি আছে। বিয়ের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করতে আমাকে তার বাসায় যেতে অনুরোধ করলো। আমি তার অনুরোধে বাসায় হাজির হয়ে পাত্রপক্ষ ও ছেলের সাথে আলাপ আলোচনা করলাম। ছেলেটার মতি গতি বিশেষ ভাল মনে হলো না। গার্জিয়ানদের কথা বার্তায় একটু অর্থলোভী ভাব দেখা গেল। আমি ও মোশাররফ বিয়েতে রাজি হলাম না। কিন্তু মোশাররফের স্ত্রী, শাশুড়ী ও মেয়ে নিজেই সেই বিয়ের পক্ষে ছিল। শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে গেল। কিছুদিন যাবার পর তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হলো এবং শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো।

একদিন মোশাররফ আমার কাছে এসে ঘটনা খুলে বলার পর আমি আবার তার বাসায় গেলাম। তার মেয়ে মৌ’কে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে আবার পড়াশোনা করার পরামর্শ দিলাম। এবার সে আমার পরামর্শ শুনলো এবং বিএ অনার্স পড়তে শুরু করলো। মোটামুটি ভালভাবে পড়াশোনা চলতে থাকলো।

হঠাৎ মোশাররফ আমার কাছে নতুন খবর নিয়ে হাজির হলো। মৌ’কে একটা ছেলে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সে তার বাবা-মাসহ আমেরিকা প্রবাসী। ডিভি লটারি পেয়ে দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকে। ছেলেটা বিয়ের জন্য দেশে এসেছিল। তার অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ে করে মৌ’কে আমেরিকা নিয়ে যেতে চায়। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। আমি মোশাররফের কথা শুনে তাকে সরাসরি কোন মতামত না দিয়ে ভালভাবে খোঁজ খবর নিতে পরামর্শ দিলাম। কিন্তু মোশাররফ নাছোড়বান্দা। আমাকে তার সাথে নিয়েই ছাড়লো।

বিয়ের আলাপ আলোচনা চলতে থাকলো। কয়েকদিন দেখাশোনার পর বিয়ে হয়ে গেল।

মৌ’কে আমেরিকা নিতে আইনগত জটিলতা পার করতে হবে। জামাই আমেরিকা চলে গেল। মৌ তার পড়াশোনা চালাতে থাকলো। মোশাররফ সবকথা আমাকে নিয়মিত জানাতো। তবে আমার সাথে মোশাররফের পরিবারের দেখা হয়েছে মাত্র তিন চার বার। তবুও সে আমাকে সবকথা জানিয়ে তৃপ্তি পেতো। আমিও তার সবকথা মন দিয়ে শুনে যতটা সম্ভব পরামর্শ দিতাম।

আমেরিকা থেকে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে একদিন মৌ’কে তার স্বামী আমেরিকায় নিয়ে গেল। তখনও মোশাররফ আমাকে সময় সময় সবকথা জানিয়েছিল। হঠাৎ একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে মোশাররফ জানালো তার পুরা পরিবারের আমেরিকার ভিসা হয়ে গেছে। সে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে পুরা পরিবারসহ একদিন আমেরিকা চলে গেল। সেখানে ছয় মাস থেকে আবার দেশে এসে চাকরিতে যোগদান করলো। কিছুদিন পর করোনার কারণে তার স্ত্রী ও ছেলে দেশে চলে এসেছে। বিশ্ব করোনা পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে তারা আমেরিকায় যাওয়া আসার মধ্যে বাকি জীবন কাটাবে। এখনও আমার সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে।

মোশাররফ বা কালুর কথা লিখতে মূলতঃ আজকে শুরু করিনি। বরিশাল জেলার নতুন চাকরি পাওয়া একজন পুলিশ কনস্টেবলের চাকরির ভেরিফিকেশন নিয়ে লেখাই মূল উদ্দেশ্য। তার নাম আমার মনে নেই। গ্রামের বাড়ি ছিল কীর্তনখোলা নদীর ওপারে কাউয়ার চরে।

আমি একদিন অফিসে বসে আছি। হঠাৎ একটা ছেলে এসে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে আমার সাথে কথা বলার অনুমতি চাইলো। আমি ভাবলাম, এতো অনুমতির কি আছে। তুমি যা বলার বল। কিন্তু সে তেমন কিছু বলে না। শুধু পকেটে হাত দেয় আর বের করে। আমি সামান্য বিরক্ত হয়ে যা বলার বলতে বললাম। এক সময় সে পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো,

