জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কখনও অতিবৃষ্টি, কখনও অনাবৃষ্টি হচ্ছে। খরা-জলাবদ্ধতায় খুলনায় আমন চাষে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ভাদ্র মাস শেষের পথে, তবুও অর্ধেক জমিতে আমন রোপন সম্ভব হয়নি।ভারী বৃষ্টি ও বাঁধ ভেঙে আমন ক্ষেত ও বীজতলা নষ্ট হওয়ায় চাষিরা দিশেহারা।
এদিকে, সুন্দরবন উপকূলবর্তী চার উপজেলাসহ খুলনার অধিকাংশ খালগুলো দিয়ে ঠিকমত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ইজারার শর্তভঙ্গ ও দূষণে ভরাট খালগুলো পানি নিষ্কাশনে বড় বাঁধা। ইজারাকৃত খালগুলোতে বাঁধ-পাটা দিয়ে একাধিক খন্ড তৈরি করায় যথাযথ পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য খালে লবনপানি তোলায় পানি নিষ্কাশনের সময় উল্টে জমিতে লবনপানি ঢুকে পড়ে। বিশেষ করে পর্যাপ্ত স্লুইসগেটের অভাবে এ সমস্যা বেশি হচ্ছে।
সরেজমিন খুলনার কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার বেশ কয়েকটি বিলে দেখা যায়, কৃষকরা আমন আবাদে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করছেন। কেউ বীজতলা থেকে ধানের পাতা তুলছেন, কেউ নতুন বীজতলায় বীজ বপন করছেন।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময়ে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আমন রোপন করা হত। এখন আষাঢ় মাসে বৃষ্টির দেখা মেলেনা। বীজতলাও প্রস্তুত করতে পারেন না। শ্রাবণে বীজতলা তৈরি করলেও ভারী বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর দুই থেকে তিন বার বীজতলা তৈরি করতে হচ্ছে। বিলম্বে আমন রোপন করতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচও বাড়ছে। আমন উত্তোলনের পরে তরমুজ, শীতকালীন সবজিসহ নানা ফসল ফলানো গেলেও বিলম্বের ফলে ভালো দাম পান না তারা। সেচের পানির অভাবে বোরো উৎপাদনেও ব্যাহত হয়। খালগুলো খনন ও ইজারামুক্তের দাবি তাদের।
কয়রা উপজেলার কালনা বিলের কৃষক নূরুল ইসলাম ও ইউনুস আলী জানান, ভারী বৃষ্টিতে তাদের ৮০ ভাগ বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। পরে অন্যস্থানে বীজতলা তৈরি করেছেন। এখনও বিলে যে পরিমাণ পানি রয়েছে তাতে আবাদ সম্ভব না। শাকবাড়িয়া খাল দিয়ে এই বিলসহ পাশ্ববর্তী চারটি বিলের পানি সরানো হয়। ওই খালে বাঁধ ও নেট-পাটা দিয়ে কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। খালের পশ্চিম ভাগের কালভার্ট সম্পূর্ণ বন্ধ করে মাঠ তৈরি করা হয়েছে। আর পূর্বভাগের ব্রীজ ঘূর্ণিঝড় আইলায় ভেঙে যাওয়ায় বাঁধ দেয়া হয়। সেই বাঁধ কেটে পানি সরবরাহ করতে হয়। স্লুইসগেট না থাকায় জোয়ারের লবনপানি জমিতে ঢুকে পড়ে।
একই উপজেলার মাদারবাড়ি, লক্ষীখোলা, দেয়াড়া বিলের পানি সরানোর সহজ পথ বেড়ের খাল দিয়ে। তবে বেড়ের খালে বাঁধ দিয়ে লবন পানির চিংড়ি চাষ করায় পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হয়। বিগত কয়েকবছর ওই বিলের চাষিদের উৎপাদন খরচ না উঠায় অনেকেই আমন ধান চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। নারায়নপুর খালে স্লুইজ গেট থাকার পরেও ইজারা দেওয়ায় পাশ্ববর্তী বিলের পানি নিষ্কাশনে চরম বেগ পেতে হচ্ছে। এমন চিত্র কয়রার প্রতিটি ইউনিয়নের।
শুধু কয়রায় নয়, পাইকগাছার ধামরাইল, কাওয়ালী, ঢ্যামশাখালী, লক্ষীখোলা, মাঝির বিল, বোয়াল মারিয়া, হুলোর বিল, কাটিপাড়া উত্তর চরবিল, ধোপা খোলার বিল, বাকার চর, রূপসার নর্ণিয়া, বাগমারা ও জাবুসাসহ দাকোপ, বটিয়াঘাটা, তেরখাদা, ডুমুরিয়া ও দিঘলিয়া উপজেলার বিভিন্ন বিলে জলাবদ্ধতায় আমন রোপনে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে।
বটিয়াঘাটা উপজেলার কৃষক শাহাদাত হোসেন জানান, বিলে পানি থাকায় আমন দেরিতে রোপন করতে হচ্ছে। আমন ধান কেটে তরমুজ চাষ করা হয়। বিলম্বের ফলে তরমুজের ভাল দাম পাইনা।
নদীর বাঁধ ভেঙে আমনে ক্ষতি
২৯ আগস্ট পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর গ্রামে ভদ্রা নদীর ৩০০ ফুট বাঁধ ভেঙে ১৩ গ্রামে পানি প্রবেশ করে। পাঁচ দিন পরে বাঁধ মেরামত সম্ভব হলেও ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। ওই ইউনিয়নে দুই হাজার দুইশ’ হেক্টর জমিতে আমন রোপনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ইতোমধ্যে রোপনকৃত ৯৫০ হেক্টর আমন ধানক্ষেত ভেসে গেছে। এছাড়া ২২৫ হেক্টর বীজতলা নষ্ট হয় বলে কৃষি দপ্তর জানায়। ফের বীজতলা তৈরির জন্য তিন মেট্রিক টন বীজ দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
পাইকগাছা উপজেলার কৃষক শাহিনুর ইসলাম বলেন, কখনও ভারী বৃষ্টিতে বিল-মাঠ ডুবে যাচ্ছে, কখনও মোটেও বৃষ্টি হচ্ছে না। এ বছর বাঁধ ভেঙে আমন ক্ষেতসহ বীজতলা ভেসে যাওয়ায় চিন্তিত।
জলবায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতে তারতম্য
