খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

‘বাজে না সাইরেন, নেই তাঁতের ঠক ঠক শব্দ’

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাজে না সাইরেন, নেই তাঁতের ঠক ঠক শব্দ। চারদিক শুনশান। লোকজনের আনাগোনা খুব একটা নেই। নেই কাজ শেষে বাড়ি ফেরার তোড়জোড়। বসবাসের স্থানটিও এখন ধ্বংস স্তুপ। এভাবেই কেটে গেল একটি বছর। এখনও বাজেনি সাইরেন। ভাগ্য ফেরেনি পাটকল চালুর আশায় বুঁক বেধে থাকা শ্রমিকদের। বেকারত্ব এবং মানসিক অশান্তিতে দুর্বিষহ জীবন কাটছে অনেক শ্রমিকের। আর কতদিন, কবে বাজবে পাটকলের সাইরেন, এমন প্রশ্ন শ্রমিকদের। অনেকে পেশা বদলে ভাগ্য ঘোরানোর চেষ্টা করলেও অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা। অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে অনেকের পরিবার। অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে মানুষের সহযোগিতার। তবুও যেন আশা ছাড়েনি পাটকলের এসব শ্রমিকরা। শুনশান পাটকলগুলোতে আবারও বাজবে সাইরেন, সেই অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন তারা।

২০২০ সালের ১ জুলাই খুলনা-যশোর অঞ্চলের নয়টিসহ দেশের ২৫টি পাটকলের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাটকলগুলোর উৎপাদন বন্ধের পর লিজের মাধ্যমে আবারও চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি। কিন্তু লিজের মাধ্যমে পাটকলগুলো আবার কবে চালু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে শ্রমিকরা।

এ অবস্থায় খুলনার খালিশপুর শিল্পাঞ্চল ছেড়ে অনেক পরিবার বিভিন্ন জেলায় গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে মিলের যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত থাকায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর শ্রমিকদের বসবাসের মিল কলোনিগুলো এখন শুনশান মরুভূমি। ঘর-বাড়ি ভেঙে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। গাছগুলোতে ফল ধরে রয়েছে, তবে যারা গাছ লাগিয়েছিল খাবার জন্য আজ তারা সেখানে নেই। সরেজমিনে প্লাটিনাম জুট মিল এবং ক্রিসেন্ট জুট মিল কলোনিতে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।

পাটকল শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, মিল কলোনিতে ছোট থেকে বড় হয়েছি। আজ সেই কলোনির অবস্থা দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারি না। মিল চালু হবে সেই আশায় এখনো রয়েছি।

প্লাটিনাম জুট মিল কলোনি গেটের নিরাপত্তাকর্মী মো. রফিক মিয়া বলেন, কলোনিতে প্রতিদিনই দু-একজন ঘুরতে আসে। তাদের স্মৃতি বিজরিত স্থান দেখতে আসে। অনেকে এসে চোখের পানিও ফেলে।

ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক মাহফুজ হোসেন বলেন, মিলে এখন শুধুই হাহাকার। তবে আমরা কয়েকজন এখানে রয়েছি। কারণ মিল কর্তৃপক্ষ বলেছিল ঘর ছাড়লে টাকা নিতে পারবো। কিন্তু আমি এখনো পাওনা টাকা নেইনি। এখানে জন্ম, এখানেই শৈশব, কৈশর কেটেছে। এখানেই বিয়ে করেছি। এখন ছেলেও ইন্টারে লেখাপড়া করছে। স্মৃতি বিজরিত জায়গা ছেড়ে যেতে চাই না। সবাই গেলেও আমি যাবো না। এখানেই মরতে চাই।

প্লাটিনাম জুট মিল কলোনির ২নং গেট এলাকার ভরাটপুকুর নামক স্থানে বসবাস করেন মিলের স্থায়ী শ্রমিক জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৫)। তিনি এখন শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে পারেন না। অভাবের সংসার টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নেমেছে তার স্ত্রী রেখা বেগম। পরের বাড়িতে কাজ করে যে আয় হয় তাই দিয়ে সংসার চালান তিনি।

জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্লাটিনাম জুট মিলে অবসায়নের পর পাওনা ছিল ৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ টাকা নগদ পেয়েছেন, বাকি টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে পারছেন না। লকডাউনের কারণে গাড়ি বন্ধ। ছেলে ও জামাই গাড়িও চালাতে পারছে না। এক মেয়ে বদলি শ্রমিক ছিল। সেও টাকা পায়নি। এখন আমার আর চলার মতো অবস্থা নেই। ওষুধ কিনতে পারছি না, ঘরও ঠিক করতে পারছি না। সরকার বলেছিল ৬ মাসের মধ্যে মিল আবার পিপিপি এর মাধ্যমে চালাব। আজ পর্যন্ত কোনো খবর নেই। এখন আমরা কি করে খাব? আমাদের একটা পথ আপনারা করে দেবেন। শ্বাসের সমস্যার কারণে কাজ করতে পারি না। আমার স্ত্রী এক জায়গায় কাজ করে সেই টাকা দিয়ে চলছি।

তার স্ত্রী রেখা বেগম বলেন, কখনো চিন্তাও করিনি কারও বাড়িতে কাজ করতে হবে। কিন্তু এখন পরের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। অনেক কষ্টে দিন কাটছে। মেয়ে জোসনা প্লাটিনাম জুট মিলের বদলি শ্রমিক ছিল। কিন্তু মিল বন্ধের এক বছর পার হলেও বদলি শ্রমিকদের ভাগ্যে একটি টাকাও জোটেনি।

