বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে নিম পাতার বাতাস, ঝাড়ফুক ও স্বপ্নে পাওয়া পারমর্শে ক্যান্সারসহ সব ধরণের জটিল রোগের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন আব্দুল মুকিত নামের এক ব্যক্তি। সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার রাতে চিকিৎসা সেবা পেতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকশ মানুষ আসেন কবিরাজের কাছে। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে চিকিৎসা সেবা নিয়ে গন্তব্যে ফেরেন তারা। মুকিতের চিকিৎসায় রোগ থেকে মুক্তি ও ভোগান্তি দুই ধরণেরই কথা রয়েছে এলাকায়। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খোজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
কবিরাজ আব্দুল মুকিত (৫৫) বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলভদ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা। এক মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে তার। বছর তিনেক আগে হার্ট এ্যাটাক করে গুরুত্বর অসুস্থ্য হয়ে পড়েন তিনি। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরে বছর খানেক আগে সুস্থ্য হয়ে যান। ৮ মাস আগে থেকে এলাকার লোকজনকে ঝারফুক দেওয়া শুরু করেন। বর্তমানে ক্যান্সার, প্যারালাইসিস, পাইল্স, স্টোক, মাজা ব্যাথা, বাত-ব্যাথা, জন্ডিস, হাপানিসহ সব ধরণের চিকিৎসা দেন তিনি। প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার রাতে তার নিজের বাড়ির অদূরে লক্ষিকান্ত মন্ডলের বাড়িতে বসে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তার চিকিৎসা নিতে দূরদুরান্ত থেকে লোক আসেন প্রতিনিয়ত।
শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে কবিরাজের বাড়ি মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলভদ্রপুর গ্রামে লক্ষিকান্তের বাড়িতে গিয়ে শতাধিক নারী-পুরুষের ভীড় দেখা যায়। ছোট একটি ঘরে থালার উপর মোমবাতি জালানো, শরীরে ছোয়ায়ে সেই থালে ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত রাখছেন লোকজন। সেই ঘরের পরেই আরেক ঘরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে নিম পাতা দিয়ে রোগীদের ঝারফুক ও পরামর্শ দিচ্ছেন কবিরাজ আব্দুল মুকিত।বেশির ভাগ রোগীকে পথ্য হিসেবে কালোজিরা, সরিষার তেল ও মধু খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ভাল হলে জানাতে বলছেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে সেবা পেয়ে খুশি হয়ে বের হয়ে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন তারা।
চিকিৎসার প্রক্রিয়া সম্পর্কে কবিরাজ আব্দুল মুকিত বলেন, আমি খুব অসুস্থ্য ছিলাম। প্রায় দুই যুগ আগে বিয়ে করলেও কোন বাচ্চা হত না আমার। দুই বছর আগে আল্লা আমাকে একটি সন্তান দিয়েছেন। বছর খানেক আগে রাতে ঘুমের ঘোরে কেউ একজন এসে আমাকে বলেন তুই সুস্থ্য হয়ে যাবি। লাঠি ফেলে দে, তোর কাছে যারা আসবে তারাও সুস্থ্য হবে। তুই চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু কর। তারপর থেকে আমি নিজেও সুস্থ্য হয়ে যাই, আর মানুষদেরও চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি। আল্লাহর রহমতে অনেকেই সুস্থ্য হয়েছে। ক্যান্সারের রোগীও সুস্থ্য হয়েছে বলে দাবি করেন মুকিত।
চিকিৎসা পদ্ধতি ও ফি সম্পর্কে মুকিত বলেন, আমি কারও কাছ থেকে কোন টাকা নেই না। যার যা ইচ্ছে, সামনে একটা থাল রাখা আছে সেই থালে রেখে যায়। এটা দিয়ে এই বাড়ির বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য ব্যয় বহন করা হয়। আমি কখনও এই টাকা ভোগ করি না।
মুকিতের কাছে চিকিৎসা নিতে যাওয়া কচুয়া উপজেলার ভান্ডাকোলা গ্রামের ভ্যান চালক রবিউল ইসলাম বলেন, আমার হাটু ফুলে উঠেছিল, অনেক চিকিৎসা করিয়েও যখন ভাল হইনি তখন এখানে আসি। এখানে আসার পরে ভাল হয়েছি।
একই উপজেলার প্রতাপরু গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ মোল্লা বলেন, শুনে এসেছি এখানে সব রোগ ভাল হয় তাই এসেছি। আল্লাহই ভাল জানেন কি হবে।
অঞ্জলী নারী নামের এক নারী বলেন, আমার এবং আমার মেয়ের শরীরে সমস্যা ছিল। এখানে এসে ভাল হয়েছি।
তব আব্দুল মুকিত কোন চিকৎসকনা চিকিৎসার নামে প্রতারণা করছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বেশকিছু লোক।
স্থাণীয় জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, মুকিত নিজেই অসুস্থ্য। সে এখনও ঔষধ খায়। আর তার কাছে শত শত লোক আসছে। এটা কোন ধরণের প্রতারণা তা বলার ভাষা আমাদের নেই। অতিদ্রুত এই ভন্ডামি বন্ধ না হলে মানুষ আরও বেশি প্রতারিত হবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, এই চিকিৎসা সেবাকে কেন্দ্র করে ৪০ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ প্রভাবশালীরা রয়েছে। এই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যে টাকা আয় হয়, সেই টাকা তারা ভাগ করে নেন। মুকিত তেমন কিচু পায় না।
মোরেলগঞ্জ উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বপন কুমার মুখার্জী বলেন, মুকিত ফকির যে চিকিৎসনা দিচ্ছে তা স্পষ্ট অপচিকিৎসা। সে যে চিকিৎসা দিচ্ছেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি, সে কি আইন মেনে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তার চিকিৎসায় কোন মানদন্ড মানা হচ্ছে? সে যা করছে তা এক ধরণের প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ এই লোকের কাছে প্রতারিত হচ্ছে। অতিদ্রুত এই অপচিকিৎসা বন্ধ না হলে এলাকার মানুষ আরও ক্ষতিগ্র্রস্থ হলে বলে দাবি করেন তিনি।
বনগ্রাম ইউনিয়নের ৬ নং (বলভদ্রপুর) ওয়ার্ড সদস্য প্রদীপ মজুমদার বলেন, আমরা যতদূর জানি মুকিতের কাছে লোকজন ভাল হয়। কিভাবে সে চিকিৎসা দেয়, তা সে জানে। আমরা অন্যকিছু জানি না।
বাগেরহাট সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। খোজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া এই ধরণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই বলে জানান তিনি।