সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর শোষণ ও নির্যাতন শুরু হয়। পশ্চিমা উর্দূ ভাষীরাই পাকিস্তান শোষণ করতেন। অষ্টান্ন সালে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের রাজনীতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন আসে। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অবঃ) ইসকান্দার মির্জা ক্ষমতাচ্যুত হন। দিনটি সাতাশ অক্টোবর, অষ্টান্ন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল মুহাঃ আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানের রাজনীতিতে লৌহ মানব হিসেবে পরিচিত। নয়া প্রেসিডেন্ট শাসনতন্ত্র বাতিল করে করাচী থেকে ২৮টি বিধি জারি করেন। সামরিক আইনে, দুর্নীতি ও নিরাপত্তা আইনে রাজনীতিকদের গ্রেফতার শুরু করেন। সামরিক আইন জারির পর তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত-শত দেশপ্রেমিক গ্রেফতার হন। ঊনিশশ’ ঊনষাট সালের পঁচিশে অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করেন। মৌলিক গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ছিল না। ইউনিয়ন কাউন্সিলরের মেম্বর ও চেয়ারম্যানদের ভোটে গণপরিষদের সদস্য ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন।
ঊনিশশ’ বাষট্টি ও ঊনিশশ’ পয়ষট্টি সালে এই পদ্ধতিতে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বাষট্টি সালের তের জুন খুলনার খান এ সবুর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রপ্ত হন। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান বাষট্টি সালের চৌদ্দ জুলাই মুসলিম লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার পরামর্শ দেন। আব্দুল কাইয়ুম খান পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। খান এ সবুর যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাধর হওয়ায় খুলনায় মুসলিম লীগের আধিপত্য বাড়তে থাকে। পাকিস্তান জামানার পুরো সময়টা খুলনায় মুসলিম লীগ প্রাধান্য বিস্তার করতো। তাদের শোষণ-নির্যাতন ও গু-াবাহিনীর কারণে এখানকার মানুষ আতঙ্কে থাকতেন। মুসলিম লীগের আক্রমণ ও দখলদারিত্বের কারণে তাদের জনপ্রিয়তা এক সময় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ফলশ্রুতিতে চুয়ান্ন সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন, সত্তর সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সারা দেশের ন্যায় খুলনায় মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। এমনকি আইয়ুব খান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী খান এ সবুর ঊনিশশ’ সত্তর সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৪ (পাইকগাছা) আসনে তৃতীয় স্থানে ছিলেন। এখানে আওয়ামী লীগ মনোনীত মরহুম এম এ গফুর ৭২ হাজার ৮শ’ ৩৪ ভোট পেয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর শামসুর রহমানের প্রাপ্ত ভোট ২২ হাজার ৭শ’ ৯৯।
খুলনা-৫ (সদর, দৌলতপুর ও তেরখাদা) আসনে মুসলিম লীগের মনোনীত আবুল হোসেন হাসান সাহেব নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মুসলিম লীগের এস এম আমজাদ হোসেনের প্রাপ্ত ভোট ৭ হাজার ৬শ’ ৯১। সত্তর সালের নির্বাচনে বৃহত্তর খুলনার ৮টি আসনে ও প্রাদেশিক পরিষদের ১৪টি আসনে মুসলিম লীগ নিকটতম স্থানে আসতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর শোষণ ও বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পাকিস্তানের ৫ লাখ সেনাবাহিনীর মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ২০ হাজার। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে উর্দু ভাষীরা ৫শ’ ৯০ জন মেজর সেক্ষেত্রে বাঙালি মেজর ছিলেন ১০ জন। লেঃ কর্নেলের ওপরে বাঙালি কোনও সেনা কর্মকর্তা ছিলেন না বলা চলে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে ৯শ’ ৫০ কোটি রুপি বরাদ্দ হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে ১ হাজার ৩শ’ ৫০ কোটি রুপি বরাদ্দ ছিল। সচিবলায়ে কোনও বাঙালি সচিব ছিলেন না। ১৯ জন সচিবের সবাই উর্দু ভাষী। উর্দু ভাষী ৩৮ জন যুগ্ম-সচিব, সেখানে বাঙালি যুগ্ম-সচিব মাত্র ৩ জন। উপ-সচিব উর্দু ভাষী ১শ’ ২৩ জন, সেখানে বাঙালি ১০ জন (১৯৫৮ সালের সরকারি প্রতিবেদন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নামক গ্রন্থ)। ঊনিশশ’ আটচল্লিশ থেকে ঊনিশশ’ পঞ্চান্ন সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষাখাতে ১ হাজার ৫শ’ ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মাত্র ২শ’ ৪০ কোটি টাকা। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো।
পশ্চিম পাকিস্তানের চিকিৎসক ১২ হাজার ৪শ’ জন, পূর্ব পাকিস্তানে ৭ হাজার ৬শ’ জন। পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নত সড়ক ৭ হাজার ৫শ’ ৯৫ মাইল, পূর্ব পাকিস্তানে ৭শ’ ৫৭ মাইল। ১৯৫৬ সালে এক জরীপে দেখা যায় ৮শ’ ৯৪ জন সেনা কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি ১৪ জন। পশ্চিম পাকিস্তানে জনসংখ্যা ৫৫ মিলিয়ন আর পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তার চেতনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি মনে করতেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব নয়। নেতাজী সুভাষ বসুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকেন।
বৈষম্য অবসানে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান নৌ বাহিনীর লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে এক দল সৈন্য বিএনএস প্রতিষ্ঠা করে। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য ভারতের সাহায্যের প্রয়োজন হলে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয় (সিরাজ উদ্দীন আহমেদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।
