একদিকে তৃণমূলের বিদ্রোহী মন্ত্রী তরুণতুর্কী শুভেন্দুসহ তার অনুগামীদের বিদ্রোহ, অন্যদিকে বিভিন্ন জেলায় রাজ্যের শাসক দলে ভাঙন যখন অব্যাহত, ঠিক সে সময় আরো একটি প্রশ্ন উঁকি মারছে। আর সেটি হল তৃণমূলের যে ভিত ছিল মুসলিম ভোট, সেটা কি আর থাকবে? নাকি সেটাতেও ধস নামবে? বিষয়টি এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।
রাজ্যের রাজনৈতিক মহল দাবি করছে, ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে বাম জমানায় প্রকাশিত হয়েছিল সাচার কমিটির রিপোর্ট। সেই রিপোর্ট, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আর রিজুয়ান কাণ্ডকে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল ২০১১ সালেই। শপথ নেওয়ার পর মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সে সময় তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেন। পাহাড় , জঙ্গল আর সংখ্যালঘু উন্নয়ন। কিন্তু আজ বুকে হাত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল কি বলতে পারবে জঙ্গল মহল হাসছে? পাহাড় কি শান্ত হয়েছে? সাচার কমিটির সুপরিশ মেনে কি সংখ্যালঘু মুসলিমদের চাকুরি-বাকরিতে সেরকম কোন বিকাশ ঘটেছে?
এম্পায়ার ইণ্ডিয়া ফাউণ্ডেশন, অ্যাসোসিয়েশন স্নাপস কিংবা ফেডারেশন অব মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন নামে তিনটি সংগঠন যে রিভিউ করেছে তাতে সংখ্যালঘুদের চাকুরির অবস্থা খুব খারাপ। বাম জামানায় যেখানে চাকুরির হার ছিল সাড়ে চার শতাংশ, সেখানে তৃণমূলের প্রায় দশ বছরের জমানায় তা নেমে হয়েছে দেড় শতাংশে। সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা ফিরে চলে যায় কেন্দ্রের কাছে, খরচ না হওয়ার জন্য। ২০১৭ সালে এম্পাওয়ার ইণ্ডিয়া ফাউণ্ডেশন দিল্লিতে লোধী রোডের বিজ্ঞান ভবনে একটি সেমিনার করে। সেখানে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের করুণ অবস্থা উঠে আসে। সেই সভাতে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি রাজেন্দ্র সিং সাচার। এম্পাওয়ার ইণ্ডিয়া ফাউণ্ডেশনের রিভিউ রিপোর্টের খুব ভূয়সী প্রশংসা করেন সাচারজী।
২০১১ সালের পর ইমামভাতা নামে একটি সেন্টিমেন্টাল কর্মসূচি চালু করায় বিভাজনকে টেনে আনা হয়েছে এই রাজ্যে। এই ইমাম ভাতার পরিমাণ মাত্র ২৫০০ টাকা। এটা দেয় পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ড। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মুসলিম সমাজ এটাকে কোনোভাবেই ভাল চোখে নিচ্ছেন না। তাদের বক্তব্য ইমামভাতা একটা সমাজের উন্নয়নের চাবিকাঠি হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে যে সব ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল ও জবর দখল হয়ে আছে সেগুলিকে এই সমাজের কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু তা করা হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিভিন্ন সময় শাসক দল ওয়াকফ সম্পত্তিতে প্রমোটারিরাজ কায়েম করেছে। সংখ্যালঘুদের সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা করা হয়েছে। কিন্তু তাদের নিয়ে বিকাশ নিয়ে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর এইসব বক্তব্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চলেছে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির রাজনৈতিক দল মিম নামে একটি সংগঠন। এই দল সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনে পাঁচটি আসন পেয়েছে বিহার- পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন এলাকায়। তৃণমূলের প্রতি ক্রমশ মুসলিমরা হতাশ হয়ে পড়ছে।
২০১১ ও ২০১৬ সালে তৃণমূল যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোট একচেটিয়া পেয়েছিল , রাজনৈতিক পর্যবক্ষেকরা মনে করছে সেটা আর তৃণমূলের দিকে নাও যেতে পারে । সে জায়গায় ভাগ বসাবে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির মিম। বিহার সংলগ্ন মালদা- মুর্শিদাবাদ-উত্তর দিনাজপুর, দুই চব্বিশ পরগণা, ঝাড়খণ্ড সীমান্তবর্তী বীরভূম-মুর্শিদাবাদ, কলকাতার মেটিয়াবুরুজে- সাতগাছিয়া-মহেশতলা এলাকায় মিম কিন্তু মুসলিম ভোটে থাবা বসাবে। আর এর ফলে হালে বদ হাল হবে তৃণমূলেরই।
এ অবস্থায়, একদিকে দলের বিদ্রোহ, অন্যদিকে মুসলিম ভোট হারানো তৃণমূলকে পশ্চিমবঙ্গে অনেকটাই ব্যাকফুটে ফেল দেবে বলে রাজনৈতিক পর্যবক্ষেকরা মনে করছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম