জাতীয়তাবাদ থেকে জাতিরাষ্ট্র গঠনে ব্যক্তির ভূমিকা অপরিসীম। একটি জাতির জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন এবং ইচ্ছাকে একটি জায়গায় নিয়ে এসে তা বাস্তবে রুপ দিতে একজন জাতীয় নেতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথার অবসান ঘটিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে মৈত্রী বন্ধনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয়তাবাদেকে সুসংহত করেছিলেন। অনুরুপভাবে কাওমে নক্রুমা ঘানার স্বাধীনতা, জুলিয়াস নায়ারে তাঞ্জানিয়ার মুক্তি, কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা প্রমূখ জাতীয় নেতৃবর্গ ইতিহাসের তাত্তি^ক ধারাগুলোকে অতিক্রম করে নিজ নিজ জাতির মুক্তিকে নিশ্চিত করেছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই মুক্তি পরবর্তী রাষ্টীয় পুনর্গঠনেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। ইতিহাসের নির্মম গতিধারায় অনেক জাতীয় নেতৃবর্গকে নিজ দেশের দোসরদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে।
আব্রাহাম লিংকনকে উইলকস বুথ ১৮৬৫ সালে ফোর্ডের থিয়েটার হলে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে। সেই হলরুমে একজন লোকও পাওয়া যায়নি আব্রাহাম লিংকনের হত্যাকারীকে সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করার। পরে লিঙ্কনকে অবশ্য হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি মারা যান। পুরো মার্কিন জাতিকে দ্বিধাবিভক্তির মধ্য দিয়ে একত্রিত করলেন যিনি তার হত্যাকান্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমন কোন প্রতিবাদই হল না। কি নীরবে নিভৃতে মানবাধিকারের জয়গান গাওয়া মার্কিন নাগরিকরা সব হজম করলো!
ভারতকে ব্রিটিশ শাসনের যাতাকল থেকে মুক্তির জন্য যিনি সুসংগঠিত সর্বভারতীয় আন্দোলন করেছিলেন তিনি মহাত্মাগান্ধী। ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০), সত্যাগ্রহ এবং অহিংস প্রক্রিয়ায় যে আন্দোলন করে ভারতীয় স্বাধীনতার পতাকা বহন করে পুরো ভারতবাসীর চোখের মণিতে পরিণত হওয়া সেই নেতা হলেন গান্ধীজি। ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে মানুষকে নমনীয় করেছেন, দাঙ্গা বন্ধ করতে অনশন পর্যন্ত করেছেন। অথচ নাথুরাম গডসের আক্রমণে রক্তস্নাত গান্ধীজিকে শেষ চিকিৎসা দেয়ার জন্য একজন ডাক্তার পাওয়া যায়নি বলেও বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যে পাওয়া যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ভারতের জাতির পিতা।
আবার কঙ্গোর জাতীয়তাবাদী নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা বেলজিয়ামের ঔপোনিবেশিক বেড়াজাল থেকে মুক্তি আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ছিলেন। লুমুম্বাকে ১৯৬১ সালে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট এবং সেনাপ্রধান। দেশীয় ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বেলজিয়াম আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশে এই হত্যাকান্ডের পর কঙ্গোর রেডিওতে একটি অপপ্রচার চালানো হয় যে তিনি কোলাটে কারাগার থেকে পালানোর সময় বিক্ষুদ্ধ গ্রামবাসীর হাতে নিহত হন। কঙ্গোবাসী এই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধেও জোড়ালো কোন প্রতিবাদ করেনি বরং ষড়যন্ত্রকারীদের অপপ্রচারকে নির্ধিধায় অনেকটা মুখ বুঝে মেনে নেন।
২৩ বছরের বঞ্চনা থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালির মুক্তির পথ যিনি দেখিয়েছিলেন সেই বাঙালি জাতির পিতার ভাগ্যেও কি নির্মমতা লেপন করা হয়েছিল তা আমরা জানি। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে যার নেতৃত্বদানকারী অবস্থান ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজে স্বাক্ষরিত। জাতির মুক্তির জন্য যে তাত্ত্^িক জাতীয় ব্যক্তিত্বের এবং নেতৃত্বের দরকার তার সামগ্রিক সম্মিলন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে যিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধ এনে দিয়েছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কেউ নন। