খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি
  নরসিংদীতে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় যুবককে গুলি করে হত্যা
  ঘন কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ১০ যানবাহনের সংঘর্ষ, নিহত ১, আহত ১৫
  ব্রাজিলে দুর্ঘটনায় বাসে আগুন, পুড়ে নিহত ৩৮

বরিশাল জজ কোর্টে বিচারের রায় ঘোষণার পর কাঠগড়া থেকে আসামিরা দৌঁড়ে পালালো

এ এম কামরুল ইসলাম

আমি তখন ঢাকায় কর্মরত। খবরের কাগজে দেখলাম বরিশালের বিশাল খবর। জজ কোর্টের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও মামলার বিচারের রায় শুনে সাথে সাথে আসামিরা কোর্টের কাঠগড়া থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কোর্ট ও থানা পুলিশ কয়েক কিলোমিটার পিছু ধাওয়া করে আসামিদের পুনরায় আটক করতে সক্ষম হয়। সকল আসামির নাম শুনে এবং হত্যাকান্ডের শিকার সেই নিহত ব্যক্তির নাম দেখে আমার স্মৃতিপটে অনেক ছবি ভেসে উঠলো।

ঘটনাটা একটু খুলে বলি। আমি তখন বরিশাল কোতোয়ালি থানায় শেষ ছয় মাস পিএসআই হিসেবে কর্মরত। এসআই-এর চাকরি পাবার পর এক বছর সারদা ট্রেনিং, তারপর দুই বছর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে সরেজমিন ট্রেনিং করতে হয়। এই ট্রেনিং সময়টাকে এসআইদের বলা হয় পিএসআই, অর্থাৎ প্রবেশনার সাব ইন্সপেক্টর। বাংলায় শিক্ষানবিশ উপ পুলিশ পরিদর্শক। এই দুই বছরের মধ্যে প্রথম ছয় মাস থানার কাজ শিখতে হয়। অতঃপর আরও এক বছর পুলিশের অন্যান্য ইউনিটে কাজ শিখে শেষ ছয় মাস আবার থানায় কাজ শেখার পর জেলার এসপি মহোদয় মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তারপর চাকরি কনফার্ম করেন। এসপি মহোদয় সন্তুষ্ট না হলে শিক্ষানবিশকাল আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন।

জেলায় যোগদানের পর প্রথম ছয় মাসে পিএসআইদের কোন মামলা তদন্ত দেওয়া হয় না। তবে পুলিশ সুপার মহোদয়ের বিশেষ নির্দেশে আমাকে প্রথম মাসে, পিএসআই থাকা অবস্থায়, মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জীবনের প্রথম মামলা তদন্ত করে চার্জশীট দাখিল করার পর এক বছরের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হয়ে আসামির ছয় মাসের জেল হয়েছিল। আমার এই মামলা তদন্তে এসপি মহোদয় সন্তুষ্ট হয়ে তাৎক্ষণিক পুরস্কার দিয়েছিলেন এবং পিএসআই পিরিয়ডের শেষ ছয় মাসে আমাকে মার্ডার কেস তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এসপি মহোদয়ের এতবড় সিদ্ধান্তে জেলার সকল অফিসার রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন, আর আমি হয়েছিলাম গভীরভাবে ভারাক্রান্ত। সেদিন আমার মনে হয়েছিল, সমগ্র দুনিয়ার বোঝা আমার মাথার উপর।

এবার সেই জজকোর্টের কাঠগড়া থেকে পালানো আসামিদের মার্ডার মামলার কথা বলি। বরিশাল শহর থেকে দূরে ‘সাহেবের হাট’ একটি প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র। একদিন সন্ধ্যায় তাসের আসরে একজন যুবক খুন হলো। তার নাম খুরশিদ (ছদ্মনাম)। সমগ্র এলাকায় দারুণ ত্রাস সৃষ্টি হলো। ফলে, পুলিশ প্রশাসন মোটামুটি জবাবদিহির সম্মুখীন হলো। এলাকায় প্রতিবাদ মিছিল মিটিং শুরু হলো। এসপি মহোদয় ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ওসি ও সার্কেল এএসপি সাহেবকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। থানার তদন্ত কর্মকর্তারা গোঁফে তেল দিতে শুরু করলেন। বরিশাল এলাকায় মার্ডার কেস তদন্ত পেলে সংশ্লিষ্ট অফিসারের পোয়াবারো। বিশেষ করে তা যদি হয় কোন ধনাঢ্য ব্যক্তির চাঞ্চল্যকর মার্ডার।

