গঠনমূলক আলোচনা এখন রূপ নিয়েছে তর্কে। ডিস্টোপিয়ান লিটারেচর সাহিত্যের উদ্ভাবনী ভঙ্গি নাকি তরুণদের মানসগ্রাসী রূপায়ন – এই বিষয়ে যুক্তি খণ্ডনের লড়াইটাকে আর ঠিক বিতর্ক বলা যাচ্ছে না। ‘তুই আমার চেয়ে বেশি বুঝিস? কিংবা আমার চেয়ে এ বিষয়ে তুই কতটুকু পড়ছিস?’- এমন ব্যক্তিগত আক্রমণমূলক মন্তব্যগুলো আর যাই হোক অন্তত বিতর্কের শর্ত পূরণ করে না।
কিছুদিন আগেও নিজস্ব কোন বিশেষত্ব উপস্থাপন, প্রদর্শন কিংবা ধারনে অক্ষম ছেলেটি ইদানীং ডিস্টোপিয়ান লিটারেচারের সার্বজনীন প্রসারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রীতিমত মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে শুরু করেছে। তার ওই সাহিত্যের প্রতি ভক্তিতে কারও আপত্তি না থাকলেও অনাগ্রহীদেরও আলোচনায় সামিল করার প্রচেষ্টায় তার প্রতি অনেকেই বিরক্ত।
সাহিত্যের প্রতি সৌমিত্রের ঝোঁক সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। তবে সাহিত্যের এই স্পেসেফিক জনরা নিয়ে তার এমন জীবনমরন চর্চা সম্পর্কে কেউ তেমন খোঁজ রাখে না। সৌমিত্রের বাড়িতে যাওয়া আসার সুবাদে অল্পবিস্তর জানে মামুন।
কয়েকপাতা বই পড়ে এমন দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধানোর মোক্ষম জবাব দিতে অথবা ডিস্টোপিয়ান লিটারেচারের যৌক্তিকতা খুঁজতে – এমনই কোন এক কারনে ছয় বন্ধু আজ বসেছিল আলোচনায়। টপিক সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকা, আবার আলোচনার দীর্ঘসূত্রিতায় অন্য চার জন প্রথমে চুপচাপ হয়ে গেল, পরে পাশেই আলাদা একটা দল করে ডুব দিল ভিন্ন আলোচনায়। তবে সৌমিত্র আর কবির এক পর্যায়ে তর্ক আর পরে ব্যক্তিগত আক্রমন করে পরিস্থিতি করে তুলল ঘোলাটে।
অবশেষে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি দিল মামুনের উপস্থিতি। সৌমিত্রকে ইঙ্গিত করে বলল –
– সিদ্দিক স্যার তোকে খোঁজে। যা, ওনাকে একটু ডিস্টোপিয়ান জ্ঞান দিয়ে আয়।
ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ স্থির থাকল সৌমিত্র। কোলে রাখা ব্যাগটা কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে সবার উদ্দেশ্যে একটা অস্পষ্ট হাঁসি দিল সে। সে হাঁসি স্বস্থির নাকি অস্বস্থির- তা নিয়ে মাথা ঘামাল না কেউ। সৌমিত্র স্যারের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল।
আগেও দুইবার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য ওয়ার্নিং দিয়েছে সিদ্দিক স্যার। আজ একেবারে ডেকে পাঠিয়েছে। রগচটা স্বভাবের মানুষটা সৌমিত্রকে বিশেষ স্নেহ করে। তবে এতটা অনিয়ম হয়তো মানবেন না আজ। সৌমিত্র ভাবল, সেও চুপ থাকবে না। স্যার রূঢ় হলে সে নিজেকে ডিস্টোপিয়ান রাজ্যের কর্তৃত্ববাদী শাসকের চরিত্রে রূপান্তরিত করবে। সৌমিত্রের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল।
গত দুইদিন সৌমিত্রের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে পান্না। আসলে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। না, নিরুদ্দেশ নয়। মামুন ওর বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জেনেছে প্রতি রাতে সে বাসায় ফেরে। যতদ্রুত সম্ভব রাত্রিকালীন কাজ সেরে রুম লক করে দেয়। এরপরে পরিবারের সদস্যরা আর কিছু বলতে পারে না।
ম্যাড়মেড়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছেলেটির এমন পরিবর্তনের কারন খুঁজতে যেয়ে একটু ইতস্তত ভেবে মামুন পান্নাকে জিজ্ঞাসা করে-
-তোমাদের মধ্যে কি কোন ঝগড়া হয়েছে?