আগরতলায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে কালা চাদর মুড়ি দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গী স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে উঠলেন। ভারতের ত্রিপুরার মূখ্যমন্ত্রী শচীন্ত লাল সিংহ এক বর্ণনায় বলেছেন, কুলাউড়া স্টেশনে নেমে পায়ে হেটে ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ১০জনকে নিয়ে ত্রিপুরার পালন জেলার খোয়াই মহাকুমা দিয়ে আগরতলায় আসেন। ১৫ দিন সেখানে অবস্থান করার পর তিনি ত্রিপুরা ত্যাগ করেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ত্রিপুরা মূখ্যমন্ত্রী শচীন্ত লাল সিংহের সাহায্যে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর সহযোগিতা কামনা করেন। ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই আগরতলায় অনুরূপ এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, একই লক্ষে ১৯৬৫ সালের ১৫-২১ সেপ্টেম্বর করাচীতে বৈঠক হয়। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে করাচীর ইলাকো হাউসে এবং ১৯৬৬ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার ধানমন্ডিতে আরও একটি বৈঠক ধানমন্ডিতে ভারতীয় ডেপুটি হাই কমিশনারের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬৭ সালের ১২ ডিসেম্বর খুলনায় এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট জেঃ মুহাম্মদ আইয়ুব খান বলেন, বিরোধী দল পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রের ধ্বংস চায় (সিরাজ উদ্দীন রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।
১৯৬৫ সালের ১৫-২১ সেপ্টেম্বর কামাল উদ্দীন আহমেদের করাচীর বাসভবনে এবং ১৯৬৫ সালের ১৫-২১ জানুয়ারি করাচীতে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লব প্রয়োজন।
কর্নেল (অবঃ) এম শওকত আলী মিয়া তার সত্য মামলা আগরতলা গ্রন্থে উল্লেখ করেন ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা সম্পর্কে সে সময় বাঙালির মানসপটে যে ভাবনাটি স্থান করে নিয়েছিল এবং যা নিয়ে তারা গর্ব করতো, তা হচ্ছে শেখ সাহেব অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন সামরিক, প্রাক্তন সামরিক ও বেসামরিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করেছিলেন।
সাবেক সেনা প্রধান লেঃ জেঃ মাহবুবুর রহমান তার স্মৃতির পাতা থেকে শেখ মুজিব ও আগরতলা নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানের দুঃশাসন, শোষণ রক্ষার কারণে সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতো না, সামরিকতন্ত্র চর্চা করতেন। সামরিকতন্ত্রের মূল শক্তি পাঞ্জাবী সেনারা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস নোটে বলা হয় আগরতলায় বসে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা হয়েছে। এর সাথে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা জড়িত। ১শ’টি তথ্য প্রমাণ দিয়ে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান’ মামলা দায়ের করে, পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার দেখানো হয়।
১৯৬৮ সালের ১৯ জানুয়ারি করাচীর দৈনিক ডন পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা থাকায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিব জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান টাইমসে শেখ মুজিবুর রহমান ও আগরতলা মামলায় জড়িত শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। আইয়ুব খান ভেবেছিলেন মামলার সাথে আগরতলা শব্দ যোগ করলে শেখ মুজিব ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত এবং তার রাজনৈতিক মৃত্যু হবে। কিন্তু এর ফল উল্টো হল।
নবম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী মিয়া তার সত্য মামলা আগরতলা নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এ মামলার নাম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হওয়া যৌক্তিক নয়। ১৯৬৭ সালের ১২-১৫ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষে ১৯৬৪-৬৭ করাচী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বৈঠক হয়। আগরতলা সফরের ঘটনা কম গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৬৮ সালের ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। অভিযোগ ভারতের অস্ত্র, অর্থ ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এস এ রহমান, সদস্য ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এম আর খান ও বিচারপতি মকসুমুল হাকিম।
আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯ জেলা ফুঁসে ওঠে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ডাকসু, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের অপর অংশ ছিল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সমর্থক। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগের ইউনুস আলী ইনু, নজরুল ইসলাম, জাহিদুর রহমান জাহিদ, হুমায়ুন কবীর বালু, স ম বাবর আলী, আবুল খয়রাত, হাসিনা বানু শিরিন, শেখ আব্দুল কাইয়ুম, ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, ফ ম সিরাজ, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেম, হায়দার গাজী সালাহউদ্দীন রুনু, কাজী শাহনেওয়াজ, মাহবুবুল আলম হিরন, মোশাররফ হোসেন, মোনতাজুল হক, সৈয়দ মনোয়ার আলী, বিনয় ভূষন চ্যাটার্জী, সুশান্ত কুমার নন্দী, শরীফ খসরুজ্জামান, আব্দুস সালাম মোড়ল, সামসুদ্দোহা টিপু, অলোকা নন্দ দাস, আ ব ম নূরুল আলম, ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, মকবুল হোসেন মিন্টু, নূরুল ইসলাম খোকন, কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি এস এম দাউদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর মরহুম কাজী ওয়াহিদুজ্জামান, মরহুম সৈয়দ ঈসা, মরহুম সরদার মঈন উদ্দিন, মরহুম মোঃ লিয়াকত আলী, রনজিৎ কুমার দত্ত, আব্দুল আজিজ মল্লিক, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-এর এ টি এম খালিদ হোসেন, শেখ আব্দুর রশিদ, হেকমত আলী ভূঁইয়া, কৃষ্ণা দাস, শ্যামল সিংহ রায় বাবলু, খুলনা সরকারি মহিলা মহা বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি তৈয়বা খানম, মরহুম নুরুজ্জামান বাচ্চু, কাজী জাহাঙ্গীর আহমেদ, সৈয়দ মতিউর রহমান, আব্দুল মান্নান, শ্রমিক নেতা সরদার মোতাহার উদ্দিন, মরহুম শেখ মনিরুজ্জামান মনি, পঞ্চানন বিশ্বাস, সুভাষ মন্ডল, এন এস এফ এর মাহাবুব উন নুর, জিলানী সাদেক, আব্দুল আজিজ, আব্দুল হালিম, ইব্রাহীম খলিল, খায়রুল ইসলাম।
আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে আটটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি-ডাক নামক জোট। খুলনায় এ জোটের অগ্রভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগের শেখ আব্দুল আজিজ, এম এ বারী, ন্যাপ (ভাসানী)-এর এ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার, ন্যাপ (মোজাফফর)-এর আবু মোহাম্মদ ফেরদাউস, এম এ রব, নজরুল ইসলাম, সামছুদ্দিন সুনু মিয়া প্রমুখ। স ম বাবর আলী রচিত স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছৈ, খুলনায় আওয়ামী লীগের একটি অংশ ‘ম্যাটার অব সাব জুডিস’ বলে আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্রচ্ছন্ন বাঁধা দেয়। তবুও ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে।