তিনি বলেন, কোনো টাকা পায়নি সে। রোজার ঈদে ছেলে-মেয়েদের সেমাই পর্যন্ত কিনে খাওয়াতে পারিনি। সামনে কোরবানি ঈদ। আমরা প্রত্যাশা করছি ঈদের আগে বদলি শ্রমিকদের সকল পাওনা পরিশোধ করে দেবে। একইসঙ্গে মিল চালু করে আমাদের কাজের সুযোগ করে দেবে সরকার।

একই মিলের স্থায়ী শ্রমিক হাফিজুর রহমান বলেন, এখন বেকার। কোনো কাজ নেই। মাঝে মধ্যেই মিলের সামনে আসি। আশায় আছি কবে মিল চালু হবে। যে টাকা পেয়েছিলাম সেটা দিয়ে গরুর বাছুর কিনেছিলাম। কিন্তু গরুর দেখভাল করতে পারি না। এ কারণে বিক্রি করে দিয়েছি। সেই টাকা ভেঙে ভেঙে সংসার চালাচ্ছি। এখন আমাদের যদি আবার কাজ দিতো তাহলে আমরা স্বাভাবিক জীবনটা আবার ফিরে পেতাম।

শুধু জাহাঙ্গীর, জোসনা আর হাফিজুর নয়, তাদের মতো দুর্ভোগে রয়েছেন বন্ধ হয়ে যাওয়া খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের প্রায় ৪১ হাজার শ্রমিক পরিবার।

বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, খুলনার আলীম, ক্রিসেন্ট, ইস্টার্ন, প্লাটিনাম ও স্টার এবং যশোরের কার্পেটিং ও জেজেআই জুট মিলে স্থায়ী শ্রমিক ছিল ১৪ হাজার ৯৮৭ জন। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৪ জন তাদের পাওনা নগদ প্রায় ৪৩ কোটি টাকা এখনও পায়নি। এছাড়া ৯ হাজার ৪৮১ জন শ্রমিক তাদের পাওনা প্রায় ৪৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এখনও পায়নি। শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা নগদ এবং অর্ধেক টাকা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিল বিজেএমসি। এছাড়া এ ৭টি পাটকলের ২১ হাজার ৩৫১ জন বদলি শ্রমিকের পাওনার পরিমাণ ১১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কিন্তু বদলি শ্রমিকদের কেউ এখনও কোনো টাকা পায়নি। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত খালিশপুর জুট মিলের ৪ হাজার ৪৭৪ জন ও দৌলতপুর জুট মিলের ৩৫০ জন শ্রমিক দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন। মিল বন্ধ হওয়ার কারণে তারা কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না।

পাটকলের বদলি শ্রমিক নেতা আবদুর রাজ্জাক বলেন, মিল বন্ধের পর ইজিবাইক চালানো শুরু করি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনে এখন ইজিবাইক চলাচলও বন্ধ। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে।

প্লাটিনাম জুট মিলের প্রকল্প প্রধান মো. মুরাদ হোসেন বলেন, মিলের স্থায়ী শ্রমিক ৩ হাজার ৯৮৩৬ জন। এর মধ্যে মামলা রয়েছে ৩৬ জনের। মামলার কারণে তাদের টাকা ঝুলে রয়েছে। অন্যদের টাকা প্রায় পরিশোধ। ৯৯ শতাংশ স্থায়ী শ্রমিকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিছু বাকি রয়েছে। সেগুলো নামের জটিলতার কারণে। ৬ হাজার ২০০ বদলি শ্রমিক রয়েছে। এরিয়ার টাকার জন্য তাদের তালিকা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে বিজেএমসিতে প্রেরণ করেছি। আশা করছি তারাও টাকা পেয়ে যাবে।

বিজেএমসির এ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ১৭টা মিলে আন্তর্জাতিক টেন্ডার হয়েছে। তার মধ্যে প্লাটিনাম জুট মিলের জন্য আবেদন পড়েনি।

বিজেএমসির সূত্রে জানা যায়, খুলনা অঞ্চলের পাঁচটিসহ সরকারি ১৪টি পাটকল লিজ নিতে ৫১টি আবেদন জমা পড়েছে। বাংলাদেশ জুটমিলস কর্পোরেশনের (বিএজএমসি) হাতে থাকা মোট ২২টি পাটকলের মধ্যে সরকার লিজ দিতে চেয়েছিল ১৭টি, কিন্তু বাকি তিনটির জন্য কোনো আবেদনপত্রই জমা পড়েনি। খুলনা অঞ্চলের পাঁচটির পাটকলের মধ্যে খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলস, ইস্টার্ন জুট মিলস, দৌলতপুর জুট মিলস, যশোরের কার্পেটিং জুট মিলস ও যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ। যে তিনটি পাটকল লিজ নিতে কোনো আবেদনপত্র জমা পড়েনি সেগুলো খুলনার। মিলগুলো হলো, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস, খালিশপুর জুট মিলস ও স্টার জুট মিলস। আর খুলনার অটরা শিল্প এলাকায় অবস্থিত আলীম জুট মিলসকে কেন লিজ দেওয়ার তালিকায় রাখা হয়নি, তা জানা যায়নি।

বিজেএমসির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রউফ জানান, যেসব আবেদন জমা পড়েছে সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। লিজের মাধ্যমে পাটকল আবার চালু করা হবে, তবে সে জন্য আরও সময় লাগবে।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!