-আমাদের মধ্যে ঝগড়া হবে কেন?
– আরে, লুকানোর কিছু নেই। নিজেদের মধ্যেই তো। বলো। প্রেম-ভালবাসায় একটু আধটু রাগ-অভিমান থাকে।
– কী বলো এসব। আমরা প্রেম করি নাকি?
মুহূর্তকাল পান্নার শেষ অভিব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেও সমস্যা সুরাহার সম্ভাবনা না দেখে নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনায় ডুব দিল মামুন। তবে এখন সে ভাবনায় বিরক্তি। মনে মনে ভাবে ও – ‘শালা, সারাদিন দুটো ল্যাপটায়ে থাকে। আর এখন বলে প্রেম করে না।’
সত্যিই ওরা প্রেমিক-প্রেমিকা নয়। তবে গত দেড় মাসে ওদের ঘনিষ্ঠতা মন্দ নয়। পান্নার দিক থেকে উৎসাহটা একটু বেশি। পান্না হয়তো সৌমিত্রের প্রেমে পড়েছে – এমন ভাবনা সকলের হলেও ঘটনা আসলে ভিন্ন। পান্নার না আছে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ, না আছে সৌমিত্রের প্রতি বিশেষ কোন টান। তাহলে? সৌমিত্রের ব্যাচমেট সুরভীর কাছ থেকে পান্না জেনেছে ওর নাকি হিপনোটিজম দক্ষতা আছে। কবে, কোথায় যেন কাকে ঘণ্টাখানেক নিজের বশে রেখেছিল সৌমিত্র। সেদিন থেকেই পান্না নানা অজুহাতে সৌমিত্রের সাথে ঘোরাঘুরি করে। কখনো সরাসরি, আবার কখনো ইনিয়ে বিনিয়ে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছে পান্না। সৌমিত্র এমনভাবে উত্তর দিয়েছে যাতে তার দক্ষতা প্রকাশ পায় না, আবার অস্বীকারও করা হয় না। পান্না রহস্যাবৃত হয়ে পড়ে। ওর জেদ ধরে যায় এই রহস্য ভেদ করার।
ভোর হলেই সৌমিত্রের নিত্যদিনের গন্তব্য পরেশ ডাক্তারের চেম্বার। বুড়ো ডাক্তার। এক পা ইতিমধ্যে পরপারে চলে গেছে। এখন আর রোগীর সাক্ষাৎ তেমন মেলে না। তবে সৌমিত্রের যাতায়াত নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয়েছে এমনও নয়। যতটুকু সময় থাকে ওখানে ওদের মধ্যে তেমন কোন কথা হয় না। পাশের টেবিলে বসে সৌমিত্র কীসব করে তা পরেশ ডাক্তার নিজেও জানে না। আর বাইরের লোকজন তো পরের বিষয়।
অল্পসল্প কথার মধ্যে সৌমিত্র বুড়ো ডাক্তারকে পরামর্শ দিয়েছিল –
– ঠাকুরদা, তোমার অপারেশন টেবিলটা আবার চালু করা দরকার।
– না রে। রোগী পত্তর নেই। আমার বয়স হয়েছে।
– আমরা নতুন কিছু এক্সিপেরিমেন্ট করতে পারি।
বুড়ো ডাক্তার আর কথা বাড়ায়নি। শুধু একটু মাথাটা তুলে সৌমিত্রের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ভাবল – ডাক্তারী বিদ্যায় ব কলম এই ছেলে কী এমন এক্সিপেরিমেন্ট করবে।
বিকালের সময়টা ওর কাটে নদী তীরে। প্রমত্তা নদীর তীব্র স্রোত ওর শরীরে জোস আনে। ও অসাধ্য সাধনের প্রেরণা পায় এখান থেকেই। কিছুদিন ধরেই একটা বিষয় ওর মাথায় ঘুরছে। সম্প্রতি মার্গারেট অ্যাটউডের ‘দ্য হ্যান্ডসমেইড টেল’ পড়ে শেষ করেছে। নিজেকে এখন নায়কের চরিত্রে কল্পনা করে চলেছে। অত্যাচারী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দুর্নিবার প্রতিবাদী চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করতেই ও দেখে নদীর স্রোত যেন তীব্রতর হয়েছে। এখন বীরবেশে হাসিমুখে মরতেও দ্বিধাবোধ করবে না ও।