ঐতিহাসিক ড. শেখ গাউস মিয়া বাগেরহাটের ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন, ঊনসত্তরের এ গণআন্দোলনে বাগেরহাটের মানুষেরও অবদান কম ছিল না। পূর্ব থেকে আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে একটা তীব্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকলেও ছাত্ররা প্রথমে কোন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
১১ দফাকে সামনে রেখেই সারাদেশের ছাত্রসমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাগেরহাটে ঐ সময় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সৈয়দ হুমায়ুন কবির হিমু, রফিকুল ইসলাম খোকন, এস এম এ সবুর, গাজী খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলী বাবু, সৈয়দ তোসারফ আলী, জলিল গাজী, অশোক দেবনাথ, আমিরুজ্জামান বাচ্চু, আব্দুল মজিদ মোল্লা, আনোয়ার হোসেন, মোফাজ্জেল হোসেন, আলী রেজা কামাল, মোবারক আলী জমাদ্দার প্রমুখ। বাগেরহাটেও তখন এ এন এস এফ-এর কমিটি গঠিত হয়। এ সংগঠনের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন যাত্রাপুরের এম এ আউয়াল (উপজেলা চেয়ারম্যান, ২০০১ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত)। ঐ সময় এ নবগঠিত এন এস এফ-এ বাগেরহাটের আর যারা যোগদান করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কাজী কবিরউদ্দীন, এ্যাডঃ জালাল উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, এ্যাডঃ মোহসিন আলী প্রমুখ।
ছাত্রদের কর্মসূচী ঘোষণার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আওয়ামী লীগ ও দুই ন্যাপ। বাগেরহাটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও তখন স্থানীয় ছাত্র আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। ঐ সময় বাগেরহাট আওয়ামী লীগের প্রধান প্রধান নেতারা ছিলেন শেখ আব্দুর রহমান, খোন্দকার আব্দুল লতিফ, একরামুল কবির, আবদুস সাত্তার খান, শেখ আলী আহমদ, আবুল খয়ের, সৈয়দ অজিয়ার রহমান, আনোয়ার সরদার, মতিয়ার রহমান, পাটোয়ারী, শাহজাহান মল্লিক প্রমুখ। মোজাফফর ন্যাপের নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আতাহার আলী খান, মনসুর আহমদ, এস এম এ সবুর প্রমুখ।
ভাসানী ন্যাপে ছিলেন শেখ আমজাদ আলী গোরাই মিয়া, এ্যাডঃ সামছুল হক, অমূল্য বসু, কাজী আলমগীর, সরদার আব্দুল গণি, এ্যাডঃ উকিল উদ্দিন, মোঃ নাসির উদ্দিন প্রমুখ। বাগেরহাটের কবি সাহিত্যিক ঐ সময় লেখালেখির মধ্যদিয়ে সংগ্রামীদের অনুপ্রাণীত করতে থাকেন। এসব কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কবি আবু বকর সিদ্দিক, মোজাহারুল ইসলাম বাবু মিয়া, আব্দুল বারি ইজারাদার, এ্যাডঃ মীর মোশারফ আলী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। লেখার মাধ্যমে জনসাধারণকে অনুপ্রাণীত করার ক্ষেত্রে তাঁরা পালন করেন এক গৌরবদীপ্ত ভূমিকা।
স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতি কর্মীরাও বিশেষ অবদান রাখেন। এক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন শেখ আমজাদ আলী গোরাই, কবি আবু বকর সিদ্দিক, মহিউদ্দিন মুনসুর প্রমুখ। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ছিলেন শচীন্দ্র নাথ ব্যানার্জী (বাগু ব্যানার্জী), ভূপেশ চন্দ্র আইচ, কালী প্রসাদ চ্যাটার্জী, গৌর কুরী, আব্দুল মান্নান চৌধুরী, ভুপেন্দ্র নাথ, অনিল মল্লিক, ননী মল্লিক, তারাপদ দত্ত, আশীষ নাগ, রাখাল হালদার প্রমুখ। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে নানা ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে জনগণকে উজ্জীবিত করতে থাকেন। টাউন ক্লাব, পিএনজি মাঠ, নাগের বাজার, বাগেরহাট টাউন স্কুল মাঠ প্রভৃতি স্থানে এসব অনুষ্ঠান হতে থাকে। এর এক বড় আকর্ষণ ছিল কবি আবু বকর সিদ্দিক রচিত গণসঙ্গীতগুলো। ঐ সময় তাঁর রচিত এসব গণসঙ্গীত বিশেষ সাড়া জাগায়। শুধু সাময়িক প্রয়োজন নয়-পরে তা কালজয়ী মহিমাও অর্জন করে। এর কিছু কিছু গণসঙ্গীত পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও পরিবেশিত হয়।
১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের ইতিহাসে একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ দিন খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ আফজাল কাহুত বাগেরহাটে আসেন। শহর পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে তিনি সার্কিট হাউস থেকে পিসি কলেজে আসার পথে ছাত্রদের এক জঙ্গী মিছিলের সামনে পড়ে যান। পিসি কলেজ তখন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ছাত্ররা তাঁর আসার পথে বাঁধার সৃষ্টি করে। তাঁর গাড়ির ওপর ইটপাটকেলও নিক্ষেপ করা হয়। তখন সৈয়দ আফজাল কাহুত মিছিলের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ছাত্ররা দৌঁড়ে পালিয়ে গিয়ে কলেজের মধ্যে আশ্রয় নিলেও সেখানে বিভিন্ন কক্ষে আত্মগোপন করা ছাত্রদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে অত্যাচার চালায়।
বাগেরহাট ও খুলনার এই ছাত্র নির্যাতনের খবর গ্রামাঞ্চলে পৌঁছানের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রতিটি এলাকায় বিক্ষোভ-সমাবেশ সংঘটিত হতে থাকে। রামপাল থানার মল্লিকের বেড় ইউনিয়নের বিক্ষোভ-সমাবেশ এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে ঐ ইউনিয়নের বড় সন্ন্যাসী গ্রাম থেকে আইয়ুব আলী হাওলাদার, চিরানন্দ ডাকুয়া, প্রমথ সরকার, মহানন্দ মন্ডল প্রমুখের নেতৃত্বে একটি মিছিল, মিরাখালী গ্রামের আশুতোষ হালদারের নেতৃত্বে একটি মিছিল, বেতকাটা গ্রামের সুনীল মুখার্জীর নেতৃত্বে একটি মিছিল এবং মল্লিকের বেড় গ্রামের রাশেদ গাজীর নেতৃত্বে একটি মিছিল বেতকাটা গ্রামে অবস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে এসে মিলিত হয়। উত্তেজিত জনতা ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস থেকে আইয়ুব খানের ছবি বের করে ভেঙে ফেলে। এরপর জনতা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে থাকে।