‘আমার চাকরি যেন হয় স্যার। আমরা খুব গরিব মানুষ। চাকরিটা না হলে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে টাকা পয়সা খরচ করে, নেতাদের ধরে চাকরিটা পাইছি। আপনি ঠিকমতো রিপোর্ট না দিলে আমার চাকরি হবে না।’

এতক্ষণে আসল কথা বুঝলাম। তাকে খামটা ফেরৎ দিয়ে শান্তভাবে বসতে বললাম। তাকে বুঝাতে চাইলাম যে, পুলিশ ভেরিফিকেশনে কোন টাকা লাগে না। আমি একবার তোমাদের বাড়িতে যাবো, ঠিকানা ও কাগজপত্র যাচাই করে তারপর রিপোর্ট দিবো। তুমি বাড়ি চলে যাও। তুমিতো অবিবাহিত?

এবার ছেলেটা বিমর্ষ হয়ে গেল। তার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। কিন্তু সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে আমাকে খামটা দেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আমি তাকে শত চেষ্টা করেও থামাতে পারছিলাম না। অবশেষে সে বললো, ‘স্যার, আপনাদের একজন আমাকে বলেছে আপনি খুব ভাল মানুষ। আপনি ভাল রিপোর্ট দিলে আমার চাকরি হবে।’

‘আচ্ছা দেবো। এখন তুমি খাম নিয়ে বাড়িতে যাও।’

আমার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তাকে আশ্বস্ত করতে আমি খামটা রেখে দিলাম। সে খুশি মনে বিদায় নিলো।

তারপর কয়েকদিন কাজের ব্যস্ততায় আমি তার বাড়িতে যেতে পারিনি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে এসে সে থানার বারান্দায় ঘুরাঘুরি করতে থাকে। একদিন তার মাকে নিয়ে আমার কাছে হাজির হলো। তার মা আমার জন্য পিঠা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আমি থানায় উপস্থিত সকল ফোর্স নিয়ে পিঠা খেলাম এবং তার মাকে খুশি করতে ঐ দিনই তদন্ত করতে তাদের বাড়িতে গেলাম। বিস্তারিত খোঁজ খবর নিয়ে সবকিছু ঠিক পেলাম। কিন্তু গোপনে এক চৌকিদার জানালো সে বিবাহিত। আমি মহা সংকটে পড়লাম। বিবাহিত হলে কোনক্রমেই পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি হবে না। ছেলেটার বাড়ির অবস্থা দেখে তার চাকরির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হয়নি। এর আগে আমি যা ভেবেছিলাম প্রকৃত অবস্থা তার চেয়েও খারাপ দেখলাম।

থানায় ফিরে আমি অনেক চিন্তা করলাম। বিষয়টি কারো সাথে শেয়ার করা ঠিক হবে কিনা তা ভাবতে লাগলাম এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ছেলেটার বিয়ের কথা গোপন রেখে আমি তার পক্ষে রিপোর্ট দেবো এবং শেষ পর্যন্ত তাই দিলাম। সারদায় ট্রেনিং এর সময় জেনেছিলাম- আমার কয়েকজন ব্যাচমেট চাকরির আগেই বিয়ে করেছিল। তারা পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় সংশ্লিষ্ট অফিসারকে মেনেজ করে রিপোর্ট নিয়ে এখনও চাকরি করছে। একজন ব্যাচমেট এক ওসি সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট তার পক্ষে নিয়েছিল। কারণ চাকরির আগে তার বিরুদ্ধে কয়েকটা মামলা ছিল। ওসি সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করায় তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা গায়েব হয়ে গিয়েছিল, বিয়ের কথাও গোপন রেখেছিল। অতএব এই গরিব ছেলেটার বিয়ের কথা গোপন করে চাকরি হলে পরিবারটা বাঁচবে। তারপর আমার যা হবার তাই হবে!