অস্বাভাবিক, সেই সাথে অযৌক্তিক হলেও একটা চিন্তা সৌমিত্র মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। এখন ওর একটা ডিস্টোপিয়ান সাম্রাজ্য দরকার। যেখানে ও প্রতিবাদী নায়কের চরিত্রে আবির্ভূত হবে। কিন্তু এই সাম্রাজ্য পাবে কোথায়? ও ভাবে, একটা নিসঙ্গ দ্বীপ কিনবে। সেখানে আগে ডিস্টোপিয়ান সাম্রাজ্য গড়ে তুলবে। পরে নায়করূপে অত্যাচারিতদের উদ্ধার করতে নিজেই আবির্ভূত হবে।
জীবন নিয়ে ওরা ভাবে না। জীবন সম্পর্কিত উপলব্ধি তো দূরে থাক। তাই সৌমিত্র আর বাকি বন্ধুদের জীবনাদর্শন দুই মেরুতে অবস্থান করে। অন্যরা যখন ক্যারিয়ার, বিত্ত-বৈভব আর বংশ পরম্পরা নিয়ে বিস্তর চিন্তিত তখন সৌমিত্র ভাবে জীবন তো বিকল্প উপায়েও এগোতে পারে। তবে তার বিকল্প জীবনের যৌক্তিকতা নিয়ে সে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নয়। কিছুটা দ্বিধান্বিত হলেও তার জীবনাদর্শনের পেছনে ছুটে চলা সে থামায় না। আবার এই ছুটে চলাতে সে স্থিরও থাকতে পারে না। বন্ধুদের কাছে এগুলো নিতান্ত তাত্ত্বিক আলোচনা। তাই গুরুত্বও কম। তবে একটা জায়গায় বন্ধুরা চাইলেও প্রাকটিক্যাল হতে পারে না – ‘সবজি সেবনের আসরে’।
পান্নার ধারনা এই আসরই সৌমিত্রের জীবনের অর্ধেক রহস্যের আঁধার। ও চেয়েছিল একটা দিন এরকম আসরে থাকতে। কিন্তু সৌমিত্র কখনো রাজি হয়নি। আর তাছাড়া ও চায় না মেয়েটা ওর জীবনের কোন অংশের প্রভাবক হয়ে উঠুক। ইদানীং সৌমিত্র খেয়াল করছে – পান্নার উপস্থিতি ওর দৃঢ় ও শক্তিশালী চেতনাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। ওর চিন্তা, কাজগুলো কেমন যেন জড়রূপ বেষ্টিত হয়ে ওঠে। ও নিজেকে ধরাশয়ী অনুভব করে। সৌমিত্রের শক্তিশালী একটা অনুভূতি তৈরী হয়েছে – মেয়েটি ওর কাছে হিপনোটিজম শিখতে আসেনি, বরং ওকে হিপনোটিজমের শিকার বানাতে এসেছে। সৌমিত্র চায় না পান্নার কোন এক্সপেরিমেন্টের উপাদান হতে। ও এখন পান্নাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে।
আজ রাতে সৌমিত্র বাসায় ফিরবে না। বন্ধুদের সাথে মেসে সবজি সেবনের আসর বসাবে। আগে এই আসর নিয়মিত বিরতিতে বসলেও বন্ধ ছিল অনেকদিন। এমন নির্দিধায় মাদক সেবনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করত অজিত, আবার ওই টুন হয়ে যেত বেশি। অনেকদিন পর সৌমিত্রের আগ্রহে আসর বসছে আজ। অজিতের আপত্তি নেই বিন্দুমাত্র। বোধহয় সেও একটু সাড়া বোধ করছে।
তবে আজ সৌমিত্রের উদ্দেশ্য কিছুটা ভিন্ন। ওর দ্বীপ কেনার গাঁজাখুরে পরিকল্পনা বন্ধুরা স্বাভাবিক অবস্থায় হেসে উড়িয়ে দেবে। তাই গাঁজার আসর কেই বেঁছে নিল ও। পরিকল্পনাও কাজে দিল। স্টিকের শেষের কয়েকটি সুখটান দিতে দিতে মামুন জিজ্ঞেস করে
– টাকা পাবি কোথায়?