এই মার্ডার কেসটি সার্বিক বিবেচনায় সকল অফিসারের জন্য আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু সকলের আশার গুঁড়ে বালি দিয়ে এসপি মহোদয় বললেন, ‘এই মার্ডার মামলার তদন্তভার আমি পিএসআই কামরুলকে দিলাম। সে এখনই হাসপাতালে গিয়ে লাশের সুরোতহাল করে পোস্টমর্টেম করিয়ে লাশ নিয়ে সাহেবের হাট যাবে। তার সাথে পর্যাপ্ত ফোর্স যাবে। সেখানে লাশ দাফনের ব্যবস্থা করবে। জনগণের সাথে থেকে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে, আসামি গ্রেপ্তার করবে এবংপরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করবে। প্রয়োজনে আমি নিজে মামলার তদন্ত তদারকি করতে সাহেবের হাট যাবো। আমি ছাড়া এই মামলার তদন্তে কেউ কোন হস্তক্ষেপ করবে না। পিএসআই যেভাবে তদন্ত করবে সেভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। চারদিকে রীতিমতো অন্ধকার দেখতে লাগলাম। থানার সকল অফিসার হিংসায় জ্বলতে লাগলেন। কিন্তু এসপি মহোদয়ের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করলেন না। তবে সার্কেল এএসপি জনাব বাদশা মিয়া, এএসপি হেড কোয়ার্টার জনাব নূর মোহাম্মদ ও এডিশনাল এসপি জনাব সৈয়দ বজলুল করিম মহোদয় আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘পিএসআই, তুমি কোন চিন্তা করো না। আমরা তোমার পাশে থাকবো। তুমি অভয়ে ওখানে চলে যাও। পুলিশ লাইন থেকে একটা ওয়ারলেস নিয়ে যাও। কারণ ওখানে কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। তুমি যদি কোন অসুবিধা মনে কর, তাহলে ওয়ারলেস মেসেজ দিলে আমরা তাৎক্ষণিক স্পিডবোট নিয়ে চলে যাবো’।

এদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে অভিজ্ঞ কনস্টেবল তোফাজ উদ্দিনকে সাথে নিয়ে আমি লাশের সুরোতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রওনা হলাম। এসপি মহোদয়ের নির্দেশে পুলিশ লাইন থেকে কিছু অতিরিক্ত ফোর্স নিলাম। লাশের সুরোতহাল করে পোস্টমর্টেম করিয়ে একটি ইঞ্জিন বোট ভাড়া করে লাশসহ সাহেবের হাট পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলে। বোট ঘাটে ভিড়তে না ভিড়তেই মিছিল শুরু হয়ে গেল। আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। তাই বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে ঘাটে না ভিড়িয়ে উপস্থিত মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে কয়েক মিনিট সান্ত্বনামূলক বক্তব্য দিলাম। ঐ এলাকায় কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি আগে থেকেই আমাকে চিনতেন। এর আগে কয়েকটি ঘটনায় আমার নিরপেক্ষ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে অনেক মানুষ সন্তুষ্ট ছিলেন। তাদের কেউ কেউ এই মিছিলে ছিলেন। আমাকে দেখে তারা মোটামুটি খুশি হয়ে মিছিলকারীদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ করলেন। মিছিলকারীরা মোটামুটি শান্ত হলে আমি লাশ নিয়ে ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজনের কাছে বুঝিয়ে দিলাম। রাতের মধ্যে লাশ দাফন হয়ে গেল। আমি ফোর্সসহ সাহেবের হাট সংলগ্ন একটি রাইস মিলের দোতালায় রাত্রিযাপন করলাম।

সকাল হতেই লোকজনের আনাগোনা শুরু হলো। আমিও মামলার তদন্তে মনোনিবেশ করলাম। সাক্ষ্য গ্রহণ, ঘটনাস্থলের মানচিত্র ও চৌহদ্দির বিবরণ তৈরি করে আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা করতে থাকলাম। এলাকার কিছু দালাল শ্রেণির লোকজন আমার চারপাশে ভিড়তে চেষ্টা করতে থাকলো। কিন্তু, আমি কাউকে পাত্তা না দিয়ে হত্যার মূল উদ্দেশ্য ও প্রকৃত দোষীদের খুঁজতে থাকলাম।

