মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, ইহার চেয়ে নামটি মধুর তিন ভূবনে নাই। সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক মাথার’ পরে আজি অন্তরে মা থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজি। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ- এর মা কবিতাটির এই লাইনগুলো পড়লে আমাদের প্রত্যকের চোখের সামনে মায়ের ছবি ভেসে ওঠে। মা নামের ছোট্ট একটি শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, অকৃত্রিম স্নেহ, আদর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সব সুখের কথা। চাওয়া- পাওয়ার এই পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। মায়ের তুলনা মা নিজেই। মা যেন সীমার মাঝে অসীম। আমাদের সবার জীবনের একমাত্র ভরসার জায়গা হলো মা। আর মায়ের সম্মানে যে বিশেষ দিন পালন করা হয়, তাই হলো মা দিবস। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার আন্তর্জাতিক মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। দিবসটিতে মায়ের জন্য বিশেষ কিছু করেন সন্তান-সন্ততি, তাকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান, ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে ধরেন। দিবসটির গুরুত্ব আসলে কী? কেন পালন করা হয় মা দিবস? তা হয়তো অনেকেরই অজানা।
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষকে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে দেখা যায়। পৃথিবীর সব ধর্মেই মায়ের মর্যাদাকে উচ্চাসীন করেছে। উপনিষদে মা-কে দেবী স্বরূপিনী, জীবন্ত ঈশ্বরী বলা হয়েছে। হিন্দুধর্মে মহাশক্তি, আদিশক্তি, রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের কিন্তু মাতৃরূপেই চেনা যায়। ইসলাম ধর্মে ‘মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্ত’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মেও রয়েছে ‘মাদার মেরির’ বিশেষ তাৎপর্য। অর্থাৎ সব ধর্মে ও দেশে চিরকালই মায়ের ভূমিকা এক ও অভিন্ন। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মায়ের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। শুধু একজন নারী নয়, মাকে মায়ের যথাযথ মর্যাদা দেয়ার বিষয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই উদ্যোগ নেয়া হয়।
মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিশ্বে মা দিবস পালনের প্রথম উদ্যোগ নেয় ব্রিটেনের জনগণ। তখন প্রতি বছর মে মাসের চতুর্থ রবিবারকে ‘মাদারিং সানডে’ হিসেবে পালন করার রেওয়াজ চালু হয়। মাদারিং সানডে-তে ছেলেমেয়েরা পারিবারিক চার্চ বা মাদার চার্চের উদ্দেশ্যে পবিত্র যাত্রা শুরু করতো। দিবসটি পারিবারিক পুনর্মিলনের সুযোগ করে দিত এবং ঘরের ভৃত্যদের ছুটি দেওয়া হতো। বিশেষ করে মেয়েদেরকে ছুটি দেওয়া হত। যেন তারা মায়েদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। এর অনুসরণে ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় আসা জনগোষ্ঠী মা দিবস চালু করে সতেরো শতকে। পরে তা বেশি দিন টিকে থাকেনি। এরপর ১৮৭০ সালে জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামের আমেরিকান সমাজকর্মী এক মহিয়সী নারী অনুভব করেন, যুদ্ধে আহত, নিহিত, হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের মায়েদের বুকের ক্রন্দন, তাদের অন্তর-আত্মার বেদনা। বিশ্বকে তিনি শোনান এক সাম্যের বাণী। সন্তানের জন্যে জগতের সকল মায়ের ভালবাসায় কোন ভিন্নতা নাই। জাতি, ধর্ম, বর্ণের শ্রেষ্টত্বের বিভেদ টিকিয়ে রাখার জন্যে কোনো মায়ের বুকের ধন কেড়ে নেয়া অন্যায়। তিনি এর প্রতিবাদে বিশ্বের সকল মাকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। তিনি ১৮৭২ সালের ২ জুনকে শান্তির জন্য