এতক্ষণ টুন হয়ে দেয়ালে হেলান দেওয়া নিস্তেজ অবস্থা থেকে চকিত জেগে ওঠে অজিত। রাজনৈতিক নেতাদের মত আশ্বাসের ভঙ্গিতে হাত উচিয়ে বলে-
– আমি দেব। যত টাকা লাগে আমি দেব। তোর আইডিয়াটা ভাল লেগেছে আমার। শুনে শরীরে কেমন যেন জোয়ার বইছে।
একযোগে সবাই হেসে উঠল। বাকিরা নিঃশব্দে হাসলেও মামুন তখনও ধোঁয়া মুখ থেকে পুরোপুরি বের করতে পারে নি। ওর হাসি কাঁশিতে রূপ নিল।
সৌমিত্র ভাবল, অজিতের পুরোপুরি নেশা ধরে গেছে। একটু মজা করা যাক।
– টাকা কোনভাবে ম্যানেজ হয়ে যাবে। ভাবছি……….
এবার খেকিয়ে উঠল অজিত- আরে বললাম তো, আমি দেব।
সৌমিত্র অজিতের এই ছোট্ট বাঁধায় ন্যূনতম বিরক্ত না হয়ে বলে চলল –
– ভাবছি, মানুষের কিডনি ছিনতাই করব। পরেশ ডাক্তারের অপারেশ টেবিলটা রেডি করছি। ওখানেই কিডনি কেটে রাখার ব্যবস্থা করা যাবে।
অজিত একটু মাথা তুলতে যেয়ে আবার নামিয়ে ফেলল। বোধহয় নেশার ঘোরে কথা বলার শক্তি জোগাতে পারছে না।
সৌমিত্র বলে চলল- আপাতত অজিতের কিডনির দিয়ে শুরু করব ভাবছি।
মুহূর্তেই মাথা উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠল অজিতের। শুধু মাথা নয় পুরো মেরুদণ্ড স্কেলের মত সোজা হয়ে গেল। যেন নেশা কেটে গেছে ওর। মুহূর্তকাল অপেক্ষা না করে সোজা রুমে চলে এল অজিত।
অজিত একটু ভীতু প্রকৃতির ছেলে সেটা জানত সবাই। কিন্তু এতটা ভয় পেয়ে যাবে সেটা ভাবেনি সৌমিত্র।
ওরা যে মজা করেছে- সেটা বলতে পিছু পিছু এল সৌমিত্র। কিন্তু ততক্ষণে দরজা ভেতর থেকে লক করে ফেলেছে অজিত। জানালা দিয়ে অজিতকে শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল সৌমিত্র। কিন্তু বেডের উপর অজিতের অস্বস্তিকর অবস্থায় বসে থাকা আর আতঙ্কিত চেহারা দেখে হাসিই যেন থামাতে পারছে না ও। কিন্তু এই হাসি অজিতের কাছে মনে হল – অতি ভয়ংকর, পাশবিক আর ধ্বংসাত্মক।
পরদিন রাতে মামুনকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল সৌমিত্র। জরুরী তলব। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৌমিত্রের নতুন কোন গাঁজাখুরে পরিকল্পনা শুনতে উপস্থিত হল মামুন। বাচ্চাদের কল্পনারাজ্যের মত সৌমিত্রের অদ্ভুত, অসম্ভব ভাবনায় অনাগ্রহী হলেও আজ মজা অনুভব করল মামুন। কারন ভবিষ্যতের ক্রয়কৃত দ্বীপে ডিস্টোপিয়ান সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ববাদী শাসকের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব পায় মামুন। বাচ্চাদের মত ক্ষণিকের জন্য নেচে উঠেছিল ওর মন। মুহূর্তেই নিজের বালখিল্যতার জন্য নিজেই লজ্জা পেল। একটু শক্ত হয়ে উঠল ও। সঙ্গে আত্মাভিমানীও। সৌমিত্র ওকেও তার খেলার উপাদান বানালো? এতটা সিরিয়াসভাবে একজন তার কাছের মানুষদের সাথে কীভাবে মজা করতে পারে? নাকি ও সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে?
