মসজিদে নববীর এককোনে কোন রকম কাপড়ে ঘেরা একটি তাবু। জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসীর আশ্রয় এটি। জরাজীর্ণ এই ঠিকানাতে দিন রাত কাটে তার। এই শহরে তার কেউ নেই। নেই বাবা মা আপন কেউ। কেবল মসজিদের শীতলতায় ইবাদতমগ্ন সময় অতিবাহিত করা আর অবসর হলে মসজিদের পাশে উম্মাহাতুল মুমিনিনদের সাথে আলাপচারিতায় অংশ নেওয়া।
মেয়েটি বড্ড সাধাসিধে। কালো দেহের মাঝে একটি পরিস্কার সচ্ছ হৃদয়ের মালিক। আম্মাজান আয়শা রা: তার খুব প্রিয় মানুষ। তার সাথে সময় কাটানো, তার থেকে দ্বীনের জরুরী বিষয়গুলি জানা তার পছন্দের কাজগুলির অন্যতম। বলতে গেলে এটা তার নিয়মিত অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু একটা আশ্চর্যের ব্যাপার হল, মেয়েটি যখনই আম্মাজানের কাছে আসতো ফিরে যাওয়ার সময় দুই লাইন কবিতা আবৃতি করে শুনাতো। এমনকি কখনও এর ব্যতিক্রম হত না। সে বলতো, “গলার হারের সেই দিনটি আমার প্রভুর নিদর্শনাবলীর অন্যতম, যেদিন তিনি আমাকে কুফুরির ঘাটি থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।”
একদিন দুদিন করে বিষয়টি আম্মাজান আয়শা রা: কাছেও বেশ কৌতুহলী মনে হল। কেন মেয়েটি সবসময় একথা বলে! কোন হার? কার হার? আর সেই কুফুরের ঘাটিই বা কোথায়? বিষয়টি নিয়ে আম্মাজানের বিস্ময়ের শেষ নেই। মনে মনে ঠিক করলেন, আজকে তাকে এই কবিতার রহস্য জিজ্ঞাসা করবোই। নিশ্চয় এই দুই চরণের মাঝে তার জীবনের কোন সুপ্ত অধ্যায় রয়েছে।
যথারীতি আজকেও মেয়েটি আম্মাজানের কছে আসলো। বেশ সময় ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হল। বিদায়ের সময় আসন্ন, ঠিক এমন সময় মেয়েটি আবেগজড়িত কন্ঠে বলে উঠলো, “গলার হারের সেই দিনটি আমার প্রভুর নিদর্শনাবলীর অন্যতম, যেদিন তিনি আমাকে কুফুরির ঘাটি থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।” আজকে আম্মাজান আর কোন অপেক্ষা না করেই বলে উঠলেন; আচ্ছা ব্যাপার কি বলতো! তুমি যখনই আমাদের সাথে বস, কথা শেষে এই দুটি কথা না বলে উঠ না। তোমার গলার হারের দিনটি মানে কি? এ কথার পেছনে কিইবা আছে?