আল্লাহকে সাক্ষী রেখে রাতেই তার পক্ষে রিপোর্ট দিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে ছেলেটা তার মাকে নিয়ে থানায় এসে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আমার জন্য আরো একটা খাম নিয়ে এলো। এক প্রকার জোর করে সেই খামটা আমাকে ধরিয়ে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ তার বিয়ের খবর আমি জেনে গিয়েছিলাম তা সে বুঝতে পেরেছিল। এক সময় আমি তাকে ও তার মাকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে শান্তভাবে বসতে বললাম। তার মা বসলেও শত চেষ্টায় তাকে বসানো গেল না। তাকে যতই বুঝিয়ে বললাম- রিপোর্ট তার পক্ষে দিয়েছি। বিয়ের কথা গোপন রেখেছি। কোনকিছুই সে বিশ্বাস করলো না। অবশেষে কয়েকদিন আগে আমাকে সে যে খামটি দিয়েছিল সেটা অক্ষত অবস্থায় তাকে ফেরৎ দিলাম। তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পৃথিবীর সবকিছু সে বিশ্বাস করলেও আমার রিপোর্ট তার পক্ষে দিয়েছি সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এক সময় মা ছেলে দু’জনে মিলে আমার পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। আমি মহা ঝামেলায় পড়ে গতরাতে আমার লেখা পুলিশ ভেরিফিকেশান রিপোর্টের কপি দেখালাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওদিকে থানার মুন্সি গোপনে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল। কারণ সে নিজেই তাদেরকে আমার কাছ থেকে কাজ হাসিলের জন্য খাম দিয়ে পাঠিয়েছিল। মুন্সিকে তারা খুব বিশ্বাস করতো। মুন্সি সাহেব গতরাতেই আমার রিপোর্ট হাতে পেয়ে পড়েছিল। সে এসে তাদেরকে বললো, ‘তোমরা এতো চিন্তা করছো কেন। আমি তোমার রিপোর্ট পড়েছি। স্যার সবকিছু তোমার পক্ষে লিখেছেন । আমি আজই ওসি সাহেবের সই করিয়ে এসপি অফিসে পাঠিয়ে দিবো।’

আপাততঃ মুন্সি সাহেবের বদৌলতে আমি নিষ্কৃতি পেলাম। কিন্তু খামটা ফেরৎ দিতে গিয়ে আবার বিপত্তি দেখা দিলো। এবার মুন্সি সাহেবও তাদের পক্ষ সমর্থন করলো। আমি মহা সংকটে পড়লাম। আমার বিবেক বলছিলো- একটা ছেলে পুলিশের চাকরিতে আসার সময় যদি ঘুষ দিতে শুরু করে তাহলে সারা জীবনে ভাল কাজের প্রতি সে কখনও আগ্রহী হবে না। সুতরাং আমি কোনভাবেই এই খাম নেবো না। কিন্তু আমি তখন একেবারে সংখ্যালঘু। কোনভাবে আমি জয়ী হতে না পেরে একটা বুদ্ধি করলাম। মুন্সি সাহেবের হাতে খামটা দিয়ে বললাম- আপনি এই ছেলেকে নিয়ে বিবির পুকুর পাড়ে ‘বুক ভিলা’ লাইব্রেরিতে যান। সেখানে গিয়ে আমার কথা বললে দু’টো বই দিবে। দাম একশো বিশ টাকা। এই খাম থেকে একশো বিশ টাকা বইয়ের দাম দিয়ে বাকী টাকা ছেলেটাকে ফেরৎ দিবেন। বই দু’টো আমি গতকাল প্যাকেট করে রেখে এসেছি।

কিছুক্ষণের ভিতর মুন্সি ও সেই ছেলেটি বই নিয়ে ফিরে এলো। আমার পছন্দের দু’টি বইয়ের একটি সেই নব্য পুলিশ সদস্যের হাতে দিয়ে বললাম- ‘বইটা পড়বে। সারাজীবন সঠিকভাবে চাকরি করবে।’

ছেলেটা হাসিমুখে তার মাকে নিয়ে বিদায় নিলো। আর কোনদিন তার সাথে আমার দেখা হয়নি।

আনন্দ

আমি এই লেখার মাধ্যমে কালুর বিদেহী আত্মার কাছে আর একবার ক্ষমা চাইতে পারলাম।

মোশাররফ ও তার পরিবার দারুণ স্বচ্ছল জীবন যাপন করছে। এজন্য আমি অপরিসীম আনন্দ ও পরিতৃপ্তি অনুভব করি।

পুলিশের চাকরি পাওয়া সেই ছেলেটা হয়তো বড় অফিসার হয়ে এখন তার পরিবার ও স্বজনদের নিয়ে সুখে আছে।

নিজের চাকরির ঝুঁকি নিয়ে সেই পুলিশের পক্ষে রিপোর্ট দেয়ার পরও সেটা নিয়ে আমাকে যে কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি, এ জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।

বেদনা

আমি কেন নিজেকে সংবরণ না করে কালুকে চড় মেরে পাপের কাজটি করেছিলাম। এখন কালু বেঁচে থাকলে তাকে খু্ঁজে বের করে আর একবার ক্ষমা চেয়ে নিতাম। হে আল্লাহ- আবারও তোমার কাছে ক্ষমা চাই। চলবে …

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!