ডিজিটাল প্লাটফর্মের অন্যতম অনুসঙ্গ হলো সোশ্যাল মিডিয়া, আর ফেইসবুক হলো দুনিয়ার সব চেয়ে সব বড় সামাজিক মাধ্যম। আসুন একটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ মেলে দেখি। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে সারাবিশ্বে ফেইসবুক ব্যহাররকারীর সংখ্যা ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন অর্থাৎ ২৭০ কোটি মানুষ। যা একটি পৃথিবীর মোট জন্যসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। আর মজার বিষয় হলো, যখন এই লেখাটি লিখছি তখনি হয়তো আরো কত শত নতুন একাউন্ট খোলা হচ্ছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন যে হারে মানুষ জন্মাচ্ছে তার চেয়ে বেশি হারে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াতে একাউন্ট খুলছে।
সোশ্যাল মিডিয়া যদিও সামাজিক একটি মাধ্যম, তবুও এটি নিয়ে নানা তর্ক বির্তক রয়েছে। যেমন এটি সামাজিক মাধ্যম হলেও আমাদের অসামাজিক করে তুলছে কিনা। ২০১০ সালে আরব বিশ্বের যে আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, বর্তমানে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই গত ১০ বছরে অনেক সামাজিক আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় পরির্বতন সফল করে তুলেছে ফেইসবুক। বাংলাদেশের অনেক ঘটনা, আন্দোলন যেমন নিরাপদ সড়ক চাই, শিশু হত্যার বিচার, ধর্ষণের বিচার তরান্বিতকরণ খুবই সফল হয়েছে। তবে কথা হচ্ছে ফেইসবুক যেমন ভালো কাজের সঙ্গী হচ্ছে, তেমনি একই সাথে মন্দ কাজেরও ভাগিদার হচ্ছে। দোষটা যদিও ফেইসবুকের নয়, এর ব্যবহারকারীর।
ফেইসবুক একটি নিউমিডিয়াম টুলস এর ব্যবহার, ট্রাডিশনাল মিডিয়ার মতো না। এজন্য এর চাবিকাঠি প্রত্যেক ব্যবহারকারীর হাতে আলাদা আলাদা ভাবে রয়েছে। এজন্য এটির নিয়ন্ত্রণভার অনেক কঠিন। ব্যবহারকারী ইচ্ছেমত ফেইসবুকের ওয়ালে যা- কিছু লিখতে পারে, ছবি পোস্ট করতে পারে। এমনকি অন্যের লেখা বা ছবি বা ভিডিও শেয়ার করতেও পারে। ফলে যদি কোন কিছু চিন্তাভাবনা না করে শেয়ার করা হয় বা লেখা হয়, সেটির মারাত্মক সামাজিক প্রভাব পড়ে। আমরা দেখেছি ফেইসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা পর্যন্ত হয়েছে। ফলে মারাত্মক একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়াতে তথা ফেইসবুক ও ইউটিউবে কোন জিনিস লেখা তথা শেয়ার করার আগে ভেবে দেখা দরকার, যা শেয়ার করছি, তা কেন শেয়ার করছি। কি কি পোস্ট বা স্ট্যাটাস দিলাম, কেন দিলাম সবই দেয়ার আগে পুনরায় ভেবে দেখতে হবে, আমার শেয়ারকৃত স্ট্যাটাসের দ্বারা কারো কোনো মানহানি হয়েছে কিনা, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাত হানছে কিনা।
বিগত কয়েক বছরের ঘটনা পর্যবক্ষেণ করলে দেখা যায় যে, ফেইসবুকে কোনা মন্তব্য শেয়ার বা কোনো ছবি পোস্ট করার কারণে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে এজন্য দাঙ্গা বেঁধেছে, প্রাণহানি হয়েছে এমনকি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক সময় ছবি, ভিডিও টেক্সট পাঠিয়ে অনুরোধ করা হয়, এটা শেয়ার করার জন্য। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়া লিটারেসি থাকা খুব জরুরী। আর মিডিয়া লিটারেসি একটি পরিভাষা। এখানে দু’টি শব্দবন্ধ রয়েছে। একটি হলো Media তথা মাধ্যম আর অন্যটি হলো Literacy তথা সাক্ষরতা।
অর্থ্যাৎ মাধ্যম বলতে বুঝায় যোগাযোগীয় এমন একটি প্লাটফর্ম যার দ্বারা একটি বিপুল সংখ্যক দর্শক বা শ্রোতার কাছে তথ্য এবং বিনোদন পৌঁছে দেয়। যেমন সংবাদপত্র, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ম্যাগাজিন, সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্যাদি। (A way of communicating information or providing entertainment to leargr groups of people. Media can include TV, internet, newspapers, megazines, social media, and news portal and so on.)