কিছুক্ষনের জন্য মেয়েটি একেবারেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। মনে হল, সে যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতির পাখায় ভর করে ভেসে যাচ্ছে বহুদূরে। মুহুর্তেই আবার নিজেকে গুছিয়ে নিল। চোখ দুটো ছল ছল করছে তার। এতো তার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অধ্যায়। তার বদলে যাওয়ার দিন। মরুভূমির কুফুরির ঘাটি ছেড়ে মদিনার ইমানের ঘাটিতে আসার দীর্ঘ উপাখ্যান।
সে বলতে শুরু করলো, আমি ছিলাম আরব মরুর এক গোত্র প্রধানের ক্রীতদাসী। মনিব অনুগ্রহবসত আমাকে আজাদ করে দিয়েছিলেন। যেহেতু আবার জীবন যৌবন সবই তাদের সাথে কেটেছে সুতরাং তাদের ছেড়ে যাব কোথায়? এই ভেবে আমি সেই গোত্রের অবস্থানস্থলের এককোনে একটি তাবু বানিয়ে অবস্থান করতাম। সব কিছুই ঠিক ঠাক চলছিল, এমনকি সেই দিনটি আমার জীবনে আসলো, যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
সর্দারের মেয়ে সেদিন গলায় একটি হার পরে ঘুরতে বের হল। চামড়ার উপর পাথরের কারুকার্জ করা চমৎকার জাকজমকপূর্ণ হারটি। দেখলে যে কারো দৃষ্টি কাড়বে। কিন্তু বেখেয়ালে হারটি তার গলা থেকে খুলে মরুভূমির বালিতে ছিটকে গেল। আর অমনি কোথেকে একটি চিল এসে তা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। মেয়েটির হেয়ালি মন তখনো কিছুই আঁচ করতে পারেনি। সেদিকে কোন খেয়ালই নেই তার। সে তার বান্ধবীদের সাথে খেলাধুলা, আর হাসি আনন্দে বিভোর।
এক সময় সন্ধ্যা নামলো। এখন ঘরে ফেরার পালা। হঠাৎ তার খেয়াল হল, গলাটা কেমন খালি খালি লাগছে। হাত ফেরাতেই চমকে উঠলো। হায়, আমার সেই হারটি? মুহুর্তের চোখে মুখে ধোয়াশা ছেয়ে গেল তার। ঝাপসা হয়ে আসলো চারিপাশ। খোঁজ-খোজ করে আশপাশের লোকগুলোকে জিজ্ঞাসা করেও কোন খবর হলো না। মরুভূমির বালিগুলি পা দিয়ে এপাশ ওপাশ করলো অনেক্ষণ। কিন্তু তাতেও কোন ফল হল না। অগত্যা একরাশ হতাশা নিয়েই তাকে বাড়ি ফিরতে হল।
এটা কি আর দুই এক টাকার জিনিস। দামি পাথরের অলংকার। সর্দারের কানে খবর যেতেই সে চরম বিচলিত হয়ে পড়লো। এত টাকার জিনিস এতো সহজে হারাতে রাজি নয় সর্দার। তার ধারণা এটা কারো অসৎ উদ্দেশ্যের ফল। সে দৃঢ় সংকল্প করলো, যে করেই হোক এই সম্পদ সে উদ্ধার করবেই। যার কাছে পাওয়া যাবে তাকে কঠিন শাস্তির সম্মুখিন করা হবে।
শুরু হলো তল্লাশি অভিযান। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে অভিযোগের তীর সমাজের নিম্নশ্রেনীর মানুষের প্রতিই নিবিষ্ট হয়। সুতরাং আমিই ছিলাম সেই মানুষটি। বিনা দোষে আমাকেই অভিযুক্ত করা হল। আমার শত অনুনয় বিনয় সত্ত্বেও তারা আমার কোন কথাই গ্রাহ্য করলো না। তারা আমাকে ঘর থেকে বের করে গায়ের সব মানুষের সামনে উপস্থিত করলো। আমার তখনও জানা ছিলনা যে, আমার সাথে কি হতে চলেছে। তারা যে এতটা পাশাবিক হবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
প্রথমে তারা আমাকে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করলো। ভয় দেখাল এবং জোরপ্রয়োগ করল। আমি দৃঢ়ভাবে তাদের কথা অস্বীকার করলাম। তারা আমাকে আমার শরীরের কাপড় খুলে তাদের আশ্বস্ত করতে বলল। আমি রাজি না হওয়ায় একপর্যায়ে তারা আমাকে বিবস্ত্র করে ছাড়লো। জনসম্মুখে নিজেকে এভাবে দাড়িয়ে রাখার চেয়ে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। তাদের বিবেকহীনতার কাছে আমি ন্যূনতম মানবিক অধিকারটুকুও পেলাম না। এতে আমি মারাত্মক ব্যাথিত হলাম। চোখ বুজে বোবা কান্না করা ছাড়া আমার কোন সম্বল ছিলনা।
কিন্তু আমার বুকফাটা আওয়াজ কেউ না শুনলেও একজনতো ঠিকই শুনছিলেন। এই চিৎকার পৃথিবীর কারো কান স্পর্শ না করলেও সাত আসমান ভেদ করে পৌঁছে গেল আরশে আজিমে। মজলুমের আর্তনাদ তার কাছে পৌছাতে মাঝে কোন বাধা নেই। তিনি সব দেখলেন। সব শুনলেন। তারপর তার কুদরত প্রকাশ করলেন যা দেখার জন্য সত্যই আমার চোখ প্রস্তুত ছিলনা।
তারা আমার সাথে এই বর্বরোচিত আচরণ করছিল এমন সময় কোথেকে সেই চিলটি উড়ে আসল। তার মুখে সেই হারানো হারটি। মুহুর্তেই সমস্ত কোলাহল নিশ্চুপ মেরে গেল। সবার চোখ চিলটির দিকে স্থির হয়ে রইলো। আমার অশ্রুসজল চোখদুটিও সেই কুদরতের সাক্ষী হল। আমি দেখলাম, চিলটি তাদের আর আমার মাঝখানে হারটি ফেলে দিয়ে আবার আকাশের নীলে বিলীন হয়ে গেল।
সুতরাং কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আমি নির্দোষ। আমার সাথে এ যাবৎ যা হয়েছে তার ব্যাখ্যাও স্পষ্ট হয়ে গেল সবার কাছে। আর আমার অবস্থাতো তখন আরো শোচনীয়। ন্যূনতম মানবিক অবস্থানটুকু হারিয়ে আমি তখন খুবই মর্মাহত। জীবনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি আর তাদের সাথে থাকবো না। চলে যাব দূরে কোথাও। যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকেই। সুতরাং পড়ে থাকা ছেড়া কাপড় টুকরাটি গায়ে জড়িয়ে অজানার ঠিকানায় পা বাড়ালাম।
আমার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। ছিল না কোন গন্তব্য। শুধু সামনের পানে হাটছিলাম। আমার সাথে সৃষ্টিকর্তার ঘটে যাওয়া সেই বিস্ময়ের মাঝে আমি তখনও বিভোর ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম না যে, আমার জন্য তার পক্ষ থেকে আরো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। যা ছিল আমার জন্য প্রথমটি থেকেও বড় প্রাপ্তি।
আমি বুঝতে পারিনি যে, তিনি আমাকে কেবল বিপদমুক্ত করেই ছেড়ে দেননি। বরং তিনি আমাকে নিরাপদ আশ্রয়েও পৌঁছি দিতে চান।
তিনি আমাকে কেবল জুলুমের শহর থেকে মুক্ত করেই ভুলে যাননি। তিনি আমাকে ইনসাফের শহরেও পৌঁছে দিতে চান।
তিনি আমাকে কেবল কুফুরির ঘাটি থেকে বের করেই ক্ষ্যান্ত হননি। তিনি আমাকে ইমানের ঘাটিতেও পৌঁছে দিতে চান।
সুতরাং মহান আল্লাহ আমার গন্তব্যহীন যাত্রা এই ইমানের শহর মদীনাতে নোঙ্গর করালেন। ইমানের মহামূল্যবান সম্পদ দ্বারা তিনি আমার সব অভাব মিটিয়ে দিলেন। উম্মাহাতুল মুমিনীনদের সহচার্য দ্বারা আমার একাকিত্ব দূর করলেন। আর মসজিদে নববীর এই কোনাতেই আমার দুনিয়ার জান্নাত। (সহিহ বুখারীর ৩৮৩৫ নং হাদিস অবলম্বনে)
লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদারাসা, ফুলবড়িগেট, খুলনা।