দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রু (পাকিস্তানি হানাদার) মুক্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে যৌথবাহিনীর প্রচেষ্টায় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে প্রাণের বাংলাদেশ।
যখন দেশের বেশিরভাগ স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাস করছিল। তখনও বাগেরহাটের কোথাও কোথাও পাকবাহিনীর তান্ডব চলছে। নিজেদের সীমানা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করতে বাগেরহাটের মুক্তিযোদ্ধারা লড়ছেন প্রাণপনে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেও রাজাকার-আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্থান সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ.কে.এম. ইউসুফের জন্মস্থান হওয়ার কারণে বাগেরহাট ছিল রাজাকার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কে.এম. ইউসুফের দোসর রাজাকারদের খুলনা অঞ্চল প্রধান রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে বাগেরহাটে তখনও ব্যাপক লূটপাট, মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা এবং নির্মম নির্যাতন চলছিল।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠে ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। বর্তমান জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ছিল রাজাকারদের বিচারালয় এবং টর্চার সেল। স্বাধীনতার পরে যেখানে স্থাপন করা হয়েছে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। এর উল্টো পাশে ভৈরব নদীর পাড়ে রজব আলীর নির্দেশে তৈরী করা হয় ফায়ারষ্কট বা কসাই খানা। যেখানে সম্প্রতি শহীদদের স্মরণে বদ্ধভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
এদিকে সারাদেশ যখন শত্রুমুক্ত তখন বাগেরহাট শত্রুদের দখলে থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা উদগ্রীব ও অস্থির হয়ে পড়ে। প্রাণপন চেষ্টা চলতে থাকে। শুরু হয় পরিকল্পনা। ১৬ ডিসেম্বর বাগেরহাট শহর দখলের পরিকল্পনা হয়। ১৭ ডিসেম্বর ভোরে রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে রফিক বাহিনী মুনিগঞ্জ এলাকা দিয়ে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করে। ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে তাজুল বাহিনী শহরের উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশ করে বাগেরহাট শহরে। সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিনের বাহিনী দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সম্মিলতভাবে বাগেরহাট শহর দখলের জন্য আক্রমণ করে।
বাগেরহাট সদর থানায় রাজাকার ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকার-আল বদর ও পাকিস্থানী বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে রাজাকর রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে হানাদাররা বাধ্য হয়ে পাকিস্থানী পতাকা নামিয়ে পালিয়ে যায়।
১৭ ডিসেম্বর দুপুরে হানাদার মুক্ত হয় বাগেরহাট। বিজয়ের আনন্দে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। উল্লাস আর আনন্দে বাগেরহাটবাসী পায় মুক্তির স্বাদ। মুক্তিকামী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তোলন করেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
বাগেরহাট শহর মুক্তি সমরে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা নকীব সিরাজুল হক বলেন, ‘১৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে রাজাকার রজব আলী বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যরা পালিয়ে যায়। তবে কেউ কেউ আত্মসমর্পণও করে। সমগ্র বাগেরহাট মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। আমরা বিজয়ের পতাকা উড়াই স্বগৌরবে।’
বাগেরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা শেখ শওকত হোসেন বলেন, ‘বাগেরহাট ছিল রাজাকার অধ্যুসিত একটি এলাকা। শহরের পাশে বিশালাকারের একটি নদী থাকায়। বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জড় করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়। যার ফলে ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে আমরা (বীর মুক্তিযোদ্ধারা) বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করি। বাগেরহাট শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। বাগেরহাট সদর থানায় রাজাকর ক্যাম্পে অবস্থানরত রাজাকার-আল বদর ও পাকিস্থানী বাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তির কাছে হার মানে তারা। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে রাজাকার রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে হানাদাররা বাধ্য হয়ে পাকিস্থানী পতাকা নামিয়ে পালিয়ে যায়।’
খুলনা গেজেট/ এস আই