পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামিন কুরআনুল কারীমে নির্দেশ প্রদান করেছেন, এরশাদ হয়েছেঃ
يٰبَنِىٓ ءَادَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِندَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوٓا ۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ
অর্থঃ হে বনী আদম! প্রত্যেক নামাযের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক গ্রহণ কর। আর খাও এবং পান কর কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না। -সূরা আ’রাফ, আয়াত ৩১
আর আল্লাহ তা‘আলা পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থাপনা দ্বারা বনী আদমের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ হে বনী আদম! অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি, তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত ও বেশ-ভূষার জন্য। আর তাকওয়ার পোশাক; এটাই সর্বোত্তম। -সূরা আ’রাফ, আয়াত ২৬
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর বাণীর মাধ্যমে নির্দেশ প্রদান করতঃ এরশাদ করেনঃ
كُلُوا، وَتَصَدَّقُوا، وَالْبَسُوا فِي غَيْرِ إِسْرَافٍ، وَلَا مَخِيلَةٍ
তোমরা খাও, পান কর, পোশাক পরিধান কর এবং দান কর; তবে অপচয় ও অহঙ্কার পরিহার করো। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৫৫৯
অনুরূপভাবে নবী ﷺ বৈধ ও অবৈধ পোশাকের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বর্ণনা দিয়েছেন পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় পোশাক-পরিচ্ছদের; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির দায়িত্ব ও কর্তব্য হল— তার পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে নিম্নোক্ত আদবসমূহের প্রতি খেয়াল রাখাঃ
১. সাধারণভাবে রেশমী পোশাক পরিধান না করা, চাই তা কাপড়ের ক্ষেত্রে, পাগড়ীতে অথবা অন্য যে কোনো পোশাকেই হউক; রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: তোমরা রেশমী পোশাক পরিধান করো না; কারণ দুনিয়াতে যে ব্যক্তি তা পরিধান করবে, আখেরাতে সে তা পরিধান করা থেকে বঞ্চিত হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৩২
তিনি আরও বলেন:
حُرِّمَ لِبَاسُ الْحَرِيرِ وَالذَّهَبِ عَلَى ذُكُورِ أُمَّتِي وَأُحِلَّ لإِنَاثِهِمْ
আমার উম্মাতের মধ্যে পুরুষদের জন্য রেশমী পোশাক এবং স্বর্ণালংকার ব্যবহার হারাম করা হয়েছে এবং মহিলাদের জন্য তা হালাল করা হয়েছে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৭২০
২. কাপড়, লুঙ্গি, পাজামা, অথবা চাদর এমন লম্বা না হওয়া, যা তার দুই টাকনুর নীচে চলে যায়; রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ ইযার বা পরিধেয় বস্ত্রের যে অংশ পায়ের গোড়ালির নীচে থাকবে, সে অংশ জাহান্নামে যাবে। -সহীহ বুখারী, হাদিস ৫৭৮৭
৩. সাদা পোশাককে অন্যান্য পোশাকের উপর প্রাধান্য দেয়া এবং সকল রঙের পোশাককে বৈধ মনে করা; তবে বিশেষভাবে টকটকে লাল, হলুদ ও কুসুম রঙ এবং যে রঙের পোশাক সমাজে মহিলাদের জন্য প্রচলিত, পুরুষগণ ঐ ধরণের রঙ ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
عَلَيْكُمْ بِالْبَيَاضِ مِنَ الثِّيَابِ فَلْيَلْبَسْهَا أَحْيَاؤُكُمْ، وَكَفِّنُوا فِيهَا مَوْتَاكُمْ، فَإِنَّهَا مِنْ خَيْرِ ثِيَابِكُمْ
তোমরা সাদা রঙের কাপড় পরিধান করবে। তোমাদের জীবিতরা যেন সাদা কাপড় পরিধান করে এবং মৃতদেরকে সাদা কাপড় দিয়ে দাফন দেয়। কেননা, সাদা কাপড় তোমাদের সর্বোত্তম পোশাক। -সুনানে নাসায়ী, হাদিস ৫৩২৩
৪. মুসলিম রমনী কর্তৃক এমন লম্বা পোশাক পরিধান করা, যা তার দুই পায়ের পাতাকে ঢেকে দেয় এবং তার ওড়নাকে মাথার উপর এমনভাবে ঝুলিয়ে দেয়া, যাতে তা তার ঘাড়, গলা ও বুক ঢেকে দেয়; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। – সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৯
উম্মু সালামা রা. বলেন: যখন নাযিল হল: ﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ﴾ অর্থাৎ হে নবী ﷺ! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়, তখন আনসার রমনীগণ তাদের মাথা এমনভাবে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে বের হত, মনে হয় যেন তাদের মাথার উপর কাক বসে আছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪১০১