সাতক্ষীরার মরহুম মুস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম খান, মোশাররফ হোসেন প্রমুখ ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। দৌলতপুরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। এখানে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন মীর রেজাউল ইসলাম তপন, শরীফ শফিকুল হামিদ চন্দন, গাজী আব্দুল বারী এবং ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপের) প্রকেীশলী শেখ শহিদুল্লাহ এর ছোট ভাই বাবর আলী। ৬৯’র গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ডাঃ ইয়াসিন আলী গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন (খুলনা জেলা আইনজীবীর স্মরণীকা প্রত্যয়-২০১৯-এ এ্যাড. গাজী আব্দুল বারী রচিত দৌলতপুরে ৬৯’র ফেব্রুয়ারি)।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে খুলনার বি এল কলেজ, কমার্স কলেজ, বাগেরহাট পিসি কলেজ ও সাতক্ষীরা কলেজে প্রতিদিন সভা-সমাবেশ হতো। খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরাও মিল ঘেরাও করে এ আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করে তোলে। শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মোঃ আশরাফ হোসেন (পরবর্তীতে বিএনপি’র সংসদ সদস্য), কমরেড নজরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, আনিসুর রহমান, খলিলুর রহমান, দ্বীন মোহাম্মাদ, এস এম সোলায়মান, আলী আহম্মেদ, মোঃ ইসমাইল, বেলায়েত হোসেন, মহিউদ্দিন, আক্তার উদ্দিন প্রমুখ। সে সময়কার শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলনের খবরা-খবর খুলনার সাপ্তাহিক দেশের ডাক, সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চল, সাপ্তাহিক স্বাধিকার ও ওয়েভ নামক পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে ছাপা হতো। দক্ষিণাঞ্চলের বড় শহর খুলনা, মহাকুমা শহর সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে ঐ সময় দৈনিক কাগজ প্রকাশিত হতো না। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। জুলফিকার আলী ভূট্টো ও এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) আজগর খান প্রমুখ পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ সামসুদ্দোহা হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাগেরহাট মহাকুমা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও এর কর্মসূচি ঘোষণা করে। এম কেরামত আলী তখন বাগেরহাট মহাকুমার প্রশাসক। তখনকার সময় কয়েকটি থানা নিয়ে মহাকুমা গঠিত হয়। মহাকুমায় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতেন মহাকুমা প্রশাসক (এসডিও)। বাগেরহাটের সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচী দমন করার জন্য খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ আফজাল কাহুতকে সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। এই আফজাল কাহুত অবাঙালি অফিসার। সংগ্রাম পরিষদ মহাকুমা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও এর আগে জমায়েত শুরু করলে পুলিশ বেধড়ক প্রহার করে। এক পর্যায়ে ছাত্র-পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশের গুলিতে পিসি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র আবু জাফর গুলিবিদ্ধ হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ আফজাল কাহুতের নির্দেশে পুলিশী হামলা ও ছাত্র নিহত হওয়ার খবর খুলনা শহরে এসে পৌঁছায়। অবাঙালি এই অফিসারের বাসভবন ছিল খুলনা শহরের হাজী মহসিন রোডে (কেসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন)। এই অবাঙালি অফিসার অধুনালুপ্ত খুলনা পৌরসভার প্রশাসক হিসেবেও ঐ সময় দায়িত্ব পালন করতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি খুলনার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র জনতার জঙ্গী মিছিল নিয়ে এই সরকারি কর্মকর্তার বাসভবন ঘেরাও করে। সরকারি বাসভবন থেকে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এতে শহরের লন্ড্রী শ্রমিক হাদিসুর রহমান বাবু, কেপিসি কটন মিলের শ্রমিক আলতাফ হোসেন নিহত হয়।
শহীদ হাদিস বাগেরহাট মহাকুমার রণবিজয়পুর গ্রামের আর আলতাফ বরিশাল জেলার সন্তান। ক্ষুব্ধ জনতা বাসভবনটিতে আগুন জ্বালিয়ে দিলে প্রাণের ভয়ে পুলিশ পালিয়ে যায়। মিছিলকারীরা কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুস সবুর খানের সার্কিট হাউসের সামনের বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তৎকালীন ইপিআর (আজকের বিজিবি) গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে রূপসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র প্রদীপ মিস্ত্রী নিহত হয়। এই স্কুল ছাত্র খ্রিস্টান পরিবারের সদস্য, গোপালগঞ্জের চৌরখালী গ্রামের সন্তান। জনতা পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রী এস এম আমজাদ হোসেনের বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ হত্যাকান্ডের পর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় “খুলনায় ৮ জন নিহত, সান্ধ্য আইন জারী, সেনাবাহিনী মোতায়েন” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ নেতা মরহুম হাসান রুমি (জেলা ক্রীড়া সংস্থার এক সময়কার অবৈতনিক সাধারণ সম্পাদক), ছাত্রলীগের শহর শাখার সভাপতি হুমায়ুন কবীর বালু (স্বাধীনতা পরবর্তী দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক), ছাত্র ইউনিয়নের শহর শাখার সভাপতি মোঃ লিয়াকত আলী (স্বাধীনতা পরবর্তী দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক), মালিক আতাহার উদ্দিন (বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ) ও হাবিবুর রহমান ঢাকা সুইটসে বসে মিউনিসিপ্যাল পার্কের নাম হাদিস পার্ক রাখার প্রস্তাব করেন। হুমায়ুন কবীর বালুর প্রস্তাবে লিয়াকত আলী হাদিস পার্ক নামকরণ সম্বলিত পোস্টার লেখেন। পার্কের সামনে এই পোস্টারটি সাঁটানো হয়। এই ছবিটি খুলনার সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চল, দেশের ডাক ও ওয়েভ পত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বামপন্থী নেতা সুন্দরবন কলেজের অধ্যাপক খালেদ রশিদ হাদিস পার্কের শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। খালেদ রশিদ সেতু নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে ডুমুরিয়া এলাকায় শহীদ হন। ২২ ফেব্রুয়ারি খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক জনসভা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী ওয়াহিদুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় জিন্নাহ মিউনিসিপ্যাল পার্কের নাম হাদিস পার্ক ও পৌরসভার একটি মিলনায়তনের নাম আলতাফ মিলনায়তন করার প্রস্তাব রাখা হয়। খালিশপুর আলমনগর এলাকায় এ আন্দোলন তীব্র হয়। এখানে এক সমাবেশে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পরবর্তীতে শ্রমিক নেতা নিজামুর রহমান লালু আলমনগর বাজারকে হাদিস নগর নামকরণের প্রস্তাব করেন।
তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে মামলা থেকে অব্যহতি দেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান।
আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের মধ্যদিয়ে বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয় হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এক সংবর্ধনায় ডাকসুর ভিপি, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট জেঃ মোঃ আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। দেশে ফিরে ১৩ মার্চ ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি-ডাক নামক ফ্রন্টের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
দৈনিক আজাদের প্রথম পৃষ্ঠায় ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি সংখ্যার শিরোনাম :
“খুলনায় সংঘর্ষে ৫ জন নিহত শিল্প এলাকায় ৩১ ঘন্টা কার্ফু জারী…”
“সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি।”
২০ জানুয়ারি আসাদ শহীদ হওয়ার পর খুলনায়ও তার জোর প্রতিক্রিয়া হয়। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে খুলনায় প্রত্যেক দিনই কোনও না কোন দলের মিছিল-মিটিং থাকতো। একদিন ধর্মঘটের পিকেটিংকালীন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির হেকমত আলী ভূঁইয়াকে ফেরীঘাট রোড ও যশোর রোডের মোড়ে বিহারী গুন্ডারা ছুরিকাঘাত করে। এই আক্রমণে কয়েকজন আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তার মধ্যে হেকমত ভূঁইয়ার আঘাত গুরুত্বর হয়। নিরাময় হতে দীর্ঘদিনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। দৈনিক আজাদের ২৬ জানুয়ারি সংখ্যায় এ সংবাদ প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়। “খুলনা ফেরীঘাট রোডে কতিপয় ব্যক্তি কর্তৃক ২ জন ছাত্র ছুরিকাঘাত” সংবাদে ২ জন ছাত্রের কথা লেখা হলেও দ্বিতীয় জনের নাম আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। ছাত্র নেতৃবৃন্দের ওপর ছুরিকাঘাত এই সংবাদটি প্রচারিত হওয়ার পর এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্র ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আজিজের নেতৃত্বে একটি বিরাট মিছিল ফেরীঘাট রোডে বিহারীদের কয়েকটি দোকান তছনছ করে দেয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালিদের ফেরীঘাট এলাকায় প্রথম মিছিল এটা।
ঘটনাটির বর্ণনা খুব সংক্ষিপ্ত হলেও এর তাৎপর্য এবং গভীরতা ছিল অনেক বেশি। ঐতিহাসিক এ এফ এম আব্দুল জলীল ঘটনাটি সম্পর্কে লিখেছেন- “খুলনার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা বলবো। ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েকদিন আগে শোভাযাত্রীরা যশোর রোডে অবস্থিত কয়েকটি ঘর পুঁড়িয়ে দেয়। চারদিকে উত্তেজনা। আমরা খবর পেয়ে প্রায় বিশ জন এ্যাডভোকেট সেদিকে যাত্রা করি। পথে ডিসি ও এসপির সাথে দেখা হলো। তারাও আমাদের সহযোগিতার জন্য খুশী। বললেন আপনারা সাহায্য না করলে পারছি না। ডাক বাংলার মোড় গিয়ে দেখি হাজার-হাজার ছাত্র জনতা। অনেকে এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। কেউ বক্তৃতারত। অনেকে শুনছে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে।
কিছুক্ষণ আগে একটা বিরাট মিছিল এদিকে এসেছিল। শোভাযাত্রার ওপর আক্রমণের জন্য সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। যেন এক প্রলয় কান্ড। এ্যাডভোকেট এ এইচ দেলদার আহমেদ ও এ্যাডভোকেট জব্বারসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সেখানকার ছাত্র ও জনতাকে সঙ্গে নিয়ে পার্কের দিকে যাত্রা করলেন। ওরা একেবারে মারমুখো। আমি ওখান থেকে ফেরীঘাটে যাত্রা করি। আমাকে সবাই নিষেধ করে, একজন সাংবাদিকও। আমি সব বাঁধা এড়িয়ে ওদিকে যেতে থাকি। ওখানে নাকি ছাত্রদের ছুরি মেরেছে। সে জন্যই আমাকে বারবার নিষেধ করা হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন এ্যাডভোকেট আব্দুস সাত্তার, এ্যাডভোকেট মুনসুর আলী ও এ্যাডভোকেট আহম্মদ আলী (এ ওয়াই আহম্মদ আলী)। ফেরীঘাটে পৌঁছে দেখি চারদিকে বিশাল জনতা। সঙ্গে ঢাল তলোয়ার কিছু নেই। কারও হাতে দু’একখানা কাঠের টুকরো। জনতা ক্ষেপে গেছে। ফেরীঘাটের বাড়িঘর আক্রমণ করবে। দেখলাম মানুষ সামান্য কারণেও মরতে জানে। তারা মরিয়া হয়ে লড়বার চেষ্টা করছে। সেখানে ডিসি ওয়ারেশ আলী চৌধুরী, এসপি এস এ হাকিম ও পুলিশ বাহিনী উপস্থিত। উভয়ের সাথে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব। এর মধ্যে সংঘর্ষের সংবাদ আসছে। ওদের সঙ্গে এক বাড়িতে ঢুকে প্রবেশ পথে দেখলাম অনেকখানি রক্ত পড়ে আছে। এক ব্যক্তিকে ওখানে ভীষণ মারধোর করেছে। চারিদিক থমথমে। ১১ জন রাইফেলধারী পুলিশ জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে উদ্যত। জনতাও বেপরোয়াভাবে এগিয়ে আসছে। গুলি করার আদেশ দেয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি সামনে যেয়ে হাত উঁচু করে বললাম দেরী করতে। তখন ওদিকে জনতাকেও থামিয়ে দিলাম। ঐ সময় এস এম এ মোত্তালিব, খোন্দকার আব্দুস সামাদ প্রমুখ আমাকে বিশেষ সাহায্য করেছিলেন। ভাগ্যিস সেখানে আমরা উপস্থিত ছিলাম আর ভালো অফিসার ছিলেন। মেজাজী কেউ হলে বেশ অঘটন ঘটে যেত। সেদিনের ঘটনায় ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে দু’টি ফৌজদারী মোকদ্দমা হয়। অসংখ্য আসামি ছাত্র জনতার মধ্যে কারা হাঙ্গামা করলো আর ঘর পোড়ালো? আসামি হলাম আমরা! আমি হলাম এক নম্বর আসামি। দু’নম্বর আসামি ছিলেন ন্যাপ (ভাসানী)-এর এ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার।”
বৃটিশ আমলে ফেরীঘাট (বর্তমানে খানজাহান আলী) রোডের উত্তর প্রান্তে দেহপসারিণীদের আবাসস্থল ছিল। পকিস্তান হওয়ার পর কলকাতার বিহারীরা এসে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে এবং শহরে প্রাধান্য বজায় রাখে। এই বিহারীদের ধারণা এবং বিশ্বাস- এদেশের লোক যখন ঘুমিয়েছিল তখন তারা রক্ত দিয়ে পাকিস্তান বানিয়েছে। সুতরাং পাকিস্তানের সব রকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে তারাই অধিকারী এবং পাকিস্তান রক্ষা করাও তাদের দায়িত্ব। তারা সব সময় পাকিস্তান অর্জনকারী মুসলিম লীগ ছাড়া আর কারও রাজনীতি বুঝতে চায়নি। মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের ইঙ্গিতে বাঙালি জাতির প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। খুলনায় রাজনীতিতে তারা ছিল সবুর খানের ডান হাত। একাত্তরে তার চরম প্রকাশ ঘটে। যার ফলে এদেশ থেকে তারা প্রায় উৎখাত হয়ে গেছে। তারা কখনই এদেশের মাটি, কৃষ্টি, কালচার ও ভাষা দীর্ঘদিন বসবাস করেও গ্রহণ করতে পারেনি।