দুই তিন দিন পার হয়ে গেল। আমি একজন আসামিকেও গ্রেপ্তার করতে পারলাম না। ওদিকে এসপি মহোদয় বেতার মারফত সংবাদ দিলেন যে, তিনি নিজেই মামলার তদন্ত তদারকি করতে সাহেবের হাট আসবেন এবং তদন্ত তদারকি শেষে দুপুরের খাবার খেয়ে জনসাধারণের সাথে আইন শৃঙ্খলা মিটিং করবেন।

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রীতিমতো আয়োজন শুরু করলাম। তারপর একদিন এসপি মহোদয় স্পীড বোটে সাহেবের হাট উপস্থিত হলেন। সার্কেল এএসপি ও এএসপি হেড কোয়ার্টার মহোদয় তাঁর সাথে গিয়েছিলেন।

মামলার বাদী, সাক্ষী ও এলাকার গণ্যমান্য লোকজনকে আমি আগেই বলে রেখেছিলাম। তাঁরা সকলেই এসপি মহোদয়কে লঞ্চ ঘাটে রিসিভ করে সভাস্থলে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি মামলার বাদী ও সাক্ষীদের সাথে গোপনে কথা বললেন। আমার কাছে আলাদাভাবে মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলেন। আমি আমার তদন্তের বিস্তারিত সকল অফিসারকে অবহিত করলাম। আমার তদন্তে সকলেই সন্তোষ প্রকাশ করলেন। শুধুমাত্র কোন আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণে কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তখন মামলার বাদীপক্ষ ও স্থানীয় লোকজন আমার পক্ষ সমর্থন করায়, সে যাত্রায় আমি রক্ষা পেলাম।

শুরু হলো আইন শৃঙ্খলা সভা। সেখানে এলাকার লোকজন আমার নিরপেক্ষ মামলা তদন্তের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এই হত্যাকাণ্ডের সুযোগ নিয়ে কোন নিরপরাধ লোকজনকে উদ্দেশ্যমূলক হয়রানি না করার জন্য সকলেই পুলিশের সুনাম করলেন। এসপি মহোদয় তাঁর বক্তব্যে সকলকে শান্ত থেকে মামলা তদন্তে আমাকে সহযোগিতার আহ্বান জানালেন। অবশেষে, স্পীড বোটে ওঠার সময় মামলার প্রকৃত আসামিদের যে-কোন প্রকারে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিলেন। আমি আমার সঙ্গীয় ফোর্সসহ সাহেবের হাটেই রয়ে গেলাম।

এই মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছিল ছয়জন। তাদের খুঁজে পাওয়া দূরের কথা, তাদের বাড়ির লোকজন, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ঘরেও কাউকে পাওয়া গেল না। অবশেষে এসপি মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে আমি বরিশাল শহরে ফিরে গেলাম। তবে, ইতোমধ্যে আমার মামলা তদন্ত মোটামুটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের বিস্তারিত তথ্য ও সাক্ষ্য প্রমাণ মোটামুটি আমার হাতে এসে গেল। হত্যা মামলার সুযোগ নিয়ে পুলিশের তথাকথিত গ্রেপ্তার বাণিজ্যের কোন আলামত না দেখে এলাকার সুশীল সমাজের লোকজন বাহবা দিলেও দালাল শ্রেণির লোকজন অযোগ্য পুলিশের খাতায় আমার নাম উঠিয়ে দিলো।

বরিশাল পুলিশ ক্লাবে ফিরে এই মামলার ডায়রি লেখা নিয়ে মহা চিন্তায় পড়লাম। মামলার তদন্তের সকল তথ্য, নোট, সাক্ষীদের খসড়া জবানবন্দী, ঘটনাস্থলের খসড়া মানচিত্র, চৌহদ্দি সবকিছুই আমার ফাইলে ছিল। কিন্তু, ডায়েরি লিখতে সাহস হলো না। সুতরাং, আবার সেই সিআইডি অফিসার আমার প্রিয় বজলুর রহমান সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ অফিসার। ইতোপূর্বে আমার জীবনের প্রথম মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর সহায়তায় ডায়রি লিখে অত্যন্ত সুনাম হয়েছিল এবং জীবনের প্রথম তদন্ত করা সিঁদেল চুরি মামলায় আসামির ছয় মাসের জেল হয়েছিল।

এসপি মহোদয়ের বিশেষ নির্দেশে আমাকে হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা বরিশাল পুলিশের প্রায় সকলেই জানতেন। কেউ কেউ বিষয়টি ঈর্ষার চোখে দেখলেও বজলু ভাই অনেক খুশি ছিলেন। তিনি আমাকে অন্তর থেকেই স্নেহ করতেন।

