খুলনা জেলা সদর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে ফুলতলার অবস্থান। ব্রিটিশ জামানা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের জোরালো তৎপরতা ছিল এখানে। পাকিস্তান জামানায়ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ফুলতলার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
ভাষা আন্দোলনে ১৯৪৮-১৯৫২ সাল পর্যন্ত খুলনা শহরে যেমন ফুসে উঠেছিল বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ঠিক তেমনি পার্শ্ববর্তী ফুলতলা থানায়ও আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো মাতৃভাষার দাবিতে। অনেক আগে থেকেই একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবসা কেন্দ্র এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই এখানে কিছু জাগ্রত ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ভাষা আন্দোলন। মূলতঃ এখানকার ছাত্ররাই এ এলাকার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। এখানে ফুলতলাতে কোন কলেজ ছিল না। ছিল রি-ইউনিয়ন হাইস্কুল এবং দামোদর মুক্তিময়ী হাইস্কুল। এ দুই স্কুলে তখন প্রায় পাঁচশত ছাত্র লেখাপড়া করতো।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র শ্রমিক শহীদ হওয়ার খবর পাওয়ার পর মাতৃভাষা আদায়ের দাবিতে এবং ভাই হারানোর ব্যথায় ব্যথিত হৃদয়ে ফুঁসে উঠেছিলো। ২২ ফেব্রুয়ারি ফুলতলা বাজারে মিছিল বের করে। বাজারের সকল ব্যবসায়ী ব্যবসা কেন্দ্র বন্ধ রাখা এবং আন্দোলনে তাদের সাথে অংশগ্রহণ করার আহবান জানায় ছাত্ররা এবং সেই সাথে এখানকার প্রগতিশীল কিছু মানুষ। তবে তাদেরকে বাঁধা দিতে চেষ্টা করে মুসলিম লীগের কতিপয় নেতা নামধারী কুচক্রী মহল ও দু’চার জন ব্যবসায়ী। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সোহরাফ বিশ্বাস, ফজলার রহমান,আবু তালেব, মাওলা বক্স প্রমুখ।
ছাত্ররা যখন ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে যায় তখন তারা বাধা দেয়। যদিও সে বাধা জাগ্রত ছাত্ররা যেমন মানেনি তেমনি মানেনি এখানকার প্রগতিশীল মানুষেরা। হাতে গোনা কিছু মানুষের বিরোধিতা ছাড়া স্বত:স্ফূর্ত ভাবে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা মিছিল শেষে মিলিত হয় বাজারের ঢোকার মোড়ে বর্তমানে যেখানে রফিক-আসাদ পাঠাগার স্থাপিত হয়েছে সেখানে।
তারপর ভাষার দাবিতে এবং ঢাকায় ঘটে যাওয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বক্তৃতা দেন তৎকালীন প্রগতিশীল যুবনেত কামরুজ্জামান লিচু মোল্লা, কৃষক নেতা গফুর মোল্লা এবং ছাত্রদের মধ্যে মো. রফি, মরহুম হাফিজুর রহমান ভূঁইয়া, লোকমান হাকিম, শাহাদাৎ হোসেন, পিজির আহমদ, আবুল কালাম প্রমুখ।
এ সমাবেশ থেকেই ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ দিবস ফুলতলাতে ধর্মঘাট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খুলনা শহর থেকে বহু ছাত্ররা এসে যোগ দেয় ২৩ তারিখের সমাবেশে । শ্লোগান মুখর মিছিলে যেন প্রকম্পিত হতে থাকে বাজারসহ পুরো এলাকা। মিছিলটি দামোদর রেলস্টেশন থেকে প্রায় দুই কি. মি পথ অতিক্রম করে এসে সমবেত হয় চৌরাস্তার মোড়ে। তারপর খুলনার ছেলেরা ফিরে যায়। বিকেলে খুলনা শহরে সমাবেশ হয়। এভাবে চলতে থাকে সংগ্রাম। তারপর ফুলতলার ছাত্র ও প্রগতিশীল মানুষের অংশগ্রহণে শহরের আন্দোলনের গতি যেন আরো বেগবান হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ফুলতলার সংগ্রামী জনতার নাম ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।
খুলনা গেজেট/এএজে