দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের ২৯ জন নেতা–কর্মী এবার গাজীপুর সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রার্থী হওয়ার পরই তাঁদের সবাইকে দল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। তবে দল পাশে না থাকলেও ভোটের লড়াইয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ১১ জন নেতা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন ১০ জন। আর সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর হয়েছেন একজন।
ভোটের এমন ফলাফল নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানা আলোচনা হচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতিকদের অনেকে মনে করছেন, ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও বিএনপির নীরব ভোটারদের সমর্থনের কারণেই ওই ১১ জন জয়ী হয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড ৫৭টি। সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড ১৯টি।
বিএনপি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। তখন সাধারণ ওয়ার্ডে বিএনপি–সমর্থিত কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ৭ জন। আর সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে বিএনপি–সমর্থিত একজন কাউন্সিলর বিজয়ী হয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ১১টি ওয়ার্ডে (সংরক্ষিত ওয়ার্ডসহ) বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৮ জন গত মেয়াদেও কাউন্সিলর ছিলেন। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এমন পরিস্থিতিতে দলের সহায়তা ছাড়াই এবার ১১ জনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়াকে ‘খুবই ভালো’ ফল মনে করছেন দলটির স্থানীয় নেতা–কর্মীরা।
অন্যদিকে কাউন্সিলর পদে এবার ৪৭টি ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তবে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ৫৭ ওয়ার্ডের মধ্যে ৫০টিতেই কাউন্সিলর পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। যদিও এবারও দলগতভাবে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগ কাউকে সমর্থন দেয়নি।
গাজীপুরের নতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়া জায়েদা খাতুন ও তাঁর ছেলে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার। এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন গাজীপুর সদর থানা বিএনপির সদস্য আনোয়ার হোসেন। গতকাল শুক্রবার রাতে তিনি বলেন, ‘আমি দলের বড় কোনো পদে নেই। বহিষ্কার নিয়ে ভাবি না। এলাকার মানুষ ভালোবেসে জিতিয়েছে।’ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি ৩০০ ভোটের বেশি ব্যবধানে হারিয়েছেন।
এবার নির্বাচনের পরিবেশ ভালো থাকায় বিএনপি সমর্থকদের অনেকে ভোট দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যাওয়া আজমত উল্লা খান সিটির ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাঁর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করেছেন গিয়াস উদ্দিন সরকার। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ভোটে বিএনপি না থাকার পরও কাউন্সিলর পদে গতবারের চেয়ে দলটির নেতাদের (বহিষ্কৃত) ভালো করার বিষয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বিদায়ী কমিটির সদস্য আবদুল হাদী বলেন, ‘বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে সেভাবে ভাবনা ছিল না। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে যিনি পরাজিত করেছেন, তাঁর সঙ্গে মিলে নির্বাচন করেছেন ওই প্রার্থীরা।’
বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েও কাউন্সিলর
গাজীপুর মহানগর শ্রমিক দলের আহ্বায়ক (বহিষ্কৃত) ফয়সাল সরকার এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এর আগেও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের দুবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। এবার এই ওয়ার্ডে দুজন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ফয়সাল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা আছে বুঝতে পেরেই ওই দুজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
তবে এলাকায় আলোচনা আছে, যে দুজন নির্বাচন থেকে সরে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে ফয়সাল সরকারের একধরনের সমঝোতা হয়েছিল। তবে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে গতবারও কাউন্সিলর ছিলেন গাজীপুর সদর থানা বিএনপির সভাপতি হাসান আজমল ভূঁইয়া। এবারও ভোটে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার বিষয়ে হাসান আজমল বলেন, একটি পক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের উসকানি দিয়ে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করিয়েছে। এই বহিষ্কার সাংগঠনিকভাবে হয়নি বলেও মনে করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা–কর্মীদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে, আওয়ামী লীগবিরোধী বেশির ভাগ ভোট পেয়েছেন নবনির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন। যেসব ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা জিতেছেন, সেসব ওয়ার্ডে মেয়র পদে জায়েদা খাতুন বেশি ভোট পেয়েছেন।
সদর থানা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক হান্নান মিয়া ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। এবারও তিনি জিতেছেন। তাঁর ওয়ার্ডে মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা পেয়েছেন তিন হাজারের কম ভোট। বিপরীতে জায়েদা খাতুন পেয়েছেন সাড়ে সাত হাজারের বেশি ভোট।
এবারও ভোটে জয়ী হওয়ার বিষয়ে হান্নান মিয়া বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের কারণেই এমন জয়।
বিএনপির স্থানীয় একাধিক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ ভালো থাকায় বিএনপি সমর্থকদের অনেকে ভোট দিতে কেন্দ্রে গেছেন। এটি মেয়র নির্বাচনের ফলাফলকেও প্রভাবিত করেছে। বিএনপি সমর্থকদের অনেকে নিজ দলের কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। আর নৌকা প্রতীকের পরাজয় ঘটাতে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়েছেন।
বিএনপি ভোটে অংশ না নিলেও দলের নেতারা গত সিটি নির্বাচনের চেয়ে এবার কাউন্সিলর পদে ভালো ফল করলেন কীভাবে, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নানকে। তিনি বলেন, ‘যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাই তাদের নির্বাচিত হওয়া বা না হওয়ায় আমাদের কিছু যায় আসে না।’
খুলনা গেজেট/এইচ