একদিন সন্ধ্যায় পুলিশ ক্লাবে বজলু ভায়ের সাথে বসলাম। তিনি বললেন, এবার আপনি অনেক বড় মার্ডার কেস তদন্ত করছেন, অতএব আগে আমার সিগারেট উপহার চাই।

আমি তাঁকে আগে থেকেই জানতাম। তাই, এক প্যাকেট গোল্ডলীফ সিগারেট আগেই এনে রেখেছিলাম। প্যাকেটটি তাঁর সামনে দিতেই তিনি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে টানতে বললেন,’ শিষ্য, মামলার পুরা ঘটনা আমাকে আগাগোড়া বলেন’।

আমি প্রথমে মামলার এজাহার তাঁর সামনে দিলাম। তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে বললেন, ‘এবার আপনার তদন্তের সারমর্ম আমাকে বলেন’। আমি এক এক করে আমার তদন্তের সকল তথ্য ও সাক্ষীদের জবানবন্দির নোট তাঁকে সবিস্তারে জানালাম। ইতোমধ্যে রাত অনেক হলো। তিনি আমাকে নিয়ে রাতের খাবার খেতে গেলেন। খাবার শেষে তিনি বললেন,’ কোন চিন্তা নেই শিষ্য, কাল খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনাকে ডিক্টেশান দিয়ে ডায়রি লিখাবো। আপনি কাগজ, কলম, কার্বন ও সিডি বই রেডি রাখবেন। মামলার ডায়রি আপ টু ডেট করে দিয়ে আমি অফিসে যাবো’।

যে কথা সেই কাজ। খুব ভোরে উঠে বজলু ভাই নিজেই আমাকে ডেকে উঠালেন। বজলু ভায়ের ডিক্টেশানে আমি মামলার ডায়রি লিখতে শুরু করলাম। মামলার ডায়রির শুরু থেকে তদন্তের হালনাগাদ প্রতিটি অক্ষর তাঁর ডিক্টেশানে লিখলাম। মাঝে মাঝে তাঁর কিছু কিছু ডিক্টেশান আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় আমি হালকা দ্বিমত পোষণ করলে, তিনি বলতেন, ‘শিষ্য, এটা সাধারণ মামলা নয়, মার্ডার মামলা। যা বলি, তাই লেখেন। আপনি পিএসআই, নতুন চাকরি। আপনার ডায়রি সার্কেল এএসপি ও বিচারক পড়বেন। অতএব কেউ যাতে কোন ভুল ধরতে না পারে এবং মামলায় জড়িত সকল আসামির যাতে সাজা হয়, এমন ডায়রি লিখতে হবে’। তাঁর কথা শুনে, আমি হুবহু তাঁর ডিক্টেশান মতো লিখে ডায়রি আপ টু ডেট করে সার্কেল অফিসে পাঠিয়ে দিলাম।

এভাবে প্রায় দুই মাসের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ হয়ে গেল। কিন্তু একজন আসামিকেও গ্রেপ্তার করতে পারলাম না। এজন্য কেউ কেউ একটু আধটু বিদ্রুপ করলো। পুলিশের তথাকথিত গ্রেপ্তার বাণিজ্যের বখরা না পেয়ে অনেকেই অখুশি হলেন। কেউ কেউ মনে মনে এসপি মহোদয় ও আমাকে অযোগ্য পুলিশ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন।

বজলু ভায়ের ডিক্টেশান নিয়ে মামলার ডায়রি আগাগোড়া লিখে শেষ করলাম। তারপর চার্জশিট দাখিলের জন্য এসপি মহোদয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে মেমো অব এভিডেন্স (এম ই) দাখিল করলাম। এম ই তে প্রথম অনুমোদন দেন থানার ওসি সাহেব, তারপর সার্কেল এএসপি সাহেব, সর্বশেষ এসপি মহোদয় অনুমোদন দেওয়ার আগে প্রয়োজন মনে করলে জেলার বিজ্ঞ পিপি মহোদয়ের মতামত নেন।

এই মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছিল ছয়জন। আমার তদন্তে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তার নাম চার্জশিট থেকে বাদ দিয়েছিলাম ও এজাহার বহির্ভূত একজনকে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের জন্য অনুমোদন চেয়েছিলাম।