মামুন চিন্তার জগত থেকে বাস্তবে ফিরল সৌমিত্রের খোঁচায়-
– কী রে? এখন আমাকে সাইক্রিয়েটিস্ট দেখানোর পরামর্শ দিবি?
মামুনের ধ্যান ভাঙল বটে, তবে সৌমিত্রের মুখের বিজয়ী রহস্যময় হাসির দিকে তাকিয়ে ও ভাবছে ভিন্ন কথা। উদ্ভট কাজে ও সৌমিত্রকে বেশি পাত্তা দিয়ে ফেলছে। নিজেকে কেমন গিনিপিগ মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ভিন্ন প্রসঙ্গ পাড়ল মামুন-
— পান্নার সাথে দেখা করিস না কেন?
— ভাল লাগে না।
— ভাল না লাগলে বলে দিবি- দেখা করবি না। ব্যস। এভাবে ঘুরানোর তো কোন মানে দেখি না। মেয়েটা তো ন্যূনতম ভদ্রতা ডিজার্ভ করে, নাকি?
টেবিল থেকে মুখ তুলল সৌমিত্র। কলমটা ডায়েরী মাঝে রেখে বন্ধ করল ওটা। শরীরটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে বলল-
— ডিস্টোপিয়ান সাম্রাজ্যে মেয়েদের কোন অধিকার নেই, সম্মান নেই। ওদের সাথে যা খুশি করা যায়। সে হিসেবে পান্নার সাথে আমি যথেষ্ট ভদ্রতা দেখিয়েছি, সম্মান প্রদর্শন করেছি।
ধৈর্য্যের সীমাটা লঙ্ঘিত হল বোধহয়। অনেক রাত হয়ে যাওয়ার অজুহাতে উঠে এল মামুন। তবে মামুনের বিরক্তি চোখ এড়াল না সৌমিত্রের। হয়তো সেজন্যই অন্যদিন এগিয়ে দিতে এলেও আজ শুধু চেয়ে রইল চৌকাঠ মাড়িয়ে মামুনের প্রস্থানের পথে।
সৌমিত্রের অতিউৎসাহ কমে এসেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সেটা কমেছে কিনা তা স্পষ্ট না হলেও পারিপার্শ্বিক মানুষদের সম্পৃক্ত করার প্রবণতা কমেছে। এরমধ্যে এল সেমিস্টার ফাইনাল। পরীক্ষা শেষে অনেকে বাড়িতে গেল। কেউ বা গেল ঘুরতে। ফলে কিছুদিন কেউ কারও তেমন খোঁজখবর রাখতে পারল না। তাতে অবশ্য কারও জীবন থেমে থাকল না। কেউ বা ছুটছে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টে, কেউ বা সাময়িক উপার্জনের ধান্দায় আবার কেউ বা কাটাচ্ছে অলস জীবন।
নতুন সেমিস্টার শুরু হবে। মোটামুটি সবাই ফিরতে শুরু করেছে। অজিত ফিরেছে বেশ আগে। মামুন ফিরল গত মধ্যরাতে। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতে গেল। তবুও ঘুমাচ্ছে ও। অজিত কয়েকবার হন্তদন্ত হয়ে ডাকলেও ঝাঁড়ি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে।