১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী রাজশাহীতে প্রফেসর ড. জোহাকে গুলি করে হত্যা করে। জনতার রুদ্ররোষ আরও অগ্নিমূর্তি ধারণ করে।
খুলনায় আন্দোলনের চরম অবস্থা ঘটে ২১ ফেব্রুয়ারি । হাজী মহসীন রোডস্থ পৌরসভা চেয়ারম্যানের বাসভবন ও সার্কিট হাউজের সামনে গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ায় খুলনার ছাত্র জনতা ফুঁসে ওঠে। আন্দোলনরত ছাত্র জনতা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ আফজাল কাহুতকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা করে।
ওই বছরই ২১ ফেব্রুয়ারি ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হয়। পূর্বের যে কোনও বছরের চেয়ে অধিক জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হবে বলে আভাস-ঈঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। শহরের সর্বত্র এমন প্রচার হয়। পাড়ায় পাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে। খুলনায় পূর্বে কোন স্থায়ী শহীদ মিনার ছিল না। সংস্কৃতি কর্মী ও ছাত্ররা মিছিল করে এসে পৌর পার্কে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাত। তখন পর্যন্ত পাড়া থেকে প্রভাত ফেরী এসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর রেওয়াজ হয়নি।
২২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকার ১ম পৃষ্ঠায় মাত্র দু’টি সংবাদ পরিবেশন করে। প্রথমটি ৮ কলামব্যাপী ঢাকার শহীদ দিবসের সংবাদ, দ্বিতীয়টি কাগজের মাঝামাঝি ৫ কলামব্যাপী খুলনা সংবাদ।
জনতার হাতে পুলিশের মৃত্যু, ৮ জন নিহত ৫০ ব্যক্তি আহত” শীর্ষক খবরে বলা হয়- ২০ হাজার জনতা খান এ সবুরের বাসভবনে অগ্নিবর্ষণ করলে গুলি বর্ষণে ২ ব্যক্তি নিহত হয়। ৪২ ঘন্টা সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এডিসি ও শিক্ষা উজির আমজাদ হোসেনের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ, বুলেট বিদ্ধ হাদিসুর রহমানকে হাসপাতালে নেওয়ার অল্পক্ষণ পর মারা যায়। বেসরকারি সূত্রে বলা হয় যে, খুলনায় অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার আফজাল কাহুতের বাসভবনের সম্মুখে এক দুর্ঘটনা ঘটে। খবরে বলা হয় শহীদ দিবসের এক বিরাট শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা কাহুতের বাড়ির ইংরেজিতে লিখিত নামফলক নামিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু উক্ত বাড়ির কয়েকজন লোক শোভাযাত্রার ওপর একটি হাতবোমা অথবা পটকা নিক্ষেপ করা হয়। এতে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রাটি বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। এডিসি কাহুতের বাসভবনে মোতায়েন পুলিশ বাহিনী গুলিবর্ষণ করলে বহুলোক আহত হয়। আহতের মধ্যে জনৈক হাদিসুর রহমান পরে হাসপাতালে মারা যায়।
ইংরেজি দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় এ সংবাদটি বিশদ আকারে ছাপা হয়। ঐ ঘটনার পূর্বে জানুয়ারি মাসেও খুলনার কয়েকটি সংবাদ পরিবেশিত হয়। এসব সংবাদে সেদিনকার দেশের অবস্থা কি রকম বিস্ফোরণমুখী ছিল তার কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। দৈনিক অবজারভার পত্রিকার রিপোর্টার আবু সাদেক সংবাদগুলো প্রেরণ করেন।
পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ৫ম পৃষ্ঠায় ২২ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে “নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় লাঠিচার্জ” শীর্ষক খবরে ছিল- “খুলনার ছাত্ররা গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সাধারণ জনসাধারণের ওপর পুলিশ গত শুক্র ও শনিবার যে নির্যাতন চালায় তার প্রতিবাদে এক বৃহৎ গণসামবেশ করে। ঐদিন সকালে ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে এবং ছাত্ররা তাদের স্ব-স্ব বিদ্যালয়ে যোগদান থেকে বিরত থাকে”।
ঐ একই দিনের ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় দৈনিক অবজারভারে খবর ছিল- “খুলনা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা সমিতির প্রাঙ্গণে এক জরুরি সভায় মিলিত হয় এবং গত সোমবার ঢাকায় পুলিশ একশনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় খাদ্য মন্ত্রী এবং সমিতির সভাপতি এ এইচ দেলদার আহমেদ উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন।”
ঐদিন ডবল কলামের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়- খবরের শিরোনামে ছিল : “খুলনা ও নারায়ণগঞ্জে কার্ফু জারী, ঢাকায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি”। ২২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ১ম পৃষ্ঠায় শহীদ দিবসের সংবাদের পরই বড় কলামে খুলনা সংবাদের শিরোনাম ছিল।
8 killed in Khulna. Curfew imposed :
সংবাদ অনুবাদ : “খুলনায় ৮ জন নিহত, সান্ধ্য আইন জারী, সেনাবাহিনী মোতায়েন” খবরে ছিল “খুলনা ২১ ফেব্রুয়ারি ৮ ব্যক্তি নিহত ও অন্যান্য ২৭ জন বুলেটবিদ্ধ। পুলিশ অদ্য এখানে জনতার জঙ্গি মিছিলের ওপর তিন-তিন জায়গায় গুলিবর্ষণ করে। নিহত চারজনের লাশ খুলনার সদর হাসপাতালে আনা হয়। বাকি নিহতের লাশ জনতা জোরপূর্বক নিয়ে যায়। ১ জন নিহতের লাশ হসপিটালে আনা হয়। ৪২ ঘন্টা কার্ফু জারী, বে-সামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী তলব। গোলযোগে নিহত ৮ জনের মধ্যে পাঁচ জনের নাম : লোকনাথ, জহুরুল হক, প্রদীপ, হায়দার আলী ও জমিরউদ্দিন (পুলিশ কনস্টেবল)। বুলেটের আঘাতে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের নাম : আব্দুল খালেক, নজরুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, ইউনুস আলী, কাজী লতিফুদ্দিন, ইউছুপ আলী, লুৎফর রহমান, প্রপুদাম, বাহারুল আলম, এম এস বজলুর রহমান, শওকত হোসেন, মলয় কুমার ঘোষ, খলিলুর রহমান, সেকেন্দার আলী, রাজ্জাক আলী হাওলাদার, মাহবুবুর রহমান, খাদেম আলী, আব্দুল মজিদ, খবির ব্যাপারী, ইসমাইল ও শেখ সাঈদ আলী। গোড়ার দিকে এক বৃহৎ জনতা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সৈয়দ আফজাল কাহুতের বাসভবন আক্রমণ করে। বাগেরহাটে গত ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সরকারি এই কর্মকর্তা। এর বিরুদ্ধে ছাত্ররা প্রতিবাদ করে আসছিল। জনতা একজন স্থানীয় এম এল এ’র বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে ১ জন পুলিশ নিহত ও অন্যজনকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ।