এজাহারনামীয় একজন আসামিকে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় ওসি সাহেব এম ই তে স্বাক্ষর করতে আপত্তি করলেন। আমি অসহায় হয়ে সেকেন্ড অফিসার ও আমার পছন্দের কিছু অফিসারের শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু কোন ফল হলো না। শেষ পর্যন্ত থানার পাশেই অবস্থিত সার্কেল এএসপি সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে সরাসরি বললেন,’ তুমি এই মামলায় কিছু পেয়ে থাকলে ওসি-কে কিছু দিয়ে দাও। তাহলে দেখবা সই করে দেবে’।

আমি নিরুপায় হয়ে ফিরে এলাম। ওসি সাহেব দুই একদিন পর এমনিতেই আমার তদন্তের সাথে একমত পোষণ করে এম ই তে সই করে সার্কেল এএসপি অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। সার্কেল এএসপি সাহেব আমার মামলার সকল ডায়রি আগেই পড়েছিলেন। এম ই তাঁর কাছে পৌঁছার পর তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার সকল ডায়রি এবং এম ই কে লিখেছে? হাতের লেখা তো তোমার দেখছি’।

আমি বললাম, আমিই লিখেছি স্যার। কিন্তু, আগাগোড়া ডিক্টেশান দিয়েছেন বজলু ভাই।’

সার্কেল এএসপি সাহেব বললেন, ‘খাঁটি ওস্তাদ ধরেছো। তুমি ভবিষ্যতে অনেক ভাল করবে।’

এরপর তিনি আমার তদন্তে একমত পোষণ করে এসপি মহোদয়ের অনুমোদনের জন্য তাঁর অফিসে এম ই পাঠিয়ে দিলেন। এসপি মহোদয় আমার এম ই দেখে মামলার সকল ডায়রি নিয়ে তাঁর অফিসে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভয়ে ভয়ে হাজির হলাম। তিনিও সার্কেল এএসপি সাহেবের মতো জিজ্ঞেস করলেন,’মামলার ডায়রি এবং এম ই কে লিখেছে’? আমি আবারও বজলু ভায়ের ডিক্টেশানের কথা বললাম।

এসপি মহোদয় বললেন, ‘আমি এখনই তোমার এম ই পাশ করে দিতাম। তবে, তোমার ভবিষ্যতের জন্য বিজ্ঞ পিপি মহোদয়ের মতামতের জন্য পাঠাচ্ছি। তুমি গিয়ে তাঁর মতামত নিয়ে আসো’।

আমি এম ই এবং মামলার ডায়রি নিয়ে বিজ্ঞ পিপি মহোদয়ের কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘এসপি মহোদয় আমাকে ফোন করে আপনার কথা বলেছেন। দেখি আপনার এম ই এবং ডায়রি’।

তিনি আমার কেস ডায়েরি এবং এম ই আগাগোড়া দেখে সাথে সাথে এম ই অনুমোদন দিলেন। আমি আবার এসপি মহোদয়ের কাছে ফিরে গেলাম। কিন্তু, তিনি ঐদিন এম ই অনুমোদন দিলেন না। তিনি বললেন, ‘তোমার কেস ডায়েরি এবং এম ই আমার কাছে থাকবে। এই ডায়েরি এবং এম ই মডেল হিসেব জেলার সকল তদন্তকারীদের আমি দেখাবো। তারপর তোমাকে ফেরত দেব’।

আমি অপেক্ষায় রইলাম। একদিন মাসিক অপরাধ সভায় এসপি মহোদয় জেলার বেশ কিছু তদন্তকারী কর্মকর্তাকে হাজির করলেন। আমাকেও সেখানে ডেকে নিলেন এবং সবার সামনে আমার মামলার ডায়েরি এবং এম ই থেকে কিছু কিছু অংশ পড়ে শুনাতে বললেন। আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর নির্দেশ পালন করে মনে মনে গর্বিত হলাম। অবশ্য সবার আগে আমার গুরু বজলু ভায়ের ডিক্টেশানের কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলাম।

এসপি মহোদয় আমার এম ই অনুমোদন দেওয়ার পর আবার বজলু ভায়ের ডিক্টেশান নিয়ে মামলার চার্জশিট লিখে আদালতে দাখিল করেছিলাম।