মা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। এছাড়া তিনি দিবসটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার জন্য চেষ্টা করেন। একই বছর মার্কিন কংগ্রেস মা দিবসকে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি ছুটি ঘোষণার প্রস্তাব নাকচ কওে দেয়। কারণ তার এ প্রচেষ্টা ছিল আমেরিকার বোস্টন শহরকেন্দ্রিক। তবে তাতে দমে যাননি আনা। তিনি তাঁর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মা দিবস পালিত হতে থাকে। ১৮৮০ ও ’৯০-এর দশকেও মা দিবস প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলে। তবে স্থানীয় পর্যায়ের বাইরে তার আন্দোলন বিস্তৃৃতি লাভ করেনি। এ দিনের কর্মসূচিতে দুটি সুন্দর বিষয় ছিল। এগুলো হলো মায়ের সাথে সময় দেয়া এবং মাকে কিছু উপহার প্রদান করা।
আধুনিক মা দিবসের প্রচলন হয় যুক্তরাষ্ট্রে। দিবসটি পালনের কৃতিত্ব যার প্রাপ্য তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন শহরের অধিবাসী অ্যানা জারভিস। জুলিয়া ওয়ার্ডের পথ ধরে সুদীর্ঘ ৩৭ বৎসর সংগ্রামের পর ১৯০৭ সালের ১২ মে প্রথমবারের মতো ‘মা দিবস’ পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে উদযাপিত হয়। অ্যানা জারভিস তার মা অ্যানা মারিয়া রিভস জারভিসের মৃত্যুদিনটি একটু অন্যভাবে পালন করার কথা ভেবেছিলেন। তার মা অ্যানা একজন শান্তিকামী সমাজকর্মী ছিলেন এবং নারীদের জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছোট ছোট ওয়ার্ক ক্লাব বানিয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য কাজ করতেন। একদিন ছোট মেয়েটির সামনেই ধর্মপ্রাণ অ্যানা হাত জোড় করে বলেছিলেন, ‘আমি আশা করি, প্রার্থনা করি, একদিন কেউ না কেউ, কোনো মায়েদের জন্য একটা দিন উৎসর্গ করুক। কারণ তারা প্রতিদিন মনুষ্যত্বের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। এটা তাদের অধিকার’। মায়ের প্রতিটি শব্দ মনে রেখেছিলেন অ্যানা। আর সে কারণেই অ্যানার মৃত্যুর দিনটিকে (১২ মে, ১৯০৭) সারাবিশ্বের প্রতিটি মায়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন তিনি। অবশেষে আনার প্রচেষ্টা সফল হয়। ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে ‘মা দিবস’ ঘোষণা করেন। দিনটি সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। সঙ্গে উপহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সাদা কার্নেশন ফুল। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি মা দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে।
বিশ্বের বেশ কিছু দেশে আজ দিবসটি পালিত হলেও অন্যান্য দেশে আবার ভিন্ন ভিন্ন দিনে দিবসটি উদযাপন করা হয়। যেমন বাংলাদেশে আজ (মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার) দিবসটি পালিত হলেও কসোভোয় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম রবিবার মা দিবস পালিত হয়। নরওয়েতে ফেব্রুয়ারি মাসে দ্বিতীয় রবিবার, জর্জিয়ায় ৩ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। যুক্তরাজ্যে ৬ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডে ১২ আগস্ট এবং সিঙ্গাপুরে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার দিবসটি পালিত হয়। তার মানে মা দিবসের নির্দিষ্ট কোনো একক তারিখ বা দিন ধার্য নেই। তবে তারিখ যা-ই হোক না কেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত রবিবারেই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। যত দিন যাচ্ছে ততই প্রতি বছর বিশ্ব মা দিবস পালন আরো বিস্তৃৃতি লাভ করছে। বর্তমানে ৫০টিরও বেশি দেশ এই দিবস পালন করে থাকে।
বিশ্বের সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সমাজ গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।
খুলনা গেজেট/কেডি