৫. পুরুষের জন্য স্বর্ণের আংটি পরিধান না করা; রাসূলুল্লাহ ﷺ স্বর্ণ ও রেশমের ব্যাপারে পুরুষদের সতর্ক করেছেন।
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে এসেছে: একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ এক ব্যক্তির হাতে একটি স্বর্ণের আংটি দেখতে পেলেন; অতঃপর তিনি আংটিটি তার হাত থেকে খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন: ‘তোমাদের কেউ কি ইচ্ছা করে জ্বলন্ত অংগার হাতে রাখবে!’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর লোকটিকে বলা হল: তুমি তোমার আংটিটি উঠিয়ে নিয়ে অন্য কোন কাজে লাগাও। সে বলল: আল্লাহর কসম! যে জিনিসটি রাসূলুল্লাহ ﷺ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, তা আমি কখনও নেব না। -সহীহ মুসলিম, হাদিস ৫৩৬৫
তবে পুরুষের জন্য পাথর সম্বলিত/নিরেট এক মিসকাল (৩.৩৭৪ গ্রাম) ওযনের কম রূপার আংটি ব্যবহার করা বৈধ।
আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী ﷺ রূপার আংটি ব্যবহার করতেন। আর তার আংটিতে আবিসিনীয় পাথর বসানো ছিল। -শামায়েল, হাদীস ৬৯
৬. পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্য এমন পোশাক পরিধান না করা, যা তার শরীরের সাথে আঁটসাঁট হয়ে লেগে থাকে এবং তাতে তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে; বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য এমন টাইট ফিটিং পোষাক পরিধান করা হারাম যা তাদের পবিত্রতা ও পর্দা লঙ্ঘন করে; নবী করিম ﷺ এ ধরনের পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। আর এক পায়ে জুতা পরে না হাঁটা; কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: তোমাদের কেউ যেন এক পায়ে জুতা পরে না হাঁটে— সে যেন হয় উভয় পায়ে জুতা পরিধান করে, অথবা উভয় পা খালি রাখে।
৭. মুসলিম পুরুষ কর্তৃক সমাজে প্রচলিত মুসলিম নারীর পোশাক এবং মুসলিম নারী কর্তৃক সমাজে প্রচলিত মুসলিম পুরুষের পোশাক পরিধান না করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ এটা হারাম করে দিয়েছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন:
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ
রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদের বেশধারণকারী পুরুষ এবং পুরুষের বেশধারণকারী নারীদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদিস ৫৮৮৫
৮. কাপড়, জুতা ইত্যাদি পরিধান করার ক্ষেত্রে ডান দিক থেকে শুরু করা; খোলার ক্ষেত্রে বাম দিককে প্রাধান্য দেওয়া। আয়েশা রা. বলেনঃ রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সকল কাজে ডান দিকে থেকে শুরু করতে পছন্দ করতেন; যেমন- জুতা পরতে, চুল-দাড়ি আঁচড়ানোতে এবং অযু করতে। -সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস ৮০১
০৯. নতুন কাপড়, পাগড়ী অথবা যে কোনো পোশাক পরিধান করার সময় এ দো‘য়া পাঠ করবেঃ
للَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ كَسَوْتَنِيهِ أَسْأَلُكَ خَيْرَهُ وَخَيْرَ مَا صُنِعَ لَهُ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهِ وَشَرِّ مَا صُنِعَ لَهُ
অর্থঃ হে আল্লাহ! তোমারই জন্য সকল প্রশংসা, তুমিই আমাকে এ কাপড় পরিয়েছ। আমি তোমার কাছে এর অন্তর্নিহিত কাল্যাণ চাচ্ছি এবং ঐ কল্যাণও প্রত্যাশা করছি তোমার কাছে, যার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। আর আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি এ কাপড়ের অনিষ্টতা থেকে এবং ঐ অনিষ্টতা ও অকল্যাণ থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। এ দুআটি রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে। -জামে তিরমিযী, হাদিস ১৭৬৭
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতঃ আমল করার তাওফিক দান করুন, আমীন।
লেখক : ইমাম ও খতিব
কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ও
সদস্য, আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন, খুলনা।
খুলনা গেজেট/ টি আই