বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব ও শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছে আদালত।
বুধবার ঢাকার মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।
তাদের বিরুদ্ধে দুদক মানি লন্ডারিং, রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি দখল, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনে শেয়ার ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আবেদন করে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধানও করছে সংস্থাটি।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম আদালতের আদেশের তথ্য তুলে ধরে বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের সাত সদস্যদের ৭০ ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা ও ১০ হাজার ৫৩৮ ডলার এবং ১৪৫৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা মূল্যমানের ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার ৩০২টি শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশ এসেছে।
চেয়ারম্যানের পরিবারের অন্য সদস্যরা হলেন- আহমেদ আকবর সোবহানের ছেলে ও বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর, তার স্ত্রী সাবরিনা সোবহান, কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান ও তার স্ত্রী সোনিয়া ফেরদৌসী সোবহান, ভাইস চেয়ারম্যান সাফিয়াত সোবহান (সানভীর), ভাইস চেয়ারম্যান সাফওয়ান সোবহান ও তার স্ত্রী ইয়াশা সোবহান।
দুদকের পক্ষে অনুসন্ধানকারী টিমের সদস্য সহকারী পরিচালক সাজিদ উর রহমান ব্যাংক হিসাব ও শেয়ার অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন।
আবেদনে বলা হয়, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি, ভূমি জবর দখল, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে।
অনুসন্ধানকালে তাদের নামে ও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে স্লোভাকিয়া ও সাইপ্রাসে নাগরিকত্ব গ্রহণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি বলেও দুদকের আবেদনে বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের আইন না মেনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে বিদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ, স্লোভাকিয়া, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেডিস, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য সিঙ্গাপুরে একাধিক কোম্পানিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাবিব ব্যাংক লি. এ অর্থ জমা, সাইপ্রাস এর ইউরো ব্যাংকে বিপুল অর্থ লেনদেন করার এবং সাইপ্রাসে বাড়ি কেনার তথ্য পাওয়া যায়।
আবেদনে অভিযোগ করা হয়, এসব সম্পত্তি বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি ছাড়া কেনা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশি নাগরিক হয়ে বিদেশি পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব গ্রহণে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।
দুদক আবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিদেশে পুঁজি নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। তারা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মূলধন স্থানান্তরের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করেনি বলে জানা গেছে। এমনকি তারা বিদেশে যে সম্পত্তি অর্জন করেছেন সেগুলোর তথ্য/রেকর্ডপত্র, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর কাছে সংশ্লিষ্ট আয়কর বিবরণীতে প্রকাশ না করে তথ্য গোপন করেছেন। অর্থাৎ অভিযোগসংশ্লিষ্টরা অবৈধ উপায়ে সরকারি অনুমতি ছাড়াই বিদেশে অর্থ নিয়ে গিয়েছেন।
আবেদনে বলা হয়, তারা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ স্থানান্তর, হস্তান্তর ও রূপান্তর করতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে ‘লেয়ারিংয়ের’ আশ্রয়ে সেসব দেশে সম্পদ কিনেছেন।
দুদকের এ অভিযোগে ঢাকার মহানগর বিশেষ জজ আদালত ২০২৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ও ২১ নভেম্বর তারিখে বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দের আদেশ দেয়।
অভিযোগ সংশ্লিষ্টরা বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নামে হিসাব খুলে হিসাবগুলোর মাধ্যমে অবৈধ অর্থ লেনদেন করেছেন বলে আবেদনে অভিযোগ করে বলা হয়, এছাড়া অনুসন্ধানকালে জানা যায়, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহে ব্যাংক হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া যায়।
দুদকের আবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আহমেদ আকবর সোবহান ও তার পরিবারের মালিকানাধীন মোট শেয়ারের মূল্য ১৫ লাখ ৬ হাজার টাকা এবং বসুন্ধরা হটিকালচারের মোট শেয়ার এর মূল্য সাড়ে ১৪ লাখ টাকা।
দুদক বলছে, ২২টি কোম্পানি ছাড়া আরজেএসসিতে নিবন্ধিত বসুন্ধরা গ্রুপের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আরো অনেক কোম্পানির তথ্য অনুসন্ধানকালে জানা গেছে।
অনুসন্ধানকালে পাওয়া তথ্যের বরাতে বলা হয়, তারা এসব শেয়ার ও অর্থ হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন, যা করতে পারলে মামলার অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা দায়ের, আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল এবং বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় হতে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করাসহ সব উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এজন্য এগুলো অবরুদ্ধ ও জব্দ করা প্রয়োজন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বড় বড় ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়েও অনুসন্ধানে নামে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) বসুন্ধরাসহ পাঁচ বড় কোম্পানির মালিকদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে এবং তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠায়।
এরপর অক্টোবরে আহমেদ আকবার সোবহান ও তার চার ছেলেসহ আটজনের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
ওই মাসেই দুদকের আবেদনে আহমেদ আকবর সোবহানসহ পরিবারের আট সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত।
এছাড়া সিআইডি দেড় লাখ কোটি টাকা মূল্যের জমি দখল এবং অর্থপাচারের অভিযোগে আহমেদ আকবর সোবহান ও তার ছেলে সায়েম সোবহান আনভীরসহ স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত জানায় গত সেপ্টেম্বরে।
খুলনা গেজেট/এনএম