পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যবসায় যুক্ত না হয়ে দেশের প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও গভীরভাবে মনোনিবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অঙ্গীকার চেয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। গত বুধবার পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈশার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ সরকারের কাছে এই অঙ্গীকার চান। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিচার বিভাগের এ নির্দেশনা ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। জনগণের অভিপ্রয়াসের বিরুদ্ধে, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের বাইরে, রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপের ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চলমান বিশৃঙ্খলা এবং সংকটকালীন সময়ে প্রধান বিচারপতির এই নির্দেশনা, সুচিন্তিত লক্ষ্য নির্ধারণে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল প্রণয়নে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর কৌশলের সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক দায়িত্বকে উপেক্ষা করে কোনো দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কৌশল গ্রহণ করলে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত ঘোষণা করার মতো খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। পাকিস্তানের সেই ভয়ঙ্কর অবস্থান উপলব্ধি করে প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন- যাতে নির্বাহী বিভাগ প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করেন। নির্বাহী বিভাগের প্রতি প্রধান বিচারপতির এই নির্দেশনা নৈতিক বিচারে অসাধারণ ও অনন্য। যা রাষ্ট্র, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি গভীর আনুগত্যের প্রকাশ।
জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন আদায়ের উপযোগী, হিতসাধনে সংকল্পবদ্ধ, দৃঢ় মনোবলে উৎকর্ষিত এবং অকুতোভয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
প্রতিরক্ষা বাহিনী যদি আইনি কাঠামোর বাইরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় তাহলে ধ্বংসের ভয়াবহতার বিষয়গুলো দ্রুত সামনে চলে আসে এবং অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম হয়। এই নির্দেশনার মাধ্যমে বহু সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তান- গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ বৃহত্তর ভাবে ন্যায়বিচার অর্জনে জনগণ অনুপ্রাণিত হবে এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের দ্বার উন্মোচিত হবে। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সমৃদ্ধ অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এটা একটি যুগান্তকারী নির্দেশনা। এই নির্দেশনা থেকে রাষ্ট্রসমূহের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেনো রাষ্ট্র, জনগণ এবং সংবিধানের স্বার্থ উপেক্ষা করে সরকারের বেআইনি কাজের সহায়ক না হয়। সেজন্য নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে এমন একটি অঙ্গীকার গ্রহণ আদায়করতঃ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। পাকিস্তান বিচার বিভাগের এই নৈতিক সাহস এবং অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত সাংবিধানিক শাসনকে প্রচণ্ড শক্তিশালী করবে। নতজানু এবং মেরুদণ্ডহীন বিচারকদের ওপর অভিশাপ বর্ষিত করবে। এতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক সকল ক্ষেত্রে জনগণের প্রাধান্যকে নিশ্চিত করা হবে। এই নির্দেশনা রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে যথাযথ প্রয়োগ হলে- ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বিনাশ করে পাকিস্তানকে আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হবে, সন্ত্রাসবাদের অপবাদ থেকে মুক্ত করবে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর ফেরাতে পারবে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিশ্চিত হবে। আর যদি নির্বাহী বিভাগ প্রধান বিচারপতির নির্দেশনার অন্তর্নিহিত দর্শনকে উপেক্ষা করে, তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা যেমন চরম হুমকিতে পড়বে তেমনি যেকোনো সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও ব্যর্থ হবে। পরিশেষে পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ পাকিস্তান বৈশ্বিক রাজনীতির দৌড়ের একটা মহড়ার ক্ষেত্রে পরিণত হবে বা বিপজ্জনক ঝুঁকির প্রান্তসীমার দিকে চলে যাবে।
আজকের বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থায়, সীমান্তকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, ভৌগোলিক নির্ভর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যেক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষা বাহিনী অনিবার্য হয়ে পড়েছে। প্রতিরক্ষা শক্তিবিহীন রাষ্ট্র টিকে থাকা খুব জটিল হয়ে পড়েছে। ২৫০০ বছরের যুগান্তকারী বই ‘দ্যা আর্ট অব ওয়ার’-এ সান জু বলেছিলেন- ‘রাজত্ব একবার ধ্বংস হলে তা আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না। তেমনি মৃতকে কোনোদিন জীবন ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়’।
