স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অনুধাবন করেছিলেন যে কেবল পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্বশাসন নয় বরং এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ দুর করতে পারে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র কাঠামো। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অব্যবহৃত পরেই স্বাধীন পূর্ববঙ্গ প্রতিষ্ঠার সুপ্ত বাসনা ছিল তাঁর মনে। কিন্তু একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁকে এদেশের মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বপিত হওয়া জাতীয়তাবাদী চেতনার বীজকে গাছ এবং সেখান থেকে ফলে পরিণত করার জন্য খুব সচেতনভাবে অগ্রসর হতে হয়েছিল।
পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন ব্রিটিশশক্তির ঔপোনিবেশিক যাঁতাকল থেকে বেড়িয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু খুব দ্রুতই এই আন্দোলনের নেতৃবর্গের স্বপ্নভঙ্গ হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের কাজে চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়। (সূত্র: শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আতœজীবনী)। তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে উদ্ভুত পরিস্থিতিতেই যে কেবল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন তেমনটি নয়। বরং তিনি যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন অনেক আগে থেকেই দেথেছিলেন সে বিষয়টি গবেষণায় এক প্রমাণিত সত্য। কিন্তু একজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে অনেক বেশি প্রজ্ঞাবান হয়েই আন্দোলনমুখী হতে হয়। বঙ্গবন্ধু একজন দুরদর্শী নেতা হিসেবেই বাংলাদেশ আন্দোলনকে সুসংগঠিত করেছিলেন।
অনেকেই প্রশ্ন করে, “বঙ্গবন্ধুর ছয় দফায় তো কোথাও স্বাধীনতার কথা নেই। তাহলে তিনি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা কিভাবে হলেন?” আসলে ছয় দফার ছয়টি দাবি যদি বিশ্লেষণ করে দেখা য়ায় তাহলে আমরা দেখবো যে, এই ছয়টি দফা অর্জিত হলে কিভাবে স্বাধীনতার পথ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে যাবে। এটাই ছিল ছয় দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরামর্শক বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা। পূর্ববঙ্গের জন্য আইনসভা, কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা পৃথকীকরণ, আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থা এবং সেই মুদ্রার পাচার রোধে সাংবিধানিক ব্যবস্থা প্রণয়ন, আঞ্চলিক আর্থিক এবং বৈদেশিক বিষয়বলির উপর প্রদেশের পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা এবং প্রাদেশিক পৃথক সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন এই ছয়টি দফার অর্জনের চুড়ান্ত ফলাফল যে একটি স্বাধীণ রাষ্ট্রের পথ প্রশস্ত করে দিত সক্ষম তা ভেবেই ছয় দফার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র।
তাছাড়া বঙ্গবন্ধু নিজেও ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমেদের এক প্রশ্নের উত্তরে মেঠো বাংলায় বলেছিলেন, “আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম (সূত্র: ৭ জুন, ২০২১, দৈনিক ইত্তেফাক)।” আবার কবি সৈয়দ শামসুল হকের সাথে এক আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নিছো, কতো দিবা, কবে যাবা?” (সূত্র: ৭ জুন, ২০২১, বার্তা ২৪)।
আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং সাম্প্রতিক সময়ে ওই মামলার আসামী প্রয়াত কর্নেল শওকত আলীর লেখা বই প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু বহু আগে থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশরে স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করেছিলেন। (সূত্র: শওকত আলী, সত্য মামলা আগরতলা)।
আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ বেশ কয়েকজন সামরিক বেসামরিক নেতাদের গ্রেফতার করা হলে তাদের মুক্তির লক্ষ্যে যে অভ্যুথান গড়ে উঠেছিল তার স্লোগানগুলোর মধ্য অন্যতম ছিল, “বীর বাঙালি অস্ত্র্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ মুক্ত কর”, “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” ইত্যাদি এবং এসব স্লোগান দিয়েই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ বেগবান করে। একথা প্রণিধনযোগ্য যে, ৬৯ এর গণআন্দোলনের প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি যেখানে মাওলানা ভাষাণীর মত নেতৃবৃন্দকে দেখা যাচ্ছে শেখ মুজিবের মুক্তি ইস্যুতে তেজষ¦ী ভাষণ দিতে। আর সেই আসেদালনে জনতা ক্ষুরধারা স্লোগান দিচ্ছে, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর” কিংবা “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ মুক্ত কর”।
১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ববঙ্গ নামের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণের তীব্র বিরোধীতা করেন (বিবিসি নিউজ বাংলা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮)। তারপগরও পূর্ব পাকিস্তান নামই বহাল রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কখনও বঙ্গবন্ধুর মুখে কোন ভাষণ কিংবা বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তান নামের উচ্চারণ শোনা যায়নি।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরোয়ার্দীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষীকীতে এক সভায় এ অঞ্চলের নাম নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাবনা আসলেও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নাম দেন এবং এটাই সর্বসম্মতিক্রমে চুড়ান্ত হয়।
যে ছয় দফাকে তিনি এক দফা অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের দফা হিসেবে বর্ণনা করেছেন তাকেই তিনি ১৯৭০ এর নির্বাচনের ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। নির্বাচনী সকল প্রচারসভায় তিনি প্রচারকৌশল হিসেবে এই ছয় দফাকেই উপস্থাপন করেছেন। ৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও যখন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করছিলেন না তখন অসহযোগ আন্দোলনের সব পর্যায়েই স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু। যেমন ৭ই মার্চের ভাষণের শেষ দুটি লাইনই তার প্রমাণ।
তারপরও সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দেননি। কারণ তিনি পরিণামদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে যুদ্ধের মত একটা পরিস্থিতিকে এড়াতে চেয়েছেন। অবশেষে ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চের পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
বঙ্গবন্ধু সর্বদাই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কড়া নজরে থাকতেন। সুতরাং তিনি যা বলতেন, করতেন এবং নির্দেশনা দিতেন তা সবসময় শাসকগোষ্ঠীর নীতিনির্ধারণী আলোচনায় স্থান পেত। তাই বঙ্গবন্ধর সরাসরি স্বাধীনতার ডাক বা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের আহবান হত বাঙালি জাতির জন্য আতœঘাতী যা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের অন্তরায় হত বলেই অনুমেয়। তাই এই বিচক্ষণ নেতা খুব সতর্কতার সাথেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আন্দোলনকে পরিপূর্ণতা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এত সতর্ক থেকেও যেখানে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকে এড়ানো সম্ভব হয়নি সেখানে আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি বঙ্গবন্ধু কোন কাজ করতেন তবে হয়তোবা আরও বেশি অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হত বাঙালিদের এবং স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি একটি সুদূরপরাহত ব্যাপার হত।
তাই এদেশের মানুষ আজও সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারেনি যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বাঙালি কেবল তাদের জাতির পিতাকে হারায়নি বরং একজন দুরদর্শী, বিচক্ষণ এবং পরিণামদদর্শী বিশ্বনেতাকে হারিয়েছে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।