পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।
কবিগুরুর এই কবিতা শুনাতে আমি লিখতে বসিনি। এখন আমি ঢাকা থেকে খুলনা যাচ্ছি। মাওয়া থেকে লঞ্চে উঠে পদ্মা পার হচ্ছি। লঞ্চের পিঠে চড়ে পদ্মা সেতু দেখছি। লঞ্চের যাত্রীরা অনেকে ছবি তুলছে। কতজনে কত কথা বলছে। আমি একটি ছবিও তুলিনি। এর আগেও পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বহুবার এই নদী পাড়ি দিয়েছি, কিন্তু কোনদিন একটি ছবিও তুলিনি।
ছবি না তোলার বিশেষ কোন কারণ নেই, তবে ছবি তোলার হাজারও কারণ থাকাটাই স্বাভাবিক। হয়তো বয়স ও বাস্তবতা আমাকে ছবি তুলতে তেমন আকৃষ্ট করেনি।
পুলিশের চাকরির সুবাদে আমি দু’বার মুন্সিগঞ্জে ছিলাম। তাই এই মাওয়া ঘাট আমার বহু স্মৃতি বিজড়িত। বিশেষ করে ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় এই পদ্মা নদী পারাপারে মানুষের দুর্ভোগ ও পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মতৎপরতা আমার চোখে এখনও বিভীষিকা হয়ে ভাসে। ঈদ উল ফিতরের সময় সারাদিন রোজা থেকে প্রচন্ড গরমে ঠাঁ ঠাঁ রোদে পুলিশের কষ্ট কাউকে বলে বুঝাবার নয়।
অবশ্য, এত কষ্টের ভেতর ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু কিছু আনন্দ ছিল।
আমি প্রায়ই বলে থাকি, আমি হলাম খুলনার নোয়াখাইল্লা। অর্থাৎ, খুলনার কোন মানুষের সামান্য কোন উপকার করতে পারলে মনে মনে একটু অহংকারবোধ করা আমার অভ্যাস। মাওয়া ঘাট এলাকায় বিভিন্ন উৎসবের সময় দায়িত্বে থাকার সুবাদে খুলনা এলাকার বিভিন্ন মানুষ ঘাট পারাপারের দুর্বিষহ বিড়ম্বনা থেকে পরিত্রাণ পেতে আমার শরণাপন্ন হতেন। কেউ কেউ এই পথে যাতায়াত করতেন রীতিমতো আমার কথা মনে করেই। আবার অনেকে ঢাকা যাতায়াতের পথে আমার কাছে যাত্রাবিরতি করেও আনন্দ পেতেন। বিশেষ করে আমার কাছে এলাকার মানুষের সাক্ষাৎ ছিল বিবাহিতা মেয়েদের বাবার বাড়ির মানুষের সাথে সাক্ষাতের মতো আনন্দদায়ক।
অনেক সময় এলাকার মানুষ বিপদে পড়েও আমার শরণাপন্ন হতেন। আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে ধন্য হতাম।
এসব কথা কেন মনে পড়ছে তা একটু খুলে বলি। আজকাল কাজ কম থাকায় ফেসবুক ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া দেখে সময় কাটাই। সেখানে চিত্তবিনোদনমূলক বিষয়গুলো আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। রাজনৈতিক বিষয় আমি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। তবে বেশ কিছুদিন ধরে একটি বিষয় এড়াতে চাইলেও বার বার চোখের সামনে চলে আসে। সেটা হলো বহু আকাঙ্খিত পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের মন্তব্য এবং পোস্ট। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বেগম জিয়ার কিছু উক্তি।
আমি মূলতঃ কোন রাজনৈতিক দলের সাথে কখনও যুক্ত ছিলাম না, এখনও নই। তবে এই দেশের মানুষ হিসেবে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলে বিবেকের দংশনে জর্জরিত হতেই হবে। সাথে সাথে বেগম জিয়ার অদূরদর্শী বক্তব্যকে নিন্দা জানানোই একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমার দায়িত্ব। এসব কারণেই আমার লেখার শুরুতে কবিগুরুর বঙ্গমাতা কবিতার অবতারণা করেছিলাম। আসলে বাঙালি কবে মানুষ হবে, সে প্রশ্ন আমারও।
এতো সাধের পদ্মা সেতু শত চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে, তবু বাঙালির মন ভরে না। যারা এর সরাসরি সুফল ভোগ করবে তারাও মুখ ফুটে সামান্য ধন্যবাদ দিতেও কুন্ঠাবোধ করে। বরং, উল্টো টিপ্পনী কাটতেও ছাড়ে না। এর নাম বাঙালি।
এখন আবার কেউ কেউ কল্পনা করে বলছে, পদ্মা সেতুতে চীনের কাছ থেকে প্রচুর ঋণ নেওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলছে, পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে যাবে চীন। কেউ কেউ ঢং করে বলছে, টোলের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে গেছে। আমার দৃষ্টিতে এসবই আমাদের হীনমন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কবিগুরুর সেই উক্তি –
রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি।