খুলনা জেলা সদরে ও কয়রায় আবহাওয়া অফিস রয়েছে। খুলনায় ২০২২ সালে জুনে ৭৬ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ১১৬ মিলিমিটার এবং আগস্টে ১৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ২০২৩ সালে জুনে ২২৮ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ১৫১ মিলিমিটার ও আগস্টে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। চলতি বছরে জুনে ৬৩ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৪১৬ মিলিমিটার ও আগস্টে ৪৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এদিকে, কয়রায় ২০২১ সালে জুনে ৬৯৯ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৬৮২ মিলিমিটার ও আগস্টে ২৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০২২ সালে জুনে ১১৪ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৩৪২ মিলিমিটার ও আগস্টে ৩৬৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ২০২৩ সালে জুনে ৪০৪ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ২৯৫ মিলিমিটার ও আগস্টে ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। চলতি বছরে জুনে ১৩৯ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৩৪৫ মিলিমিটার ও আগস্টে ৯৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। রিপোর্টে দেখা যায়, বর্ষাকালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। এছাড়া কোন বছর অতিবৃষ্টি, কখনও অনাবৃষ্টি হচ্ছে।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আমিরুল আজাদ বলেন, ২০১৯ ও ২০২২ সালে বৃষ্টিপাত অনেক কম ছিল। আবার ২০২১, ২০২৩ ও চলতি বছরে বৃষ্টিপাত বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেএমন হচ্ছে। বেশি বেশি গাছ রোপনের পরামর্শ দেন তিনি।
ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষি দপ্তরের সুপারিশ
সম্ভাব্য ফসল আবাদ নিয়ে কয়রা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর প্রাথমিক পর্যায়ে ৩৯টি খাল নিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লুইসগেট নিয়েও প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে কয়রার ২০ টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৬টি সম্পূর্ণ অকেজো ও ১৪ টি সংস্কারযোগ্য উল্লেখ করা হয়েছে। হোগলা, বীণাপানী, খিরোল ও নাকশাতে নতুন ৪টি স্লুইসগেট নির্মাণের সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়রার ৩৯ টি খালে নোনা পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং খননের মাধ্যমে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে খাল সংশ্লিষ্ট জমিতে বছরে ৩৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার ফসল উৎপাদন সম্ভব। তন্মধ্যে বোরো, আউশ ও আমন ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির কথা উল্লেখ রয়েছে। খালগুলোর মধ্যে ১৮ টি খাল ১০ লাখ ৮২ হাজার ৬২৫ টাকায় ইজারা দেওয়া রয়েছে। পাইকগাছা উপজেলার ১৫টি খাল ও ১৫টি স্লুইসগেট সংস্কারের সুপারিশ করে একই রকম প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা
পাইকগাছা উপজেলার কৃষি অফিসার অসীম কুমার দাশ। তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা ও খরার কারণে বিগত কয়েক বছর কয়রা ও পাইকগাছাতে বিলম্বে আমন চাষ করতে হচ্ছে। বিগত কয়েকদিনের ভারি বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে বীজতলা নষ্ট হওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইকগাছা উপজেলায় ১৭ হাজার ১২০ হেক্টর ও কয়রায় ১৬ হাজার ২৩৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কয়রাতে লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ শতাংশ ও পাইকগাছাতে ৫৩ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ সম্পন্ন হয়েছে। খালের বাঁধ, নেট-পাটা অপসারণ, খাল খনন, স্লুইসগেট নির্মাণ ও সংস্কারসহ নোনা পানি উত্তোলন বন্ধ করলে কয়রা-পাইকগাছার কৃষি অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, যে কোন খালে বাঁধ কিংবা নেট-পাটা দিয়ে পানি সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করলে বা দুষণের শিকার হলে এক সময় তা ভরাট হয় যায়। আর খাল সংলগ্ন এলাকায় বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও শীতের সময় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে সংকট তৈরী করে। খালের ব্যাপ্তি অনুযায়ী কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির পাশাপাশি এর দখল সংযুক্ত নদী বা বিলের মৃত্যু ঘটায়।
খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপ-পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, খুলনায় ১০৮ শতাংশ বীজতলা তৈরি করা হয়। ক্ষতির পরে নতুন আরও বীজতলা তৈরি হয়েছে। আশা করছি চারার সংকট হবে না। এ বছর জেলায় ৯৪ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, জেলায় ২২ হাজার ৬শ’ জন চাষিকে বীজ ও সার দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে কয়েকটি খাল খনন করা হয়েছে। বাকি খাল খনন, স্লুইসগেট নির্মাণ-সংস্কারসহ খালের ইজারা ও সম্ভব্য ফসলের তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো রয়েছে।