আমদানির ঘোষণায় দেশের অন্য পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমলেও এর প্রভাব নেই দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। আবার খুচরায়ও তেমন প্রভাব পড়েনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছে পেঁয়াজের দাম। এক মাসে কেজিপ্রতি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৩৫-৪০ টাকা। খুচরায় যা ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ বাজারে অন্য গুরুত্বপূর্ণ মসলা রসুনের মজুত পর্যাপ্ত থাকলেও আদার পরিমাণ কম। যে কারণে আদার দামও বেশি।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করতে আমদানি বন্ধ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে মার্চ মাসে যে পেঁয়াজ ৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, দুই মাসের ব্যবধানে এখন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা কেজি। তবে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে মান ও সাইজভেদে ৬৮-৭২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।
অন্যদিকে চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ১১০-১১৫ টাকায় এবং ভারতীয় রসুন বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। তাছাড়া আদা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৮০-২২০ টাকা কেজিতে।
খাতুনগঞ্জ ও চট্টগ্রামের খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, সাইজ ও মান অনুযায়ী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। খুচরায় আদার দামও বেশি। বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকায়।
মধ্যম চাক্তাইয়ের পেঁয়াজ-রসুনের আড়তদার ব্যবসায়ী বশর অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী হাজি আবুল বশর বলেন, ‘দেশে বর্তমানে পেঁয়াজ উৎপাদনের মৌসুম থাকায় কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকার পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেয়। ৩০ টাকার পেঁয়াজ দুই মাসের ব্যবধানে ৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত এক মাসে প্রতি কেজি পেঁয়াজে দাম বেড়েছে ৪০ টাকার মতো।’
তিনি বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইয়ে পেঁয়াজ-রসুনের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। দাম বাড়ানো হয় মোকাম ও স্থলবন্দরের সরবরাহকারী পর্যায়ে। এখানকার ব্যবসায়ীরা কমিশনে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। বেশি লাভ করার সুযোগ এখানে নেই।’
এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখন চায়না থেকে রসুন আমদানি করতে গেলে কেজিতে ১৭০-১৮০ টাকা পরতা পড়ছে। অথচ বাজারদর ১১৫ টাকার নিচে। তারপরও বড় আমদানিকারকরা ঝুঁকি নিয়ে রসুনের এলসি খুলছে। তা না হলে কোরবানিতে রসুনের বড় সংকট দেখা দিতে পারে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘হিলি, সোনামসজিদ, সাতক্ষীরার ভোমরার বড় বড় গোডাউনে তল্লাশি চালালে এখনো ভারতীয় পেঁয়াজ পাওয়া যাবে। মূলত স্থলবন্দরকেন্দ্রিক পেঁয়াজের অনেক বড় আমদানিকারক রয়েছে। বর্ডারকেন্দ্রিক বড় বড় সিন্ডিকেটও রয়েছে। এসব আমদানিকারক নামকাওয়াস্তে এলসি (ঋণপত্র) খোলেন। তারা এলসি খুলে কাগজপত্র ইন্ডিয়ান সাপ্লাইয়ারদের দেয়। লাভ-লোকসান সাপ্লাইয়ারদের।’
‘১৫ মার্চ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়েছে, শেষ দিনেই দুই হাজার ট্রাক পেঁয়াজ ঢুকিয়েছে ভারতীয় সরবরাহকারীরা। ওই সময়ে পেঁয়াজ ছিল ২৫ টাকার নিচে। এসব পেঁয়াজ গোডাউনে রেখে ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে।’
এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখন সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। কারণ এখন দাম বেশি থাকার সময়ে সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিলে ওই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরাই শুরুতেই বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ ঢুকিয়ে (আমদানি করে) প্রথম চালানেই মোটা অংকের টাকা তুলে নেবে।’
তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ‘এখন পাইকারি বাজারে পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৭৫ টাকায় বিক্রি হলে বর্ডার খোলার (আমদানির অনুমতি) সঙ্গে সঙ্গে দাম একেবারে কমে যাবে না। এ সুযোগে সাপ্লাইয়াররা প্রথম চালানেই ক্রেতাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেবে।’
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজারে মেসার্স কামাল উদ্দিন ব্রাদার্সে কথা হয় পাবনা থেকে আসা পেঁয়াজ ব্যাপারী মো. সেন্টু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যত পেঁয়াজ উৎপাদন হয়, তা দিয়ে দেশে ছয় মাসও যাবে না। সরকার আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার আগে থেকেই বড় বড় ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কিনে নিয়েছেন। অনেকে জমিতে থাকার সময় দাদন খাটিয়ে আগাম পেঁয়াজ কিনে নিয়েছেন। এতে দাম বাড়ার কারণে কৃষকরা তেমন লাভবান হননি। তবে যারা ব্যবসায়ীদের কাছে পেঁয়াজ বিক্রি করেননি, তারা কিছুটা দাম পেয়েছেন। এখন কৃষকদের হাতে পেঁয়াজ নেই। তাই দামও বেড়ে গেছে।’
তিনি ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন বলে জানান।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স হাজি অছি উদ্দিন ট্রেডার্সের ম্যানেজার মো. বেলাল বলেন, ‘আমাদের আড়তে এখন রসুন ও আদা নেই। শুধু পেঁয়াজ রয়েছে। আমরা ৬৮ থেকে ৭২ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করছি।’
কাছের মেসার্স এ এইচ ট্রেডার্সের ম্যানেজার ইয়াসির আরাফাত বলেন, বাজারে আদার জোগান তেমন নেই। অল্প কিছু আড়তে আদা পাওয়া যাচ্ছে। আদার দামও বেশি। এভাবে চলতে থাকলে কোরবানিতে আদার দাম আরও বাড়তে পারে। বর্তমানে ভিয়েতনামের আদার কেজি ২০০ টাকা, ভারতীয় কেরালা আদা ২২০ টাকা, মিয়ানমারের বার্মিজ আদা ১৮০-১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া চায়না রসুন ১১২-১১৩ টাকা এবং ভারতীয় রসুন ৭৮-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ সালের জন্য পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ লাখ চার হাজার টন। তবে ওই অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ লাখ ৪১ হাজার টন। ওই অর্থবছরের রসুনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ লাখ ১৯ হাজার টন। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রসুন উৎপাদিত হয়নি। ওই অর্থবছরের রসুন উৎপাদিত হয়েছে ৭ লাখ ৭০ হাজার টন। চলতি মৌসুমেও ৩৪ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হওয়ার তথ্য দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তবে দেশে চাহিদা রয়েছে ২৬ লাখ মেট্রিক টন। প্রশ্ন উঠেছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়লেও কেন পেঁয়াজের দাম বাড়ছে? কেন পেঁয়াজ আমদানি হয়?
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, কৃষকদের সুবিধা দিতে পেঁয়াজ আমদানির কথা বলা হলেও সত্যিকার অর্থে কৃষকরা তেমন লাভবান হননি। কারণ দেশের বাজার এখন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের দখলে। সরকার সবকিছু ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। যে কারণে তারা সিন্ডিকেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়েছে। তা না হলে হঠাৎ করে বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
খুলনা গেজেট/কেডি