এই মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আমার পোস্টিং ছিল ঢাকায়। বরিশাল জজকোর্টে আমার সাক্ষ্য দেওয়ার দিন সকল আসামি হাজির ছিল। তাদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল, তারা বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। হত্যা মামলার আসামিদের চেহারায় এমন ফুরফুরে ভাব থাকার কথা নয়। আমার সাক্ষ্যগ্রহন শেষে বিজ্ঞ বিচারক সাহেব আমাকে তাঁর খাস কামরায় ডেকে পাঠালেন। তিনি মামলার প্রকৃত ঘটনা আমার কাছে জানতে চাইলেন। আমি ডায়রি না দেখেই মেমোরি থেকে জজ সাহেবকে সবিস্তারে সবকিছু জানালাম।

তিনি সবকথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘সাক্ষীদের বক্তব্য শুনে আমার মনে হয়েছে সাক্ষীরা অধিকাংশই আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বরিশালে অধিকাংশ হত্যা মামলায় এমন হচ্ছে। আমি আপনার ডায়রি পড়েছি। আপনার সাক্ষ্য ভাল হয়েছে’।

জজ সাহেবের কথা শুনে আসামিদের ফুরফুরে মেজাজে থাকার বিষয়টি অনুধাবন করলাম।

বরিশাল এলাকায় মামলার সাক্ষী দেওয়া নিয়ে আমারও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। ঐ এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলে কিছু কিছু লোক গায়ে পড়ে সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসে। কারণ তারা পেশাদার সাক্ষ্যদাতা। তারা বাদীপক্ষের কাছ থেকে স্বার্থের বিনিময়ে পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দেয় এবং বিচারের সময় আসামি পক্ষের কাছ থেকে স্বার্থ নিয়ে কোর্টে গিয়ে উল্টে যায়। আবার কিছু কিছু লোকের পেশাই হচ্ছে বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। যে পক্ষ বেশি পয়সা দেয়, সেই পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে জীবন ধারণ করে। এই ধরনের লোকদের বলা হয়, ‘কাশিপুরে সাক্ষী’। বরিশাল শহরতলীর একটি গ্রামের নাম কাশিপুর। কাশিপুর গ্রামে এই ধরনের লোকজন প্রচুর বসবাস করে।

যাহোক, মামলার বিচারের রায়ে ছয়জন আসামির চার জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, একজনের দুই বছরের জেল ও একজনকে খালাস দেওয়া হয়। মূল আসামিরা ভেবেছিল, তারা সাক্ষীদের কিনে নিয়েছে। সুতরাং সকলেই খালাস পাবে। আসামি পক্ষের আইনজীবীও তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু, আমার ডায়রি পড়ে জজ সাহেব সন্তুষ্ট হয়ে এই রায় দিয়েছিলেন। আসামিরা অনাকাঙ্ক্ষিত সাজায় হতবাক হয়ে সেদিন বিচারের রায় শুনে কাঠগড়া থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত রেহাই পায়নি।

আমার বেশ মনে পড়ে, ঐদিন খবরের কাগজে বরিশালের তৎকালীন পিপি মহোদয় ফলাও করে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং সরকার পক্ষে তিনি মামলাটি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য খুনিদের প্রকৃত সাজা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এই সাজার নেপথ্য কারণ কি ছিল তা কেউ জানলো না।

আনন্দ

যে-কোন মানুষ হত্যার শিকার হলে তার আত্মা বিচার চায় এবং সেই বিচারের প্রাথমিক দায়িত্ব পুলিশের হাতে। পুলিশ সঠিকভাবে মামলা তদন্ত করে বিচারের জন্য চার্জশিট দাখিল না করলে বিচারকের তেমন কিছু করার থাকে না। আমার মনে হয় সেই নিহত মানুষটির আত্মা এই বিচারে শান্তি পেয়েছিল। আমার স্বল্প দিনের চাকরি জীবনে এটা ছিল বড় সাফল্য।

এই মামলার তদন্তকালে আমি কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও, কোন নিরপরাধ লোকজন আমার দ্বারা তথাকথিত পুলিশী হয়রানির শিকার হয়নি।

বেদনা

পুলিশ কোন খারাপ কাজ করলে সাথে সাথে ফলাও করে নানা মানুষ নানা কথা বলতে থাকে এবং মিডিয়ায় তা ফলাও করে প্রচারও হয়। কিন্তু, পুলিশের অনেক ভাল কাজ মানুষের অজানা রয়ে যায় অথবা ভাল কাজের সুনাম অন্য কেউ নিয়ে নেয়, যার প্রমাণ এই হত্যা মামলা। চলবে …

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!