১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারী সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাসের পর এক আবেগঘন বক্তৃতায় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে দেওয়া সর্বশেষ ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আজকে করপশন (দুর্নীতি)-এর কথা হয়। আজকে বাংলার মাটি থেকে করপশন উৎখাত করতে হবে। করপশন বাংলার কৃষক করে না। করপশন বাংলার মজদুর করে না। করপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ-যারা আজকে এদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি।
স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে সেদিনের সংসদ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, ‘আজ যেখানে যাবেন করপশন দেখবেন। দেখবেন যেখানে আমরা রাস্তা করেছি, সেখানে করপশন। খাদ্য কিনতে যাই, করপশন। জিনিস কিনতে যাই, করপশন। বিদেশের টাকা উঠাতে করপশন। কারা করে? আমরা যারা ফাইভ পারসেন্ট, যারা শিক্ষিত আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করপ্ট পিপুল।’ তিনি আরো বলেন, ‘আজকে আত্মসমালোচনার দিন এসেছে। এভাবে চলতে পারে না। মানুষকে একদিন মরতে হবে, কবরে নিয়ে যেতে হবে- কি সে নিয়ে যাবে? তবু মানুষ কেমন করে এই কাজ চালাতে পারে! ওই ভাষণে জাতির জনক বলেন, ‘তথা কথিত শক্তিশালী আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ইস্কান্দার মির্জা বাংলার মানুষকে অত্যাচার করেছে বন্দুক দিয়ে- তাদের বিরুদ্ধে বিনা অস্ত্রে আপনাদের নিয়ে সংগ্রাম করে যদি তাদের উৎখাত করতে পারি, তাহলে কিছু দুর্নীতিবাজ, কিছু ঘুষখোর, কিছু শোষক, কিছু ব্লাকারকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারবো না, এ বিশ্বাস করি না।’ তিনি আরো বলেন, দুর্নীতি, ঘুষ, চোরাকারবারী, মুনাফাখোরীর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সংগ্রাম করতে হবে, কাজ করতে হবে। আমাদের জাতিকে ইউনাইটেড করতে হবে।
একই বক্তৃতায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার শ্রমিকেরা খারাপ নয়। শ্রমিকেরা কাজ করতে চায়। আমার শ্রমিকেরা কাজ করছে। ফুড প্রডাকশনে তারা এগিয়ে গিয়েছে। আমরা বাধার সৃষ্টি করি। আমরা ষড়যন্ত্র করি। আমরা ধোকা দেই। আমরা লুট করে খাই। আমরা জমি দখল করে নিয়ে যাই। আজকে আমরা বড় বড় যারা আছি, তারা এই সমস্ত করি। তারাই করে যারা এই দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, এই দেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ। যাদের পেটের মধ্যে দু’অক্ষর বুদ্ধি, আমার বাংলার দুঃখী মানুষের পয়সায় এসেছে। তারা একথা ভুলে যায়। আজকে কথা হলো, কী দিলাম। আমি কি পেলাম, আর আমি কি দিলাম।’
সেদিনের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরো বলেন, বহু দুঃখে কাজ করতে হয়েছে বহু দিন পর্যন্ত। বিবেকের দংশনে জ্বলে মরে গেছি। আপোষ করি নাই কোনদিন অন্যায়ের কাছে। মাথানত করি নাই কোনদিন অন্যায়ের কাছে, জীবনভর সংগ্রাম করেছি। আর এই দুঃখী মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনব-সেই খাবার চুরি করে খাবে। অর্থ আনব- সেই অর্থ চুরি করে করে খাবে। টাকা আনব-তা বিদেশে চালান দেবে। বাংলার মাটি থেকে তাদের উৎখাত করতে হবে।
সংবিধান সংশোধনের পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরও দূর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিলো বঙ্গবন্ধুর। তারপরও দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। তার (বঙ্গবন্ধু) আপোষহীন সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্থানী সামরিক ও স্বৈরশাসকরা পরাস্থ হলেও দুর্নীতিবাজরা পরাস্থ হয়নি। এখনো সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি চলছে। আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শুরু করা সংগ্রামও চলছে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহনের ঘোষণা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, চতুর্থ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবারো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ফলে সংসদ নেতা হিসেবে ওই দিনের অধিবেশনে তিনি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ ও দেশের জনগনের দিক-নির্দেশনামূলক দীর্ঘ বক্তৃতা করেন।
এর আগে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে গণপরিষদের প্রথম বৈঠক, ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর প্রথম সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন এবং ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান বিল নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে এ সকল বিষয়ে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ দিন পরও বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ওই বক্তৃতা এখনো প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
(তথ্য সূত্র : পার্লামেন্ট নিউজ বিডি ডট কম)