প্রিয় পাঠক, আপনাদের আস্থাভাজন গণমাধ্যমকর্মী সাহাবুদ্দিন আহমেদ ইন্তেকাল করেছেন। প্রথিতযশা এ সাংবাদিক এর মৃত্যুতে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা শোকাহত হয়ে পড়েন । তার মৃত্যুর সংবাদ ইথারে ইথারে ঢাকা থেকে খুলনায় এসে পৌঁছায়। স্বজনরা এ দুঃসংবাদ টি পাঠায়। তার স্মৃতি বিজড়িত প্রেসক্লাব ও খুলনায় ক্লাবে শোকের ছায়া নেমে আসে।
খ্যাতিমান এ সাংবাদিক জীবনের এক-তৃতীয়াংশের সময় কেটেছে বন্দরনগরী খুলনায়। তিনি মানিকগঞ্জের সন্তান। জন্মেছেন সেখানে। ছাত্র ও কর্মজীবনের বড় একটা সময় কেটেছে খুলনায়।
স্থানীয় জিলা স্কুল ও বি এল কলেজে লেখাপড়া করেছেন। রাজনীতিক কাজী জাফর আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, মঞ্জুরুল ইমাম তার সহপাঠী। ছাত্রজীবনে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের ব্যানারে শরিফ কমিশন রিপোর্ট এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। পরবর্তীতে নীরবে-নিভৃতে দর্শনের পরিবর্তন করেন। তারা ছাত্রজীবন শেষে শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু। রূপসা উপজেলার বেলফুলিয়া ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও পোর্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষকতা করতেন । শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনে সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। সাংবাদিকতা করেছেন খুলনার উইকলি ওয়েভ, ঢাকার উইকলি হলিডে, বাংলাদেশ টাইমস, ডেইলি টেলিগ্রাফ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও ডেইলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায়।
সাংবাদিকতা জীবনে প্রত্যক্ষ করেছেন জেঃ আইয়ুব খান, জেঃ ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসন। সাংবাদিকতায় বড় দুঃসময় কাটাতে হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় । এ সময় সামরিক বিধি ১১০ ও ৭৭ জারি করায় স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ ছিলনা। শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ কাটে নয় মাসের সাংবাদিকতা জীবন। সামরিক বিধিতে ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খবর ও ছবি ছাপা যাবেনা। পাকিস্তানের অখন্ডতা ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রচারণা করা যাবেনা। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা যাবে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অসহায় মানুষদের বাঁচাতে ইউনিয়ন পর্যায়ে নোঙ্গরখানায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লেখনীর ছিল স্বোচ্চার।
দলীয় সাংবাদিকতার বেষ্টনীতে আবদ্ধ থাকার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ১৯৭৫ সালে বাকশালে যোগদান করেননি। তিনি দলভুক্ত না হয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করতেন। সাংবাদিক ইউনিয়নের আয়োজনে জেনারেল এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্যক্তি স্বার্থে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করেননি, দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
১৯৪৭-১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত খুলনাঞ্চলে সাহসী সাংবাদিকতা যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল ২৬মার্চ রাতে ডাকবাংলা বিপরীতে সাপ্তাহিক দেশের ডাক পত্রিকা অফিসে পাকবাহিনী পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মনোবল হারিয়ে যায়। ১৯৭১ সালে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্র ছিল সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সংবাদপত্র অফিসে আক্রমণ এবং খুলনার মাসিক সেতু পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক খালেদ রশীদ আগস্টের ডুমুরিয়া যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাহস মনোবল হারাতে থাকে।
দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে ৬৯ ‘র হাজী মহসিন রোডে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আফজাল কাহুতের বাসভবনের সামনে পুলিশের গুলি, ১৯৭১ সালের ২৬ জুন জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে এখানকার সাংবাদিকরা অনুসন্ধানে নামে। তখন পাকবাহিনীর সদর দপ্তর ছিল সার্কিট হাউজে। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এসব ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ১৯৭১ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ, ১৯৮০ সালে খুলনা জেল বিদ্রোহ, নব্বই-পরবর্তী ডুমুরিয়ায় ফুলতলায় চরমপন্থীদের তৎপরতার, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।
এসব সংবাদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে চেক ক্রস চেক , কনফার্ম-ওভার কনফার্ম হয়েছেন। তারপরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য এবং সহকর্মীদের কাছ থেকেও তথ্য নিয়ে যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন লিপিবদ্ধ করেছেন। ফলে তার প্রতিবেদনের ওপর পাঠকের আস্থা ছিল। পাঠক কখনো আস্থা হারায়নি।
সাংবাদিক সাহাবুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকতা জীবনের উল্লেখযোগ্য প্রতিবেদন জেঃ আইয়ুব খান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী খান-এ-সবুর সন্ধ্যে সাতটায় ইউনাইটেড ক্লাব এ মুসলিম লীগের এক কর্মী সভায় উপস্থিত হন। এক ঘন্টা মন্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরের সপ্তাহে খুলনার সাপ্তাহিক ওয়েভ পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘মিনিস্টার মিচিং’। এর মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের কাছে জনপ্রিয় ওঠেন। বাসে পশু পরিবহন নিষিদ্ধ থাকলেও খুলনা জেলা প্রশাসকের কোরবানির ছাগল যাত্রীবাহী বাসে খুলনায় আনা হয়। পরের সপ্তাহে ঢাকার উইকলি হলিডেতে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে হৈচৈ পড়ে যায়।
এক সময়ের খুলনা জেলা জজের স্ত্রী ভারত ভ্রমণের সময় বেনাপোল চেকপোস্ট তার ভ্যানিটি ব্যাগ তল্লাশী হয়। ব্যাগ থেকে কিছু গহনা উদ্ধার হয়। এ সংবাদটি উইকলি হলিডে পত্রিকায় ছাপা হয় । সংবাদটি ছাপা হওয়ার পর তৎকালীন জেলা জজ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ সংবাদটি তার সাংবাদিকতা জীবনে উল্লেখযোগ্য। তথ্য সংগ্রহ ও উপস্থাপনায় তিনি অদ্বিতীয়। চিরবিদায়ের এ মুহূর্তে তার কর্মময় জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা । আমরা গর্বিত এই সাহসী সাংবাদিকের সৃষ্টির জন্য ।
(লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, খুলনা গেজেট)
খুলনা গেজেট/ টি আই