মে ২০২১, দ্বিতীয় সপ্তাহ। মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘে একটি ভার্চুয়াল সভা হচ্ছিল। এ সমস্ত প্রোগ্রামে শেষপর্যন্ত যা হয় ইদানীংকালে, সভায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি কথাকাটাকাটিতে লিপ্ত হলো চীনের সাথে। উপলক্ষ জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর সম্প্রদায় (US, UK, Germany clash with China at UN over treatment of Uyghur Muslims in Xinjiang)।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে তাঁর জবাব দেওয়া হলো Floyd এর I can’t breathe কথাটা স্মরণ করিয়ে**। পাশাপাশি তারা অতিমারিতে সেখানে অগণিত মৃত্যুর প্রসংগ তুললো ও হঠাৎ হঠাৎ গনগোলাগুলিতে আমেরিকার মানুষের প্রাণ যাওয়ার কথা বলল।
চীন ব্যঙ্গ করে আরো বলল, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় আয়না পাওয়ার হকদার। সেই আয়নায় তারা নিজেদের মানবাধিকার ইস্যুগুলি ভালমত দেখবে (US deserves world’s largest mirror to have a good look at itself on human rights issues, গ্লোবাল টাইমস, ১৩ মে ২০২১)
মরিয়া চীন প্রাণান্তকরভাবে নিজেদেরকে ডিফেন্ড করতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অ্যালায়েন্স স্ট্রাটেজির বিপরীতে। ১৪ মে তারিখ পিপলস ডেইলি অনলাইন তাদের ওয়েব পেইজে একটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ করেছে।
ক্লিপে এক কানাডিয়ান ভদ্রলোক চীনের ন্যানিংএর রাস্তায় হাটতে হাটতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার তুলনামূলক একটি চিত্র আঁকছেন। বিষয়টি কৌতুহলোদ্দিপক ও চিন্তাউদ্রেককারী।
শিরোনামটাও বেশ প্রত্যক্ষভাবে উচ্চারিত, যা সচকিত করে তোলে সকলকে : কেন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ছোটো করে দেখার অবস্থায় নেই Why is the U.S. in no position to belittle China।
ভদ্রলোক বললেন, আসুন দেখি, যুক্তরাষ্ট্র কি করেছে আর চীন কি করেছে। মনে আছে আপনাদের? ট্রাম্প কিছু মুসলিম দেশ থেকে নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, ক্ষমতার প্রারম্ভে? কেন করেছিলেন?
কারন তারা মুসলিম। অন্যদিকে, চীন দেখুন সেদেশে রিএডুকেশন ক্যাম্পে মুসলমানদের নিয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলছে, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর হয়। যুক্তরাষ্ট্র কি করেছে? সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাকে বোমা ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অনেক জায়গায় যুদ্ধ করেছে, অনেক জায়গায় পুলিশি তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অদ্যাবধি, অন্যসব দেশের চেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক বেশী ব্যর্থ ও সফল সামরিক ক্যুর জন্য কারা দায়ী? যুক্তরাষ্ট্র। কিভাবে তারা শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে নিজেদের দাবি করে?
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চীন সামরিকায়ন করছে। হ্যাঁ বিশ্বে চীন একটা সামরিক হুমকি। অভিযোগটা কারা করছে? করছে তারা, যাদের সারা বিশ্বে ৮০০র উপরে সামরিক ঘাটি রয়েছে।
আমরা ঘাটি করতে পারি, আপনারা করতে পারেন না। কেন? কারণ যুক্তরাষ্ট্রে একটা ডাবলস্টান্ডর্ডনেস রয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্র এই ডাবলস্টান্ডর্ডনেস নিয়ে চলছে।
চীনে রয়েছে ৪০ হাজার কিলোমিটার হাইস্পিড রেইললাইন, যুক্তরাষ্ট্রে একটাও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনে মানুষ অধিকতর মুক্তভাবে ও কমখরচে ঘোরাফেরা করতে পারে।
চীন এত দ্রুত সবকিছু করে ফেলতে পারে যে, তা যুক্তরাষ্ট্র নয় শুধু, বিশ্বের কোনদেশই তত তাড়াতাড়ি তা করে ফেলতে পারে না। চীন দিন দিন ধনি থেকে আরো ধনি হচ্ছে, তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার পরিসর দিনদিন বাড়ছে। তাদের অবকাঠামোগত উন্নতি দারুনভাবে ঈর্ষণীয়।
এই যে শহরে হাটছি আমি, এখানে ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ চীনা ভাষায় কথা বলে। ফরেনার আমি, অথচ দেখুন আমি নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ বোধ করছি। কেন? কারণ, চীনারা ফরেনারদের শ্রদ্ধা করে (প্রাগুক্ত)
কি কাজ হবে এতে? কতজন এটা দেখবে?