সান জু’র এই বক্তব্যের প্রতি আধুনিক রাষ্ট্রের কর্ণধাররা দ্ব্যর্থহীন আস্থা স্থাপন করেছে। অনেক নেতৃত্ব সান জু’র মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে বহুধা বিভক্ত অঞ্চলকে এক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আবার স্বাধিকার অর্জনের লড়াইয়ের মাধ্যমে বা সংগ্রামের মাধ্যমে অনেক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। জনগণের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বকে নিরঙ্কুশ করার জন্য গণতন্ত্রের মহান আদর্শকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শাসকদের ক্ষমতার তৃষ্ণা মেটাতে বহু রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিচালনা করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এসকল রাষ্ট্র ব্যর্থরাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। প্রজাতন্ত্র-ই হোক বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ই হোক কিংবা পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রই হোক- তার নিরাপত্তা দিতে হয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে। এটাই এ বাহিনীর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, অন্য কিছু নয়।
সুতরাং প্রত্যেক রাষ্ট্রের বৈরী রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে বা কোনো রাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রমের আকাক্সক্ষা থেকে নিজেকে সুরক্ষার প্রয়োজনে প্রতিরক্ষা বাহিনীর গঠন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ বিশ্বে বহু শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে যারা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়াই শক্তির ব্যবহার করে বা সম্প্রসারণের দ্বারা অন্য রাষ্ট্রকে করায়ত্বে আনে। নিরাপত্তা দেয়াল বা পৃথক্করণ দেয়াল বা শান্তি প্রক্রিয়া কিংবা রোডম্যাপ- মূলত বিকল্পহীন চলমান যুদ্ধেরই প্রক্রিয়া। গত কয়েকশ’ বছরে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রমাণ করেছে- সাধারণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে দুর্বল রাষ্ট্রের সীমান্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেদের সীমানাকে বর্ধিত করেছে। প্রতিপক্ষকে ভীতির মাধ্যমে গ্রাস করার প্রবণতা বিশ্বব্যাপী প্রবল। নৃশংস, অমানবিক, অবমাননাকর শাস্তি এই আধুনিক যুগেও বহাল রয়েছে। যেকোনো একক বা পরাশক্তি, বা আঞ্চলিক শক্তি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিশ্বকে নিজের শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আকৃতি দিতে চায়। আমরা প্রতিদিন কোনো না কোনো অঞ্চলে নিকৃষ্টতম নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করছি।
শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইনকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে, নিজেদের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতাকে হুমকি থেকে সুরক্ষা দেয়ার প্রয়োজনের বয়ান দিয়ে অন্য রাষ্ট্রের উপর হামলা করে। আর দখলদারি রাষ্ট্র যদি হয় বৃহৎ কোনো শক্তি তাহলে ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা কী দাঁড়ায়! রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রাচীর ‘জনগণ’। এই বোধকে আধুনিক সমরাস্ত্রসমৃদ্ধ বিশ্ব বহু আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। আত্মরক্ষার অজুহাতে যুদ্ধ বা আক্রমণ করে পরিহাসমূলক ফাঁদ তৈরি করা হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তান যুদ্ধ, আত্মরক্ষার অজুহাতে ভয়ঙ্কর আর নৃশংসতার অনুমোদন লাভ করছে কেবল। যুদ্ধাক্রান্ত দেশসমূহে মানুষ মৃত্যুর ভয়াবহতা, সংঘটিত অপরাধের ভয়াবহতা- ভাষায় বর্ণনা করার অযোগ্য। আক্রমণ ও দখলদারির সঙ্গে যুদ্ধে মানুষ নিহত হয়, বাহিনীর হাতে মানুষ নিহত হয়, দুষ্কৃতকারীর হাতে নিহত হয়, সন্ত্রাসের কাছে কেবল মানুষই নিহত হয়। মানুষ হত্যা কেবল একটা সংখ্যা মাত্র! কে কোথায় কতোজনকে হত্যা করছে তার সংখ্যাও কেউ উল্লেখ করে না। মানব হত্যার নৃশংস কীর্তি নিয়ে, সহিংসতা নিয়ে, ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে- ভবিষ্যতে স্মৃতিচারণ হবে কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হবে না।
যুদ্ধ বিষয়ক প্রশ্নে কিছু সমালোচনা থাকবে, কিছু আলোচনা থাকবে, কিছু ব্যাখ্যাকারী থাকবে, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ থেকে প্রতিবাদ থাকবে কিন্তু যুদ্ধ থামবে না। অনেক জনপদ তছনছ হয়ে যাবে। যার শক্তি আছে সে-ই যেনো ‘গণহত্যা’ সংঘটিত করার অধিকার রাখে। বৃহৎ শক্তিরা বলে থাকে- ক্ষমতাধর ভীতি প্রদানকারীর বিরুদ্ধে সীমাহীন আক্রমণের অধিকার তাদের আছে। তবে এটাও সত্য এবং অজানা যে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে কতোগুলো যুদ্ধের প্রয়োজন হবে। এটা আমাদের জানা নেই। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নামে বা নিরাপত্তার নামে- বিশ্ববাসী কতো বর্বরতার দ্বারা ভোগান্তির শিকার হবেন। অন্য রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ বা দখল সংক্রান্ত ক্ষমতার লড়াই এবং ঘৃণার শেকড় যত দিন থাকবে ততদিন মানুষ নিরাপত্তাপূর্ণ জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না। এই বৈশ্বিক ব্যবস্থা অবশ্যই পাল্টাতে হবে।
সুতরাং প্রত্যেক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নিজস্ব রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে, অন্য কোনো কাজে নয়। প্রতিরক্ষা বাহিনী রাজনীতিতে বা ব্যবসায় জড়িত হলে এটা হবে অগ্রহণযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতি মুহূর্তে সংঘাতমুখী বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিযোগিতায় নামছে, প্রতিযোগিতার গতিবেগ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সুতরাং প্রতিরক্ষা কাঠামো দুর্বল বা অক্ষম হয়ে পড়লে যেকোনো সময় আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক অস্থিরতায় রাষ্ট্রের অখণ্ডতা বিপন্ন হতে পারে। রাষ্ট্রকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে সুরক্ষার জন্য অবশ্যই জনগণের অভিপ্রায় ভিত্তিক প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যেখানে ‘নিরাপত্তা’ অথবা ‘ধ্বংস’- সে প্রশ্নকে উপেক্ষা করা কোনোক্রমেই ন্যায়সংগত হবে না।