দুপুরের কিছু আগে ঘুম ভাঙল মামুনের। ভার্সিটির ফেসবুক গ্রুপে চোখ রাখতেই ওর পুরো শরীর হিম হয়ে গেল। দেরী না করে ওই অবস্থায়ই বেরিয়ে পড়ল ও।
সিলিং ফ্যানে ঝুলছে সৌমিত্রের লাশ। ওর বাবা লাশের দিকে পেছন ফিরে টেবিলের কাগজপত্রগুলো উল্টেপাল্টে দেখছেন আর প্রতি মুহূর্তে যেন বিস্মিত আর বিস্ফোরিত হচ্ছেন। উঠোনের ভিড় ঠেলে সৌমিত্রের বাবার পাশে এসে দাঁড়াল মামুন। উনি একটা চিরকুট ওর হাতে ধরিয়ে দিলেন। সেখানে সৌমিত্রের নিজ হাতে লেখা-
‘আমি জাহান্নামে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’
–‘তুমি তো সবই জানতে। একবারও বললে না আমাদের।’ মামুন কথা বলতে পারল না। শুধু একবার মুখ তুলে তাকাল সৌমিত্রের বাবার মুখের দিকে।
এক সপ্তাহে কীভাবে কাটল কেউ জানে না। সবকিছু যেন থেমে গেছে ওদের কয়েকজন বন্ধুর। ধাক্কা সামলে ওঠাই ওদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ভীতু অজিতই শক্ত হয়ে সবাইকে শান্ত্বনা দিচ্ছে। আবার আড়ালে গিয়ে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে।
মামুনকে এখন বেশি পাওয়া যায় নদী তীরে যেখানে সৌমিত্রের অধিকাংশ বিকেল কাটত। প্রথমদিকে অজিত ভাবত কিছুদিনের মধ্যে হয়তো শোক কেটে যাবে। হ্যাঁ, সবাই তুলনামূলক হালকা হয়েছে, মামুনও। তবে স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে এভাবে নদীপাড়ে বসে বন্ধুর জন্য শোক আর কতদিন!
এক বিকালে অজিত যায় নদীপাড়ে। উদ্দেশ্য- মামুনকে শোক কাটাতে সহায়তা করা। পাশে বসে কীভাবে শান্ত্বনা দেওয়া যায় মনে মনে সেটারই স্ক্রিপ্ট তৈরী করতে থাকে অজিত।
এর মধ্যেই মামুন বলে ওঠে-
-অজিত
– হু। চকিত হয়ে উত্তর দেয় অজিত।
– একটা দ্বীপ কিনতে যত টাকা প্রয়োজন সেটা ম্যানেজ করতে কতজন মানুষের কিডনী ছিনতাই করা লাগবে?
– তুই কী বলছিস এসব?
– সৌমিত্র মরে গেছে। কিন্তু ওর স্বপ্ন তো আর মরে যায় নি।
আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করে না অজিত। হাঁটতে শুরু করে। ভীতু আর আতঙ্কিত দৃষ্টিতে একবার ফিরে তাকায়। মামুন ওর গন্তব্যে চেয়ে হাসছে। আরও চওড়া হচ্ছে সেই হাসি। অজিতের মনে পড়ল সৌমিত্রের সেই পাশবিক আর ধ্বংসাত্মক হাসির স্মৃতি। তবে ওর মনে হল মামুনের এই হাসি আরও ক্রুর, বিধ্বংসী আর সর্বনাশী। অজিত এখন দৌড়াতে শুরু করেছে।
খুলনা গেজেট /এমএম