প্রিয় নবীজি সা. মদীনাতে এসেছেন মাত্র। নবাগত মানুষটিকে দেখতে দুর দুর থেকে আসছেন অনেকে। তাকে নিয়ে কত কথা শুনেছে তারা। শুনেছে তিনি খুবই সুন্দর। যেমন সুন্দর তার চেহারা তেমনি সুন্দর তার ব্যবহার। কেবল শুনে শুনেই মনের অজান্তে তার একটি প্রতিচ্ছবি অঙ্কিত হয়ে আছে সবার হৃদয় কুঠিরে। আজকে সেই মানুষটিকে দেখে চোখ জুড়াতে চায় তারা।
দর্শন প্রত্যাশীদের সারিতে এক মহিলা। কোলে একটি অল্প বয়সী ছেলে। নাম তার আনাস। আনাস বিন মালেক। সুযোগ বুঝে নবীজি সা. এর সামনে উপস্থিত হলেন। সালাম দিলেন এবং নিজের ইসলাম গ্রহনের সংবাদ শুনালেন। তার কথায় নবীজি খুব খুশি হলেন। অতপর মনের সবটুকু আকুতি একত্র করে বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! এই কোলের সন্তানটি ছাড়া এই মাটির দুনিয়ায় আমার আর কিছুই নেই। আমি ছেলেটিকে আপনার খেদমতের জন্য দিতে চাই। দয়া করে আপনি তাকে গ্রহণ করুন। বলেই ছেলেটিকে কোল থেকে নামিয়ে নবীজির দিকে আগিয়ে দিলেন।
মহিলার কথা গুলো প্রিয় নবীজির কান ছুয়ে যেতেই চেহারা মোবারক জুড়ে বিষ্ময়ের বাদল ছেয়ে গেল। মদীনায় আসার পর থেকে কোন রকম আন্তরিকতায় কমতি করেনি এই শহরবাসী। কিন্তু তাই বলে নিজের কোলের সন্তানকে খেদমতের জন্য পেশ করার মত হিম্মত করেনিতো কেউ!
নবীজি সা. ছেলেটিকে কাছে টেনে নিলেন। বুকের সাথে দীর্ঘক্ষণ আগলে রাখলেন আর মুখে কি যেন বললেন। সেদিন থেকেই নবীজি আর আনাস যেন একই বস্তুর দেহ আর ছায়া। দেহ থেকে যেমন তার ছায়া পৃথক করা যায়না। যেখানে দেহ সেখানেই ছায়া। অনুরুপ নবীজি আর আনাস। যেখানে নবীজি সা. সেখানেই আনাস রা.।
নবীজির ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত এই সম্পর্ক প্রথম দিনের মতই অটুট ছিল। মূহুর্তের জন্য এতে সামান্যতম চিড় ধরেনি। দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত তিনি নবীজি সা. এর বিশেষ খাদেম ছিলেন। বয়স অল্প হওয়ায় নবীজির ঘরে প্রবেশের অনুমতি ছিল তার। ঘরে বাইরে নবীজির সাথে কাটানো মুহুর্তগুলি ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। যা পরবর্তিতে তিনি মানুষের মাঝে স্মৃতিচারণ করতেন। নিজেও কাঁদতেন। কাঁদাতেন সামনের মানুষগুলিকেও। নবীজির না থাকার দিনগুলিতে এটাই ছিল সাহাবীদের সান্তনা।
হজরত আনাস রা. এর স্মৃতিচারিত হাসি দুখের সেই গল্পগুলি হাদীসের গ্রন্থাদিতে সংরক্ষিত রয়েছে। ইমাম বুখারী রাহ. তার আল জামিউস সাহীহ তথা বুখারী শরীফে এর অনেক বর্ণনা উর্দৃত করেছেন। সেখান থেকে কিছু টুকরো গল্প হজরত আনাসের মুখেই জেনে নেয়া যেতে পারে।
হজরত আনাস বলেন, একদিন প্রিয় নবীজি সা. মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন কেউ একজন কেবলার দিকের দেওয়ালে থুথু ফেলে রেখেছে। আমি খেয়াল করে দেখলাম নবীজির চেহারায় চরম বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। তিনি খুব ব্যথিত হলেন। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু না বলে নিজেই নিজের হাত দ্বারা তা পরিস্কার করলেন।
অতপর সকলের উদ্দেশে বললেন, মানুষ নামাজের সময় তার প্রভুর সাথে প্রার্থনা ও নিবেদনরত থাকে। অর্থাৎ তার প্রভু তার সামনে কেবলার দিকে থাকে। সুতরাং এসময় যদি কারো থুথু ফেলার প্রয়োজন হয় তবে কেউ যেন কেবলার দিকে তা না ফেলে। তবে ডানে বামে বা পায়ের নিচে ফেলতে পারে। (তখন মসজিদ কাচা ছিল) এরপর তিনি নিজের চাদরের এককোনা হাতে নিলেন এবং তার মধ্যে থুথু ফেলে কাপড়ের দুপাশ ঘষা দিয়ে চাদরের সাথে মিলিয়ে দিলেন আর বললেন, অথবা এরুপও করতে পারে। (৪০৫)
আরো একদিনের কথা খুব স্পষ্ট মনে পড়ে যেদিন মদিনাতে আসরের সময় আমরা অজু করছিলাম। হটাৎ পানির সংকট দেখা দিল। তখন প্রিয় নবীজি সা. বললেন, তোমাদের কারো কাছে অল্প পরিমান পানি থাকলে তা নিয়ে আস। তখন বড় মুখ বিশিষ্ট একটি পাত্রে কিছুটা পানি আনা হল। নবীজি সা. নিজের মোবারক হাত তাতে প্রবেশ করালেন এবং পাত্র কাত করে পানি ঢালতে লাগলেন।
আমি বিস্ময়ভরে তাকিয়ে আছি নবীজির হাতের দিকে। আমি দেখলাম তার আঙ্গুলগুলি বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে আর লোকেরা অজু করে যাচ্ছে। একজন দুজন করে দশ জন অজু করলো। আমি ভাবলাম আর হয়তো সম্ভব হবে না। পাত্রের নিচের এক ছটাক পানিতে আর কতজনইবা অজু করবে। কিন্তু দেখতে দেখতে আরো দশজন অজু শেষ করল। তখন বিষয়টি আমার কাছে ভিন্ন কিছু মনে হল।
আমার বুঝতে বাকি রইল না এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার হাবীবের জন্য মোজেজা স্বরুপ। এমন একটি অলৌকিক ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হতে পেরে মনে মনে খুবই আনন্দিত হলাম। আমার কৌতুহলী চোখ দুটো নবীজির হাতের দিকে স্থির হয়ে আছে। আমি দেখলাম, সেদিন নবীজির আঙ্গুল বেয়ে আসা পানি দ্বারা সত্তর থেকে আশিজনের মত মানুষ অজু সম্পন্ন করল। (২০০)
লেখক : শিক্ষক, ইমদাদুল উলুম রশিদিয়া মাদরাসা, ফুলবাড়িগেট, খুলনা।