ফরিদপুরের মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লীতে গণপিটুনিতে দুই নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশ সদস্যসহ গুরুতর আহত হয়েছেন আরও আটজন। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আজ শুক্রবার জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার গণপিটুনিতে দুইজন শ্রমিক নিহতের খবর নিশ্চিত করেছেন।
নিহত দুই নির্মাণ শ্রমিক হলেন- মধুখালী উপজেলার নওয়াপাড়া ইউনিয়নের ঘোপেরঘাট গ্রামের শাহজাহান খানের ছেলে আশরাফুল (২১) ও তার ভাই আশাদুল (১৫)।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্মাণ শ্রমিকদের গণপিটুনি দেয় এলাকাবাসী। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের নির্মাণাধীন একটি স্কুল ভবনের কক্ষে হাত-পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে সন্ধ্যার পর প্রথমে মধুখালী থানার ইউএনও এবং ওসির নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপরেও হামলা করা হয়। এ সময় ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে হামলাকারীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এ সময় এলাকাবাসী পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে পুলিশ।
খবর পেয়ে ফরিদপুর থেকে জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। প্রায় ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় অবরুদ্ধ থাকার পর আহতদের উদ্ধার করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেখানে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকার অতিরিক্ত র্যাব ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অতিরিক্ত নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলে ৪ প্লাটুন বিজিবি পাঠাতে বলা হয়েছে।
ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান তপন জানান, পাঁচ গ্রাম নিয়ে সেখানে পঞ্চপল্লী অবস্থিত। এলাকাটি হিন্দু বসতি অধ্যুষিত। এর মাঝে কৃষ্ণনগর নামে এক গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজের জন্য সেখানে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন। পঞ্চপল্লীর একদল মানুষ ওই নির্মাণ শ্রমিকদের পিটিয়ে আহত করে নির্মাণাধীন স্কুল ঘরে আটকে রাখে। স্কুল ভবনের দরজা, জানালা, গ্রিল ভেঙে ফেলেন তারা। এ সময় বাইরে থেকে কেউ ওই গ্রামে যেতে পারেনি। সেখানে একটি কালী মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
তপতি মন্ডল নামে ওই গ্রামের এক নারী জানান, তিনি মায়ের ঘরে (কালীমন্দির) সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছিলেন, তখন শ্রমিকরা জানালা দিয়ে দেখছিলেন কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা। তারপর আমি বাড়ি গিয়েছিলাম ঘোষি নিতে। তখন ওরা (শ্রমিকরা) রড ওঠানামা করতেছিল আর নিজেরাই বকাবাজি করতেছিল। তারপর আমি চিৎকার শুনতে পাই। এগিয়ে গিয়ে দেখি, মা একদম পুড়ে গেছে। তারপর লোকজন জড়ো হয়ে গেল। এই যা। তারপর কী হলো, তা তিনি দেখেননি। এছাড়া কারা মন্দিরে আগুন দিয়েছে, তাও তারা কেউ দেখেননি বলে জানান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফরিদপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাজবাড়ী জেলা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ আনা হয়েছে পরিস্থিতি মোকাবিলায়। পাশাপাশি ফরিদপুর থেকে র্যাব সেখানে পৌঁছেছে। থেমে থেমে সেখানে ফাঁকা গুলির আওয়াজ শোনা গিয়েছে।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, এখানে কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিক কাজ করছিলেন। উত্তেজিত জনতা ভেতরে ঢুকে তাদের লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে গুরুতর আহত করে। খবর পেয়ে মধুখালী থানার ওসি ফোর্সসহ এখানে আসে। তাদের সঙ্গে মধুখালী উপজেলার ইউএনও ছিলেন। তারা এখানে এসে উত্তেজিত জনতার হাতে আটকে পড়েন। খবর পেয়ে আমরা ফরিদপুর থেকে অতিরিক্ত ফোর্সসহ এসে তাদেরসহ আহতদের উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে ফরিদপুরে হাসপাতালে পাঠাই।
পুলিশ সুপার বলেন, এ ঘটনায় অনেক পুলিশ আহত হয়েছেন। তাদের দিকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারা হয়েছে। আমরা সারারাতই পাহারা দিয়েছি। গ্রামবাসীসহ সবাইকে অনুরোধ করবো কেউ যেন আইনকে নিজের হাতে তুলে না নেয়। বিষয়টি ঢাকা থেকে আইজি স্যার নিজেও সবসময় খবরা-খবর রাখছেন।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার জানান, পঞ্চপল্লী গ্রামে একটি কালী মন্দিরে আগুন দেওয়ার খবরে ঘটনার সূত্রপাত। গ্রামবাসীর সন্দেহ এখানে একটি নির্মাণাধীন প্রাইমারি স্কুলের নির্মাণ শ্রমিকরা আগুন দিয়েছেন। তারা এই শ্রমিকদের বেদম পিটিয়ে ও ইট দিয়ে থেতলিয়ে গুরুতর আহত করে। তাদের উদ্ধার করে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজন মারা যান।
তিনি বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ আহতদের উদ্ধার করতে এলে তাদের বাধা দেওয়া হয়। তখন কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে।
রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পঞ্চপল্লী গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, সকাল থেকে এখানে বিজিবি মোতায়েনের জন্য চার প্লাটুন বিজিবি চাওয়া হয়েছে। মধুখালী ছাড়াও শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিজিবি মোতায়েন করা হবে। কাউকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের সুযোগ দেওয়া হবে না।
খুলনা গেজেট/এনএম