গুলিবর্ষণ : সকাল ১০টা ৩০মিনিটের এর সময় যখন কয়েক হাজার জনতা শহীদ দিবস উপলক্ষে একটি মিছিল হাজী মহসীন রোড দিয়ে যাচ্ছিল তখনই ঘটনার শুরু। যখন জনতা এডিসি’র বাড়ির সম্মুখ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন জনতার একটি অংশ এ বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে মারছিল। এডিসি ও তার পরিবার তখন ঐ বাড়িতে ছিলেন না। বাড়িতে পাহারারত ৬ জন পুলিশ গার্ড ঢিল নিক্ষেপকারী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ২ জন নিহত ও অন্য ১৩ জন আহত হয়। তার মধ্যে একজন স্কুল ছাত্রও গুলিবিদ্ধ হয়। মৃত দু’জনের মধ্যে খুলনা টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক আলতাফ এবং খুলনার একটি লন্ড্রীর কর্মচারী হাদিস বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে সেন্ট যোসেফ্স স্কুলের ছাত্র ৬ বছর বয়সী প্রভুদাস অন্যতম। গুলিবর্ষণের পর একদল মিছিলকারী লাশগুলো অন্যত্র নিয়ে যায় এবং ক্রোধোন্মুক্ত আর একদল দ্বিগুণ হৈ চৈ করে বাড়িটি আক্রমণ করে। পুলিশ পালাতে চেষ্টা করলে জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং রাগন্বিত জনতা তাদের মারধোর করে। আঘাতপ্রাপ্ত একজনের মৃত্যু হয় এবং বাকি পাঁচজনকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। অশান্ত জনতা তখন প্রশাসকের বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং জনতার মধ্যে কয়েকজনের নিহত হওয়ার সংবাদ বন্দর নগরীতে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে। দুপুর ১টার দিকে খালিশপুর পাটকলের বিশ হাজার শ্রমিক জনতার মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করতে পৌর পার্কে জমায়েত হয়। মিছিলকারী নেতারা এ বিরাট জনতা পৌরসভা পার্কে ধরা সম্ভব নয় মনে করে তারা সার্কিট হাউস ময়দানে জানাজা পড়ার জন্য লাশ নিয়ে অগ্রসর হয়। ইপিআর বাহিনী তখন সার্কিট হাউস ময়দানে ঢোকার পথে এবং কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুরের বাড়ির সামনে যশোর রোডে পাহারারত ছিল। মিছিলের নেতৃবৃন্দ সার্কিট হাউস ময়দানে লাশের জানাজা পড়ার জন্য ইপিআর বাহিনীকে একটু দূরে সরে যেতে অনুরোধ করে। জনতার সংখ্যা দেখে বাহিনীর সদস্যরা দূরে সরে যেয়ে খুলনা ক্লাবের সম্মুখে অবস্থান নেয়।
বেলা প্রায় আড়াইটার সময় নামাজে জানাজার পর মিছিলকারীরা লাশ বহন করে শহরের দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ করে মিছিলের মধ্যের একদল জনতা খান এ সবুরের বাড়ি ঢুকে পড়ে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। ইপিআর বাহিনী দ্রুত বেগে এসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলে একজন (অপরিচিত) নিহত হয়। আঘাতপ্রাপ্ত লোকনাথ হসপিটালে মৃত্যুবরণ করে। গুলিতে ছাত্র জনতার অনেকেই আহত হয়। সাত জন হসপিটালে ভর্তি হয়।
দৌলতপুর : “অসমর্থিত খবরে প্রকাশ, বিকেল ৪টার সময় দৌলতপুরে পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। ঐ সময় পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। জনতা প্রাদেশিক এ্যাসেম্বিলির একজন সদস্যের বাড়ি ও দৌলতপুর তহশীল অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়”। এখানে এম এল এ-এর কোন নাম দেয়া না হলেও তিনি এস এম আমজাদ হোসেন, প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রী, তার বাড়িটি পুঁড়িয়ে দেয়। দৈনিক আজাদ ও অবজারভার পত্রিকা দু’টিতে ৮ জন নিহত হওয়ার কথা লেখা হয়। “আসাদ ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান” গ্রন্থেও মৃতের সংখ্যা ৭ জনের কথা উল্লেখ আছে। তাদের নাম- দৌলতপুরের নৈশ বিদ্যালয়ের ছাত্র মাহাতাব আলী, ইস্রাফিল বন্দো (শ্রমিক), আব্দুস সাত্তার (ছাত্র), আলতাফ (শ্রমিক), হাবিবুর রহমান (শ্রমিক), নাসির আলী (শ্রমিক), লোকনাথ (শ্রমিক) প্রমুখ (মেসবাহ কামাল রচিত আসাদ ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ১৪৯ পাতা)। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, কিন্তু আজ আমরা অনেক অনুসন্ধান করেও ১জন পুলিশসহ ৪জনের বেশী মৃতের সংখ্যা পাইনি এবং তাদের পরিচয়ও জানতে পারিনি। ৪জনের মৃতের মধ্যে হাজী মহসীন রোডে ১জন পুলিশসহ ৩জন এবং খান এ সবুরের বাড়ির সামনে ১জন। তারা কোথায় মারা যায় তা নিয়েও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পেয়েছি। এমনকি পত্রিকায় রিপোর্ট দু’টিও এক নয়। কাগজের রিপোর্ট এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রতক্ষ্যদর্শীর মতামত অনুযায়ী হাজী মহসিন রোডে পুলিশসহ হাদিসুর রহমান ও প্রদীপ এবং যশোর রোডে খান এ সবুরের বাড়ির কাছে আলতাফ শহীদ হন। অবজারভার পত্রিকায় ও মেজবাহ কামাল লিখিত প্রবন্ধে নিহতদের মধ্যে লোকনাথ, জহুরুল হক, হায়দার আলী, ইস্রাফিল বন্দো, হাবিবুর রহমান ও নাসির আলীর পরিচয় আমরা উদঘাটন করতে পারিনি। আহতের সংখ্যা শতকের ওপর হলেও আজ আর তাদের সন্ধান পাওয়াও যাচ্ছে না। ঐতিহাসিক এএফএম আব্দুল জলিল লিখেছেন- আহতদের মধ্যে অনেকেই পুলিশ কেসের ভয়ে হসপিটালে ভর্তি না হয়ে প্রাইভেট ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নেয়। অবজারভার পত্রিকায় যে ২২জনের নাম দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র ৩জনের পরিচয় পাওয়া যায়। খানজাহান আলী রোডের রাধু ঘোষ এর পুত্র মলয় কুমার ঘোষ ছিল আমার প্রতিবেশী। মলয় কুমার এর হাটুর নীচে গুলি লেগে হাড় ভেঙ্গে যায়। চিকিৎসা হতে অনেক খরচা ও অনেক দিন সময় লাগে। মলয় ছিল কলেজের ছাত্র এবং ভালো ক্রিকেট প্লে¬য়ার। অপরজন গোপালগঞ্জ মহাকুমার ছোটফা গ্রামের শেখ সাঈদ আলী। তিনি জুট মিলে চাকরি করতেন। খুলনায় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধু জীবনের নানা দিক তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালান। তিনি একজন পল্লী গীতি গায়ক এবং অনেকগুলো পল্লী গীতি ও দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছেন ও সুর দিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর একজন লতিফউদ্দিন। তখন ছিল ছাত্র, এখন সহকারী প্রকৌশলী। সেদিন যারা নিহত হলেন তারা তো শহীদ হলেন, কিন্তু যারা আহত হলেন তারা কিন্তু রেহাই পেলেন না, তাদের ৪০/৫০ জনের বিরুদ্ধে সরকার বাদী হয়ে হত্যা, লুণ্ঠন, ঘর জ্বালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করে। মামলা চলতে থাকে, আসামিদেরও দিনের পর দিন কোর্টে এসে হাজিরা দিতে হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কেসটি প্রত্যাহার হয়নি। অনেক পরে স্বাক্ষীর অভাবে খারিজ হয়। তারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