বিশ্বের বেশীরভাগ ইংরেজি ভাষার প্রচারযন্ত্রের উপর পশ্চিমাদের রয়েছে শক্তিশালী প্রভাব। ভাগ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, যেখানে বাইডেন তার অ্যালায়েন্স সিস্টেমের চালটা ভালভাবেই দিয়েছেন। একটা উদাহরণ দেয়া যাক।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রথম যে মানুষটার সাথে হোয়াইট হাউজে মিলিত হন, তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। আর এবার জো বাইডেন প্রথম সাক্ষাৎ দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগাকে।
কিছুদিন আগে, দ্বিতীয় যে মানুষটাকে বাইডেন সাক্ষাৎ দিয়েছেন, তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। এসবই হলো অ্যালায়েন্স সিস্টেমকে স্ট্রং করে চীনকে ফেস করার স্ট্রাটেজিক স্টেপস (Joe Biden is gathering his friends close as he prepares to confront China, ডব্লিউএটুডে, ২৫ মে ২০২১)।
শুধু তাই না, বাইডেন একটি কঠিন কাজ করেছেন। কি সেটা?
তিনি অপেক্ষায় রেখেছেন শি জিন পিংকে। অথচ, জুনের মধ্যে তার সাথে দেখা হতে পারে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের, আলাপ আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত।
Nord Stream 2 gas pipeline project এর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও আমেরিকা এই প্রজেক্টের সিইও জার্মান নাগরিক Matthias Warnig কে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রেখেছে। কারণ, এই ভদ্রলোকের সাথে পুতিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ, মঞ্চ পুরোপুরি প্রস্তুত (Stage is set for crucial Biden-Putin summit, এশিয়া টাইমস, ২৩ মে ২০২১)
প্রশ্ন উঠেছে, আমেরিকা কি চাইছে চীনের দিক থেকে রাশিয়াকে সরিয়ে নিতে? চীনের সাথে রাশিয়ার যে সম্পর্ক, মূলত: যা দৃঢ় হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আরোপের সূত্রে, তা কি এবার নষ্ট হয়ে যাবে?
চীন মনে করে, নষ্ট হবে না। কেন? কারণ, যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের প্রেশারে, গড়ে উঠেছে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে, তা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারোট প্রদানের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে নষ্ট হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিভেদের বীজ বোনার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীন রাশিয়া বন্ধন অটুট থাকবে (China-Russia ties unaffected by US tactics to sow discord, গ্লোবাল টাইমস, ২৪ মে ২০২১)।
তবে এখানে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা তাহলো, জুনে পুতিনের সাথে বাইডেনের শীর্ষ বৈঠকের আগে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সভা হবে। China’s top diplomat heads to Russia as ties reach ‘best level in history’। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ২৩ মে ২০২১। কি হবে সেই বৈঠকে? আমেরিকার অ্যালায়েন্স সিস্টেমকে কাউন্টার করা?
গ্লোবাল টাইমসে উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার করে দেওয়া হলো একই দিন (২৩ মে ২০২১)। সেটা হলো Moscow and Beijing will counter geopolitical games of Washington।
রাজনীতিটা কি মাঠের খেলার মত কোনো খেলা? সম্ভবত না। কারণ বেশীরভাগ মাঠের খেলা জয় পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়, সেখানে সংঘাতের শংকা থাকে ০ বা ১ শতাংশ। কিন্তু রাজনীতিগত খেলায় কোনো সহজ সমীকরণ নেই, উইনউইন সিচুয়েশন তৈরি করা সেখানে কঠিন এক আর্ট। আর দিনদিন সেটা কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে কারণ, রাজনীতির নিয়ামক হয়ে গেছে এখন পেশিশক্তি ও অর্থ। সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বা অধিকতর সুন্দর কৌশল প্রণয়নের প্রত্যুতপন্নমতিতা হিসেবে রাজনীতিকে দেখা হচ্ছে না। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে সংঘাতের শংকা তাই প্রতি পদেপদে।
আর তাই, জাপান থেকে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা, ভোগবাদী পৃথিবীর কোনো প্রান্তের মানুষ স্বস্তিতে নেই।
খুলনা গেজেট/এনএম