আর সাক্ষরতা বলতে বুঝায়, কোনো একটি বিশেষ ক্ষেত্রে জ্ঞান, দক্ষতা বা বোঝার ক্ষমতাকে। ( knowledge, understand or skill in a specific area.)
সুতারং মিডিয়া লিটারেসি বা মিডিয়া সাক্ষরতা বলতে বুঝায়, বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া থেকে পাওয়া বার্তা বা তথ্যসমূহ পাওয়ামাত্রই বিশ্বাস না করে সেটা সত্য কি মিথ্যা তা যাচাইয়ের সক্ষমতা অর্জন করা। (The ablity to critically evaluate the various messages we receive from different forms of media.)
দর্শক, শ্রোতা বা পাঠকের ৪ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জ্ঞান বা দখলের উপর নির্ভর করে তাদের মিডিয়া লিটারেসি।
১. মিডিয়ায় প্রবেশের সক্ষমতা (Accessing media)
২. মিডিয়া প্রদত্ত আধেয় তথা বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের ক্ষমতা (Analyzing content)
৩. মিডিয়ার বার্তা মূল্যায়ন করতে সক্ষম (Being able to evaluate messages)
৪. নিজেকে প্রকাশ এবং যোগাযোগের জন্য মিডিয়াকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারা তৈরি করতে পারা (Being able to create media for self-expression and communication)
উপরি-উক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত বার্তা বা তথ্য পেলেই সেগুলোর সঠিক যাচাই-বাচাই করে বিশ্বাস করা এবং তারপর সেটা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। সুতরাং মিডিয়া প্রদত্ত সকল আধেয় পাওয়া মাত্রই সেটার মূল্যায়ন তথা বিশ্লেষণই সক্ষমতাকেই মিডিয়া লিটারেসি বোঝানো হয়।
সুতরাং কয়েকটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে। মেসেঞ্জারে কোনো কিছু আসলেই শেয়ার না করা, কোনো ছবি পোস্ট করার আগে ভেবে দেখতে হবে এটি কারোর মানহানি হচ্ছে কিনা, কোনো ব্যক্তিগত জিনিস শেয়ার না করা, ভাইরাল হওয়ার জন্য যা তাই শেয়ার না করা। একই সাথে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮। এই আইনটির ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, যদি কোনো ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার করে যেমন, (১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উস্কানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদন্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
(৩) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ (দশ) বৎসর কারাদন্ডে, বা অনধিক ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
অন্যদিকে, ২৯ নং অনুচ্ছেদে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, কর ইত্যাদি যেমন। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে Penal Code (Act XLV of ১৮৬০) এর section ৪৯৯ এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদন্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কারাদন্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
অতএব, আমাদেরকে অবশ্যই দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতে হবে ফেইসবুকে আমরা যা লিখছি, পোস্ট করছি, ছবি দিচ্ছি তা কি ঠিক? আবার ইউটিউবে যে ভিডিও শেয়ার করছি সেটি কতটুকু যাচাই করে দিচ্ছি। এ সমস্ত বিষয়ে আমার সর্তকতা অবলম্বন করলেই সুস্থ এ ধরণীতে আমাদের শৃঙ্খলতা ফিরে আসবে, হবে শন্তিপূর্ণ বাসযোগ্য একটি মহিমান্বিত পৃথিবী।
(লেখক : সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় )