খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯৯০
  কিশোরগঞ্জের ভৈরবে বাসা থেকে ২ সন্তানসহ বাবা-মায়ের মরদেহ উদ্ধার
  কুমিল্লায় অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত বেড়ে ৭
স্বীকৃতি পেলেও নাম ওঠেনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বহিঃবিশ্বে বেতার বার্তা প্রেরণের অপরাধে নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন মিজানুর

মোংলা প্রতি‌নি‌ধি

মোঃ মিজানুর রহমান (৭৫)। তার ডান পায়ে এখনও পাক সেনাদের ছোড় বুলেটের দগদগে ক্ষত। স্বাধীনতার ৫০ বছর ধরে শরীরে বুলেটের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন এ বৃদ্ধ। পাক সেনাদের অধিনে চাকরি করেও জীবন ঝুঁকি নিয়ে বীরদর্পে মুক্তিযুদ্ধকালীন মোংলা বন্দরে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে প্রথম লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তিনি। স্বাধীনতাকামী যুবকদের যুদ্ধাবস্থায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও পাক সেনাদের জাহাজের গোলাবারুদ লুটে সহায়তার অপরাধে তার উপর এমন বর্বরতা চালানো হয়।

যুদ্ধাকালীন সময় টগবগে যুবক মিজানুর রহমান বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তখন রক্ত ঝরিয়েছেন। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, স্মৃতিচারণে ফেলছেন চোখের জল। শুধু আক্ষেপ, স্বাধীনতার এতো বছরেও মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় ওঠেনি তার নাম। শেষ বয়সে এসে চাওয়া পাওয়ার কিছু না থাকলেও সরকারিভাবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাইছেন তিনি। আর এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি প্রত্যাশা তার।

একান্ত সাক্ষাৎকারে তৎকালীন পাক সরকারের জুলুম-নির্যাতন আর মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী সেনাদের তান্ডবের স্মৃতিচারণে চোখের জল মুছেন মিজানুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ১ জানুয়ারি নরসিংদী জেলার চম্পক নগর গ্রামে জন্ম তার। ওই গ্রামের মৃত মোঃ মসনদ আলী’র পুত্র তিনি।

১৯৬৫ সালে পাক সরকারের নৌবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। বাঙ্গালী হিসেবে নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে ১৯৬৭ সালে করাচী থেকে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে ফিরতে হয় তাকে। পরে নিরুপায় হয়ে ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই পোর্ট অব চালনা এ্যাংকরেজে (বর্তমানে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ) ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে যোগদান করেন। তখন জন্মভুমিতেও পাক সোনা অধিনস্থ হয়ে চাকরি করতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তিনি। ১১ মার্চ মোংলাস্থ সহকারি হারবার মাষ্টার অফিসে মিজানুর রহমানের নির্দেশে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন সিকিউরিটি গার্ড মোঃ মোফাজ্জল হেসেন। একই সঙ্গে মোংলাস্থ পুলিশ ফাঁড়ি হতে রাইফেল সংগ্রহ করে একমাত্র অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী হিসেবে মিজানুর রহামান সহকর্মী যুবকদের সংঘবদ্ধ ও অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। তাদের যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা স্থানীয় মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশ ব্যাপী গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ১ এপ্রিল গভীর রাতে মোংলাস্থ অয়্যারলেস স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মিত্রদেশ ভারতসহ বহির বিশ্বের দেশসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ ও সহযোগীতার জন্য বেতার বার্তা পাঠান মিজানুর রহামান। পরদিন ভারতীয় বিমান মোংলা বন্দরে অবস্থিত পাক বাহিনীর অস্ত্র-রসদ বোঝাই জাহাজে বোম্বিং করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ আর এ পতাকা উত্তোলন করায় তখন ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তৎকালীন সহকারী হারবার মাষ্টার লেঃ কমান্ডার আইয়ুব খাঁন। ফলে হারবার বিভাগের কর্মচারীদের বেতন বন্ধ করে দেয়া হয়।

পরে বেতন দেয়ার কথা বলে ৮ এপ্রিল ওয়্যারলেস অপারেটর মিজানুর রহমান, মোঃ নাজমুল হক (ইওম্যান সিগন্যালার), মোঃ লুৎফর রহমান (সিগন্যাল ম্যান), মোঃ নুর নবী (সিগন্যাল ম্যান), মোঃ শফিকুল ইসলাম (সিগন্যাল ম্যান), অবুল হোসেনবেগ (ওয়্যারলেস অপারেটর) কে লঞ্চ যোগে খুলনায় পাক বাহিনীর ঘাঁটিতে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে রাত ১১ টার দিকে হাতের বাঁধন খুলে দৌড়ে পালাতে পাক বাহিনীর ছোড়া এলোপাথাড়ি গুলি বিদ্ধ হয় তার ডান পায়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আশ্রয় নেন বিলাবাদ গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে সেখানে এক হিন্দু ডাক্তার তার প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। টানা ৮ দিন পর পায়ে হেটে গভীর রাতে মোংলায় পৌঁছে নৌকাযোগে ডেওয়াতলা গ্রামে আব্দুল মালেকের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আর এখানে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন সেনা ঘাঁটিতে ৫ সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আর তাকেও খুঁজে বেড়াচ্ছে পাক সেনারা। এতে ভয়ে আতংকে রাতদিন হাটার কারণে পঁচন ধরে মিজানুর রহমানের ক্ষত পায়ে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে পারেন নি। এক পর্যায় অসুস্থ শরীর নিয়ে আত্মগোপন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি মোংলা বন্দরে নিজ কর্মস্থলে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল খালিশপুরে তাকে সংর্বধনা দেয় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই মিজানুর রহমানকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।

মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের (অবঃ) ওয়্যারলেস অপারেটর মিজানুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, এ বন্দরে তার নির্দেশনায় প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হয়। আর পাক বাহিনীর গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রতিবেশী দেশ সহ বহিঃবিশ্বে সাহায্য চেয়ে বেতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠেন তার। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি ও হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন বৃদ্ধ মিজানুর রহমান।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!