শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জনের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করলেও নতুন করে আর কোনো কমিটি গঠন করা হবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রের তথ্য মতে, এরই মধ্যে পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সম্পূর্ণ কাজ শেষে সংশ্লিষ্টরা এনসিটিবির কাছে তা হস্তান্তর করবেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশোধিত বইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রম থাকবে না বলে জানায়। সে হিসেবে নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর রচিত বইগুলোতে সংস্কার আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে কিছু আধেয় (কনটেন্ট) বাদ দেওয়ার পাশাপাশি মূল্যায়নের পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এর অংশ হিসেবে শিক্ষা উপদেষ্টার দপ্তর থেকে পাঠ্যবই পরিমার্জন ও সংশোধনে শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ করে দেওয়া হয়।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, এই গ্রুপ সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে পাঠ্যবই সংশোধনের কাজ শুরু করে। কিন্তু তারা এই কাজ শেষ করে কার কাছে হস্তান্তর করবে, কাজের দায় কে নেবে—এসব বিষয় সামনে এলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজে সমন্বয় করা; কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই কমিটি নিয়ে আপত্তি তোলা হয়।
জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম (বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক), সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান (সদস্য সচিব)।
ওই কমিটি গঠনের পর পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটিতে কমপক্ষে দুজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠন। এ ছাড়া কমিটি থেকে দুজন সদস্যকে বাদ দেওয়ার জন্য মানববন্ধন করে ধর্মভিত্তিক একাধিক সংগঠন।
গত শুক্রবার ইসলামী আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহ পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটি থেকে দুই সদস্য কামরুল হাসান মামুন ও সামিনা লুৎফাকে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে তাদের অপসারণের দাবি জানান। এর আগে বৃহস্পতিবার সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন আলেমরা। সেখানে তারা পাঠ্যপুস্তক সংস্কার ও পরিমার্জন কমিটি থেকে ‘চিহ্নিত ইসলাম ও দেশবিরোধী’ ব্যক্তিদের দ্রুত অপসারণ এবং আলেমদের অন্তর্ভুক্তির দাবি তোলেন। একই দিন ওই কমিটিতে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ দুজন সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান জানতে চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে আলেম ও ইসলামী স্কলার অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানায় খেলাফত মজলিস। যুক্ত বিবৃতিতে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের এ আহ্বান জানান। ২২ সেপ্টেম্বর পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটিতে একজন আলিয়া, একজন কওমি শিক্ষায় শিক্ষিত আলেমসহ কমপক্ষে দুজনকে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের পাঠানো এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়। আর ২১ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতি দেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। অবিলম্বে আলেমদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও জানান তারা।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, সময় কম, তাই পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ভাষাগত ও সংবেদনশীল বিষয়ে থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা কাজ করেছেন। যার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও রয়েছেন। এই কাজের সমন্বয়ের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হয়েছিল। সেটাই ভুলবশত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে যায়। বাস্তবে এ ধরনের কমিটির কার্যকারিতা নেই।
তিনি আরও বলেন, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সেখানে এটি মনে করা হচ্ছে যে, এ কমিটিই বোধ হয় শিক্ষাক্রম সংস্কার কমিটি, তাদের হাতেই বোধ হয় দায়িত্ব। আসলে এটি শিক্ষাক্রম সংস্কার কমিটি নয়। তিনি বলেন, দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হয়নি; বরং বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, এ জন্য বাতিল করা হয়েছে।
কমিটি বাতিলের পর প্রতিক্রিয়া জানতে কমিটিতে থাকা তিনজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে কালবেলা। দুজনের সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্যজন বিষয়টি তার জন্য ‘বিব্রতকর’ উল্লেখ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বলেন, এটা তো চলমান প্রক্রিয়া। এখন আর সমন্বয় কমিটি লাগবে না। আমাদের চলমান (অন-গোয়িং) কার্যক্রম যেভাবে চলমান আছে, সেভাবেই চলবে।
এ বিষয়ে জানতে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানকে একাধিকবার কল করা হলে তিনিও সাড়া দেননি। তবে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবি থেকে পরিমার্জনের কাজ চলমান ছিল। তবে মন্ত্রণালয় মনে করলে এর কাজের দায়ভার নেবে কে? সে কারণে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে দিল। এখন কমিটি বাতিল করে দেওয়া হলেও সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ পর্যায়ে। তাই নতুন করে আর কমিটি গঠনের প্রয়োজন পড়বে না।
জানতে চাইলে শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা বলেন, আমাদের পরিমার্জনের কাজ চলমান রয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেটি শেষ হবে। তবে কম্পিউটারের কাজ শেষ হতে আরও কয়েকদিন লেগে যাবে।
খুলনা গেজেট/এইচ