উনিশশ’ ঊনসত্তর সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ডেইলী মর্নিং নিউজে এপিপি ও পিপিআইএর বরাদ দিয়ে “8 killed in Khulna disturbances : Army called in. 42hrs, curfew,” শিরোনামের সংবাদ প্রকাশিত হয়। মর্নিং নিউজের প্রতিনিধি এমএস ওয়ার্সী ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক। তিনি ১৯৭১ সালে স্থানীয় পীচ কমিটির সদস্য ছিলেন।
আজ থেকে একান্ন বছর আগে এখানে গণমাধ্যম কর্মী ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। দৈনিক পাকিস্তানে প্রতিনিধিত্ব করতেন মনিরুল হুদা, পাকিস্তান অবজারভারে আবু সাদেক, এপিপিতে আশরাফ উদ্দিন মকবুল, হলিডেতে শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মর্নিং নিউজে এম এস ওয়ার্সী, দৈনিক আজাদে মুহাম্মদ নুরুজ্জামান, বাগেরহাটে অবজারভারের এবিএম মুশারফ হুসাইন, দৈনিক পাকিস্তানের এস এম মাহির উদ্দিন, ইত্তেফাকের ডাঃ মুজিবর রহমান, মর্নিং নিউজের গাজী আব্দুল জলিল, দৈনিক সংবাদের অমূল্য কুমার বোস ও সাতক্ষীরায় অবজারভারের আব্দুল মোতালেব। তখনকার দিনে খুলনায় কোনও দৈনিক পত্রিকা ছিল না। সৈয়দ সোহরাব আলীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক জনবার্তা, মাহমুদ আলম খানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক স্বাধিকার, লিয়াকত আলীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চল, কেবিএম মাহমুদের সম্পাদনায় ইংরেজি সাপ্তাহিক ওয়েভ, সৈয়দ একে কবিরের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বিশ্বডাক, লুৎফর রহমান জাহানগীরের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক দেশের ডাক, নাজিম সেলিম বুলবুলের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক হট কেক, আবু মোঃ দাউদের সম্পাদনায় মাসিক দিশারী, লুৎফর রহমানের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক গণবাণী, হাসান আজিজুল হকের সম্পাদনায় মাসিক সন্দীপন, মঈন পায়ামীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সানডে নিউজ, কাজী ফারুক আহমেদের তত্ত্বাবধায়নে সাপ্তাহিক সংহতি, লুৎফর রহমান জাহানগীরের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক এলার্ম, পিপলস্ অবজারভার অধ্যাপক খালেদ রশীদের সম্পাদনায় মাসিক সেতু পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোড থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিশ্বডাক ছিল অনিয়মিত।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে-বিপক্ষে কোন ভূমিকা ছিল না। মোঃ লিয়াকত আলীর সম্পাদনায় ১৯৬৮ সালের ১৭ মার্চ সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চল প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের খুলনা শহর কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবীর বালু সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চলের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও আগরতলা মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের দাবিতে পূর্বাঞ্চলের ভূমিকা ছিল সোচ্চার। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হাজী মহসিন রোডে হাদিস শহীদ হওয়ার পর ‘মিউনিসিপ্যাল পার্কের’ পরিবর্তে ‘হাদিস পার্ক’ নামকরণে পূর্বাঞ্চল সম্পাদক লিয়াকত আলী ও হুমায়ুন কবীর বালু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। সরকার সুইটসে বসে তারা হাদিস পার্ক নামে একটি পোস্টার লিখে পার্কের মধ্যবর্তী স্থানে সাঁটিয়ে দেন। এই ঐতিহাসিক ছবিটি সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চল, ওয়েভ পত্রিকা ও দেশের ডাকে ছাপা হয়। লুৎফর রহমান জাহানগীরের সম্পাদনায় ১৯৬৪ সালের ১৭ অক্টোবর সাপ্তাহিক দেশের ডাক প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে সাপ্তাহিক দেশের ডাকে কয়েক দফা প্রধান শিরোনাম প্রকাশিত হয়।
সংবাদপত্রের স্বাধীন মতামত কেড়ে নেয়ার জন্য আইয়ুব খান সরকার ৬, ১৭ ও ১৯ ধারা জারি করে। এ ধারায় বলা হয় পত্র-পত্রিকায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি, ছয় দফা ও আগরতলা মামলা ইত্যাদি নিয়ে উস্কানীমূলক সংবাদ ছাপা হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। সাপ্তাহিক দেশের ডাক এ ধারা উপেক্ষা করে সাহসী ভূমিকা রাখে। গণঅভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে নানা প্রতিবেদন ছাপা হয়। মাহমুদ আলম খানের সম্পাদনায় ধর্মসভার দক্ষিণ পার্শ্বের ভবন থেকে সাপ্তাহিক স্বাধিকার প্রকাশিত হতো। সম্পাদক ন্যাপ (ভাসানী)-এর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শহীদ আসাদের মৃত্যুর পর সাপ্তাহিক স্বাধিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। মূলতঃ কৃষক রাজ, শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে জনমত গঠন এ পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য।
মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী অধ্যাপক খালেদ রশীদের সম্পাদনায় মাসিক সেতু পত্রিকাটি গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নেয়। পত্রিকাটি বামপন্থীদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। কাজী ফারুকের তত্ত্বাবধায়নে ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক সংহতি প্রকাশিত হয়। এটি কৃষক, শ্রমিক, কমিউনিস্ট কর্মীর সংঘের মূখপাত্র। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দর্শনে বিশ্বাসী। সৈয়দ সোহরাব আলীর সম্পাদনায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুলাই সাপ্তাহিক জনবার্তা প্রথম প্রকাশিত হয়। মুসলিম লীগের আর্থিক সহযোগিতায় জনবার্তার প্রথম প্রকাশনা। ১৯৬৮ সালের শেষদিকে প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য সরকারের উন্নয়নের ১০ বছর নামে সাপ্তাহিক জনবার্তার ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খানের উন্নয়ন তৎপরতার বর্ণনা দিয়ে জনবার্তা এ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। ১৯৬৯ সালে জনবার্তার ভূমিকা ছিল মুসলিম লীগের পক্ষে। এ সাপ্তাহিকটি ছয় দফার সমালোচনা করতো। লুৎফর রহমানের সম্পাদনায় ১৯৬৮ সালে শহরের রায়পাড়া ক্রস রোড থেকে সাপ্তাহিক গণবাণী প্রকাশিত হয়। মার্কসবাদী দর্শনে বিশ্বাসী বদর উদ্দিন ওমর, রনেশ দাস গুপ্ত ও সাংবাদিক নেতা সৈয়দ জাফর এ পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা নেয়ায় অবজারভারের দৌলতপুরের প্রতিনিধি কাজী আব্দুল খালেক এবং সাপ্তাহিক আওয়াজ পত্রিকার সাংবাদিক আজীজ খান ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হন।
খুলনা গেজেট / এমএম