খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ পৌষ, ১৪৩১ | ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  জাহাজে ৭ খুনে জড়িতদের বিচার দাবিতে সারাদেশে নৌযান শ্রমিকদের লাগাতার কর্মবিরতি শুরু
  মারা গেছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং

বাংলা ভাষার বিশ্বগত মর্যাদা নির্মাণে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ

ড. বিশ্বম্ভর মণ্ডল

১৯০৫ সালে যখন ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গের উদ্যোগ নিয়েছিল সেই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বাঙালি জাতি লড়াইয়ের যৌথ মুখ প্রথম দেখিয়েছিলো। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিপক্ষে বাংলা ভাষাকে রক্ষাকে কেন্দ্র করে রক্তের বিনিময়ে বাঙ্গালীদের প্রথম প্রতিরোধ যার অভিঘাত চিরন্তন । যদিও বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের সূচনা কিন্তু ১৯৪৭ সালে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপক আবুল কাসেমের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন তমুদ্দিন মজলিস এর হাত ধরে । ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার এক মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্থানে বাংলা ভাষাকে অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি ওঠে । ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্থানের সংসদে বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে এই দাবি নিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয় । ইতিমধ্যে ১৯৪৮র ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু আর ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্থির করা হয়। পূর্ব পাকিস্থানের সংসদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসাবে গ্রহন করার প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাব মানা হয় না। পূর্ব পাকিস্থানে শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। আন্দোলনকে তীব্র করতে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে এক সভায় জিন্না বললেন- উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্ররা প্রতিবাদ জানিয়েছিল জিন্নার প্রিয় ভাষায় –“নো নো” বলে। ভাষা নিয়ে আন্দোলনের অঙ্কুরোদ্গমের শুরু হয় এভাবে। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় আজিমুদ্দিনের ভাষণের মধ্য দিয়ে। উনিও জিন্নাহর সুরেই বলেছিলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ৩০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট করে। ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারি সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচী ঘোষনা করে।

এই পরিস্থিতিতে সরকার সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। তার প্রতিরোধে নেমে ছাত্রদের প্রাণকে বাজি রেখে লড়াইয়ের গল্প সবাই জানেন । মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার দাবিতে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউর । বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রাম সূচনা হয়েছিল ১৯৫২ তে তা ক্রমে ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথে হেঁটে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মতন চূড়ান্ত পরিণতি পায়। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আরেকটি দিন হল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর- যেদিন বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি বিরোধী পাকিস্তানি শক্তির হাত থেকে বাঙালি জয় ছিনিয়ে নেয় এবং বাংলাকে প্রথম একটি স্বাধীন, সাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৫২র ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যেমন বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছেন, তেমনি ১৯৬১র ১৯ মে আসামের শিলচরে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন। আর যে তারিখটি বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর আর সব ভাষার চেয়েও আলাদা করে অন্য এক রূপে মহিমান্বিত করেছে তা হল ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর – যেদিন ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের শেষ দিনে ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের সুপারিশ গৃহীত হল। ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের কথায়- “এটা শুধু একটি ভাষা গোষ্ঠীর কাছে তার ভাষার বৈধতা বা ভালোবাসার প্রতিষ্ঠা নয়। এইসব আত্মদান…. বুঝিয়ে দেয় যে ভাষা মানুষের কতটা মৌলিক সম্পদ। ভাষা বিপন্ন হলে কিংবা আধিপত্যের দ্বারা অপমানিত হলে সচেতন মানুষ কিভাবে প্রাণ পর্যন্ত তুচ্ছ করে তার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে দ্বিধা করে না। ”

বাংলা ভাষার বিশ্বগত মর্যাদা নির্মাণে যে কয়েকটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের কথা বলেছি তার সাথে আরো টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা যুক্ত করাই যায় নিশ্চয়ই। আসল কথা হল বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক, মানবিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষা এমন একটা মর্যাদার অধিকারী হয়েছে যে মর্যাদা পৃথিবীর ৭০০০ ভাষার অন্য কোন ভাষার নেই, এমনকি দুনিয়ার সবচেয়ে আধিপত্যকারী ভাষা ইংরেজিরও নেই। উল্লেখিত ঘটনাগুলো ও সেই সংক্রান্ত ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণগুলো ইউনেস্কোর তালিকায় থাকুক বা না থাকুক – আপামর সচেতন বাঙ্গালীদের কাছে একই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একই ভালোবাসার ক্রম রক্ষা করে সন্ধিক্ষণগুলো স্মরণীয় হয়ে আছে ।

বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ আনুমানিক ৭০০০ ভাষায় কথা বলেন। ভাষাতত্ত্ববিদদের আশঙ্কা আগামী ১০০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০০০ ভাষার বিলুপ্তি ঘটবে। এমন ৫১ টা ভাষা আছে যে ভাষাগুলোতে কথা বলেন মাত্র ১ জন করে। বোঝাই যাচ্ছে দেশে দেশে মাতৃভাষা আজ তীব্র এক আক্রমণের মুখোমুখি । এই পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের শহীদরা সকলেই যেন আমাদের চারপাশে এসে দাঁড়ায় আর তাদের তর্জনী তুলে বলতে থাকেন – আমরা তো শুধু ভালোবাসা নয়, সব ভালোবাসার যা তীব্র নির্যাস সেই প্রাণ দিলাম আমাদের এই ভাষার জন্য, তোমরা কি দিচ্ছ? প্রান না হয় সবাই দিতে পারে না, সব সময় তার দরকারও হয়না। কিন্তু তোমরা কি অন্তত ভালোবাসাটুকু দিচ্ছ?

এই কথাগুলো বলতে হলো। কারণ চারদিকে দেখে মনে হচ্ছে মাতৃভাষা চর্চা যেন কেমন অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হচ্ছে ঠান্ডা মাথায়। জীবনদর্শন বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে যাচ্ছে চারদিক। মাতৃভাষা চর্চার যাবতীয় ঐশ্বর্য লুট হয়ে যাচ্ছে দেখেও আমরা নির্বিকার চিত্তে উপভোগে ব্যস্ত আছি অন্য কোথাও। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নানা কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু শেষের মিছিল থামাতেই হবে । তাহলেই আমরা মাতৃভাষা দিবস থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যে পরিক্রমা তাতে অভিযাত্রী হতে পারব । কথা সাহিত্যিক সৈয়দ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথার প্রতিধ্বনি করে বলা যায় “২১শে ফেব্রুয়ারির দায়িত্ব এখনো কিছুমাত্র লাঘব হয়নি”।

 

 

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!