বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ১০টির উপাচার্যদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়মসহ বেশ কিছু অভিযোগের তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তের পর সে বিষয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমাও দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের বলেন, তার তত্ত্বাবধানেই এ পর্যন্ত ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। আর বাকিগুলোও চলে আসবে। ইউজিসির অন্য সদস্যদের কাছেও আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও সেগুলোর উপাচার্যদের নিয়ে তদন্তের কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
তবে ইউজিসির এই তদন্তের বিষয়টি সামনে আসার পর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্কও।
কী অভিযোগ ভিসিদের বিরুদ্ধে?
মি. তাহের জানান, ভিসিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তার মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি আর্থিক বিভিন্ন বিষয় ও অনিয়ম নিয়ে। আর বাকি যেসব অভিযোগ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে।
তিনি বলেন, “দেখা গেলো যে, কেউ গ্রেড পাবে সি, তাকে সেটি আপ করে দেয়া হয়েছে। উনার হয়তো অ্যালাউন্স নেয়ার প্রয়োজন নাই, কিন্তু তিনি নিচ্ছেন – বা যে নিয়ম ফলো করা উচিত সেটা করছেন না।”
তিনি জানান, নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পছন্দের প্রার্থীর জন্য নিয়োগের নিয়মকানুন শিথিল করা হচ্ছে। আবার যে যে পদের যোগ্য নয়, তাকে সে পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতি নিয়ে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও সংবাদ প্রচার হতে দেখা গেছে।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে
মি. তাহের বলেন, এর আগে ইউজিসির অভিযোগে প্রেক্ষিত্রে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে আসার পর এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে মঞ্জুরি কমিশনকে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকারের দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্সের’ যে নীতি রয়েছে সেই নীতির আওতায়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব অভিযোগের তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।
অভিযোগ অস্বীকার বেরোবি’র উপাচার্যের
সম্প্রতি যেসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে ৪০টিরও বেশি অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসির দুটি দল। এরই মধ্যে একটি দল তাদের তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। যেখানে কয়েকটি ভবন নির্মাণকাজে অনিয়মের উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়। আর এ কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ দেয়া হয় প্রতিবেদনে।
তবে বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করে বেরোবির উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ দাবি করেছেন যে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তা ‘মিথ্যা ও বানোয়াট।’ তিনি নিজের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
পাল্টা অভিযোগ করে মি. কলিমুল্লাহ বলেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং আশকারায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং ইউজিসি তদন্ত করেছে।
“আজকের যে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি আমি খুব খোলামেলা বলবো এবং দায়িত্ব নিয়ে বলবো, এই পুরো পরিস্থিতি আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আশ্রয়, প্রশ্রয় এবং আশকারায় এই অবস্থায় এসেছে।”
তিনি বলেন, “ইউজিসির রিপোর্ট এরকমটি কেন হয়েছে, সেজন্য আমি মনে করি এর পেছনে পরিপূর্ণভাবে দায়-দায়িত্ব শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের।”
মি. কলিমুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, তার প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর এমন আচরণের পেছনে কুমিল্লা ও চাঁদপুরের রাজনীতি রয়েছে। তিনি জানান, শিক্ষামন্ত্রী এবং তার বাড়ি একই অঞ্চলে।
“শিক্ষামন্ত্রী যে আসনে প্রতিনিধিত্ব করেন সেটি আমার নানা প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরীর কন্সটিটুয়েন্সি। কাছের আরেকটি আসনে প্রতিনিধিত্ব করেন আমার সেজো মামা ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর।”
তিনি বলেন, “চাঁদপুরের একটা রাজনীতি আছে। সে বিষয়টা প্রচ্ছন্ন ভাবে হয়তো এখানে কাজ করেছেন।”
কী বলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়?
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মি. কলিমুল্লাহর সংবাদ সম্মেলনের পর এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে নানা ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)কে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর অনুরোধ করা হয়।
ইউজিসি একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এই তদন্ত প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর অভিযোগ অসত্য, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এতে অভিযোগ করা হয়, মি. কলিমুল্লাহ সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য রেখেছেন যা নিতান্তই অনভিপ্রেত। একই সাথে এ ধরণের বক্তব্য অনাকাঙ্খিত, দুঃখজনক এবং রুচিবিবর্জিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র সংসদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা থাকা জরুরী।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মি. কলিমুল্লাহ শিক্ষামন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার কথা উল্লেখ করে রাজনীতিকে জড়িয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন যার সাথে মন্ত্রণালয়ের কোনো বিষয়ের কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই। যার কারণে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছে। এছাড়া মি. কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর তদন্ত শেষ না হওয়ায় এবং এখনো কিছু তদন্ত চলমান থাকায় এ নিয়ে মন্ত্রণালয় এই মুহূর্তে কোন মন্তব্য করবে না বলেও জানানো হয়।
“জবাবদিহিতা নেই”
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনাগুলো ঘটে তাকে – কারণ উপাচার্য কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোন ধরণের জবাবদিহিতার জায়গা নেই।
তারা বলছেন, দুর্নীতি এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। সমাজের কোন অংশ নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। আর দুর্নীতির যে সাধারণ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পড়ে গেছে – যা কাম্য নয়।
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এসব দুর্নীতির একটা কারণ হচ্ছে কোন জবাবদিহিতা নেই। তিনি বলেন, যারা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান তাদের একটাই জবাবদিহিতা থাকে, সেটি হলো সরকারের কাছে। আর সেই জবাবদিহিতা কোন কাজে দেয় না। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক – এই দুই জায়গায় উপাচার্য এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা থাকা জরুরী। কিন্তু এটা নেই।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্র সংসদ নেই। ছাত্র সংসদের সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
“তারা সতর্ক থাকেন এবং সচেতন থাকেন যে ছেলে-মেয়েরা তাদের দেখছে এবং তারা প্রশ্ন করবে।”
তিনি বলেন, আরেকটি জবাবহিদিতার জায়গা হলো শিক্ষক সমিতি। তবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সমিতি থাকলেও তারা এ সব বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলে না। এর বড় কারণ হিসেবে মি. ইসলাম উল্লেখ করেন যে, শিক্ষক সমিতিতে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনের প্রবণতা গড়ে উঠেছে যার কারণে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, দুর্নীতি বা অনিয়মের বিরুদ্ধে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশের পর একটা আলোচনা হয়। তার পর তদন্তও হয়। কিন্তু তদন্তে কী বের হলো এবং পরে কী ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হলো – সে সম্পর্কে জানা যায় না। তিনি মনে করেন, এই চর্চা বন্ধ করা না গেলে কোনভাবেই এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। সূত্র : বিবিসি বাংলা।