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন বলেই নাগরিক হিসেবে আমরা যা পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় কোনদিন করে দেখাতে পারতাম না তা করা সম্ভব হচ্ছে। এটা কি ১৯৭৫ সালে অনুমেয় ছিল? নিশ্চই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক কুচক্রীমহল কখনো যুক্তিকে, মুক্তিকে এবং সামষ্টিক অগ্রগতি সহ্য করতে পারে না। ইতিহাসের বাকে বাকে এই ক্ষমতালিপ্সু পাপাচারীরা ষড়যন্ত্র চালায়। স্বার্থান্বেষি দেশী বিদেশী মহল কখনো সাধারণ জনগণের সামগ্রিক মুক্তিকে সহজে মেনে নেয় না। তাই স্বার্থের পথে যাদের কাঁটা মনে করে তাদের সরিয়ে দেয়াটাকে কর্তব্য কাজ মনে করে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাকান্ডের পরও বিশ্বের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দকে হত্যার মত ষড়যন্ত্রকারীরা একটা ভীতির আবহ তৈরি করেছিল। পাশাপাশি দেশী বিদেশী অপপ্রচার বঙ্গবন্ধু এনং তার পরিবারকে অজনপ্রিয় করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল, যেটা পরিকল্পিতভাবে অনেক আগে থেকেই ঘাতকরা শুরু করেছিল। যদি কোন জনপ্রিয় ব্যক্তিকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার মনস্কামনা থাকে তবে এক্ষেত্রে প্রথম প্রচেষ্টা চলে ব্যক্তিকে বিতর্কিত এবং অজনপ্রিয় করে তোলা, যাতে আসল উদ্দেশ্য হাসিল হওয়ার পর প্রতিবাদের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইতিহাসে এটা একটি খুব সাধারণ প্রক্রিয়া।
ভয় আর অপপ্রচারের রাজনীতি ৭৫ এর বাঙালিদের বিবেকশুন্য, অমানবিক আর অন্যায়ের প্রশ্রয়দানকারী স্বার্থপর করে রেখেছিল। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি এবং বাংলার অবিসাংবাদিত নেতাকে যখন সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হল তখন বাংলাদেশে কোন শ্রেনির মানুষের জান এবং মাল নিরাপদ? এই ভয়ই একসময়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ৭ কোটি বাঙালি আবার রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীর যথার্থতা প্রমাণ করেছিল, যা বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর খন্ডন করেছিলেন।
এখানে ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পিত সময়কালও হত্যাকান্ডের প্রতিবাদহীনতাকে প্রভাবিত করে। ১৫ আগস্টকেই কেন তারা বেছে নিল? এখানে একটি সাধারণ কৌশল ছিল ঘাতকদের। যে প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করবে সেটি হল বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগ এবং যে প্রতিষ্ঠানে এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সক্রিয় থাকে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৫ আগস্টের ঠিক পরদিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ঈদ এবং পূজার দীর্ঘ ছুটিতে বন্ধ হয়ে যায়, যা অক্টোবর মাসে খোলা হয়। সুতরাং ছাত্ররা যে আন্দোলন করে সাধারণ মানুষের ভয় ভীতি দূর করে তীব্র প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে সেটা সম্ভব হয়ে উঠলো না। ঠিকই অক্টোবর ১৯৭৫ সালে ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ এবং মানববন্ধন করেছিল।
তারপরও এটা খুব প্রনিধনযোগ্য যে এত বড় একজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে ঘাতকরা হত্যা করবে সেখানে কোন প্রতিবাদ হবে না? এর উত্তরে বলা যায় যে ষড়যন্ত্রকারীদেও বঙ্গবন্ধুকে অজনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা হোক বা বিদেশী অপতৎপরতা হোক এদেশের মানুষের বিবেকের কবর রচিত হয়েছিল।
পরবর্তীতে আরও যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তার বিরুদ্ধেও কোন প্রতিবাদ হয়নি। খন্দকার মেস্তাকের ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ এবং তা আবার আইনে পরিণতকরণ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পদে পদায়ন, অমুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্র ও সরকারে গুরুত্ব প্রদান ইত্যাদি বঙ্গবন্ধু বিরোধী কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই জোড়ালো প্রতিবাদ দেশের জনগণ করেনি। ফলাফল কি হয়েছে? সামরিক শাসনে জনগণের স্বাধীন হয়েও পরাধীন জীবনাচরণ। জেনারেল জিয়াকে ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হতে হয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে। সংবিধানকে বারবার কাটাছেড়া করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রই বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশ তার ইস্পিত লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। ক্ষতি হয়েছে কার ? এদেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন দীর্ঘকাল বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
যেকোন অন্যায়কে নীরবে মেনে নেয়া মানে ভবিষ্যতে আরও বড় বড় অন্যায়কে উসকে দেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদহীনতার সংস্কৃতি সকল জাতীয় অর্জনকে মলিন করে দেয়। ৭৫ এর বর্বরতার পুনরাবৃত্তি এই দেশে যেন আর কোন কালেও না হয়। বঙ্গবন্ধুর বিদেশে থাকা বাকি খুনিদের দেশে এনে বিচারকার্য সম্পন্ন হোক। জাতি অন্তত একটুখানি কলঙ্কমুক্ত হোক। এটাই হোক এই আগস্ট মাসের অঙ্গিকার ।
(লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
খুলনা গেজেট/ টি আই