যাক সেসব কথা। আমি আগেই বলেছি, এই এলাকায় চাকরির সুবাদে আমি অনেক ঘটনার সাক্ষী। আমার আজ আরো মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা, যেদিন বিশ্বব্যাংকের সাথে পদ্মা সেতু চুক্তি হয়েছিল।
আমি তখন শ্রীনগর সার্কেল এএসপি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ঠিক দিন তারিখ মনে নেই। তবে মাওয়া এলাকা আমার আওতাধীন হওয়ায় আমি পদ্মা সেতু সংক্রান্ত প্রায় সকল কাজে, সকল মিটিংএ হাজির থাকতাম। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সকল মিটিং ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো। মাঝে মাঝে কিছু মিটিং হতো মাওয়ায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল পদ্মা নদীর মাঝখানে একটি বিশাল ফেরীতে। চুক্তি স্বাক্ষর উপলক্ষে ফেরীটিকে সম্পূর্ণ নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে অসাধারণ সুন্দর করা হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি সেই সুসজ্জিত ফেরীতে চড়ে পদ্মা নদীর মাঝখানে গিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। উপস্থিত সকল দেশী বিদেশী প্রতিনিধিবৃন্দ মহানন্দে মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছিলেন।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বের এক পর্যায়ে একজন সাংবাদিক বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধির কাছে প্রশ্ন করলেন, “বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র আপনি হয়তো অবগত আছেন। বিশ্বব্যাংক এই কাজে কত পার্সেন্ট দুর্নীতি মেনে নিবে?”
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি বেশ আগ্রহ সহকারে উত্তর দিলেন, ‘জিরো জিরো জিরো।’
ঐদিন সমবেত সকলেই হাতে তালি দিয়েছিলেন। আমিও সেই তালিতে অংশ নিয়েছিলাম। আমি ঐ অনুষ্ঠানে একজন সামান্য নিরাপত্তার দায়িত্বপালনকারী ছিলাম। ওখানে আমার কোন মতামত দেওয়ার অধিকার ছিল না বা কোন ভালমন্দ চিন্তা করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি ছিলাম তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তদারকিতে, তাই বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি কর্তৃক ‘জিরো জিরো জিরো’ কথার মাজেজা বুঝার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু দীর্ঘদিন পর বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অজুহাতে আর্থিক সাপোর্ট দিতে অস্বীকার করলো তখন আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের মনেও সেই ‘জিরো জিরো জিরো’ কথাটা বার বার বেজে ওঠে। মনে হয়, বাংলাদেশকে আর্থিক সহায়তা না দেওয়ার বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের পূর্ব পরিকল্পিত ছিল।
‘শাপে বর’ বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। সেই কথাটি এক্ষেত্রে যথার্থ প্রযোজ্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তাঁর দৃঢ়তা দিয়ে কথাটি আরো ভালভাবেই প্রমাণ করলেন। আমরাও আমাদের দেশের সক্ষমতা উপলব্ধি করলাম।
এখন যদি দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের একুশটি জেলার ভবিষ্যৎ আর্থসামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতুর ভূমিকার কথা চিন্তা করা হয় তাহলে কী দাঁড়ায়?
এইতো কয়েকদিন আগের কথা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম, এবার খুলনা এলাকায় প্রচুর পরিমাণ তরমুজের আবাদ হয়েছিল, কিন্তু অধিকাংশ এলাকার তরমুজ ক্ষেতে পড়েই নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ ঐসব এলাকা থেকে তরমুজ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিতে কৃষকেরা অপারগ ছিল। পদ্মা সেতু চালু হলে কৃষকের সেই কষ্ট দূরীভূত হবে।
এতো গেল তরমুজের কথা। বাস্তবে এর সুফল ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র দেশে। অবহেলিত মোংলা সমুদ্র বন্দর গতি পাবে শতগুণ। সমগ্র দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু দেখাবে নতুন পথ।
আসুন, আমরা সবাই বাঙালির চিরাচরিত বদভ্যাস ত্যাগ করে, ভালকে ভাল বলতে শিখি; খারাপের গঠনমূলক সমালোচনা করি। সর্বোপরি দেশকে ভালবাসি। কবিগুরুর কথাটা ফিরিয়ে দিয়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই।
খুলনা গেজেট/ এস আই