ইসলামের ইতিহাসে ১২ রবিউল আওয়াল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) ধরায় আগমন করেন এবং পৃথিবী হতে বিদায় নেন। পবিত্র আল-কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে মহানবী (দঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ যা বলেন তার কিছু উল্লেখ করা হলো যে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (দঃ) উদযাপন বিষয়টি কতো অর্থবহ তা অনুধাবন করার জন্য: ইয়া রাসুলুল্লাহ(আল্লাহর রাসুল); দাঈয়ান ইলাল্লাহ (আল্লাহর পথে আহবানকারী); সীরাজাম মুনীরা (প্রদীপ্ত প্রদীপ); লিল আলামীনা নাযীরা(সারাবিশ্বের সতর্ককারী) ; খুলুকুন আযীম(মহত্তম চরিত্রের অধিকারী); রাসুলুন করীম (সম্মানিত রাসুল); উসওয়াতুন হাসানা(আদর্শ চরিত্র); বিল মুমিনীনা(মুমিনের প্রতি দয়াবান) ; মুবাশ্বিরাও (মানবের সুসংবাদদাতা) ; রাসুলুম মুবীন (পরিষ্কার ব্যাখ্যাদাতা) ; লাইলুন বিল মুমিনীন (মুমিনের প্রতি কোমল); রহমাতুল্লিল আলামীন (দোজাহানের করুণা ); খাতামুন নাবিয়্যীন(সকল আম্বিয়ার শেষ নবী) আওলা বিল মুমিনীনা(মুমিনের প্রাণাধিক প্রিয়) ; রাসুল আবদুনা(আল্লাহর বান্দা); রাসুল মুযাক্কী(আত্মার পবিত্রতা সাধনকারী) ; নাবীয়ুল উম্মী(প্রিয় নবী নিরক্ষর) । বুরহান মির রাব্বিকুম ওয়া নূরুম মুবীন(আল্লাহর স্পষ্ট প্রমাণ ও জ্যোতি চিরদিন)। শাহীদাও (সাক্ষ্যদাতা); মুআল্লিমুল কিতাব ওয়াল হিকমা (কিতাব ও হিকমতের শিক্ষাদাতা); বাশায়ার রাসুলা(মানবের মাঝে মানব নবী ); রাসুলুনা( আমার নবী); রাসুলুল্লাহি ইলাইকুম জামীয়া (সার্বজনীন আল্লাহর নবী); রাসুলুন ইলা কাফফাতিন নাস (বিশ্ববাসীর রাসুল) ।
এভাবে পাক কোরানে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও অনেক আয়াতে নবী করিম (দঃ) সম্পর্কে যথা তার আগমন, তার অতি উত্তম আখলাক, তার মর্যাদা, তার উপরে দরুদ পেশ, তার প্রতি কোরান নাজিল, আল্লাহ এবং রাসুলের ফয়সালাই চুড়ান্ত ফয়সালা, মিরাজে গমন, আল্লাহ ও রাসুলের ডাকে চলে আসা, তার কণ্ঠস্বরের ওপর অন্যের কণ্ঠস্বর উঁচু না করা, তাকে ভালোবাসা, সর্ব্বোপরি উম্মতের তার আনুগত্য করা ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। এ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় পাক কোরানই রাসুল (দঃ) এর আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত জীবন বৃন্তান্তের জীবন্ত দলিল। তাই মুসলমানদের এই একমাত্র মহান নেতাকে নিয়ে মজলিস করা, তার ধরায় আগমন ও কর্ম জীবন নিয়ে আলোচনা করা, মহবতের সাথে তাকে স্মরণ করা, গবেষণা করা ইত্যাদি ঈমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিঃসন্দেহে জরুরী কাজ। পাক কোরানে সুরা বাকারার ১৪৬ ও ১৪৭ নং আয়াতে আল¬াহ বলেন, ’যাহাদিগকে আমি কিতাব দিয়াছি, তাহারা রাসুলকে তেমনি চিনে, যেমন তাহাদের পুত্রদের চিনে; কিন্তু তাহাদের একদল জানিয়া শুনিয়া সত্য গোপন করিতেছে। ইহা তোমার প্রভুর তরফ হইতে সত্য, সুতরাং তুমি কিছুতেই সন্দেহকারীদের দলে থাকিও না।’ এই আয়াতেই এটা স্পষ্ট যে পুত্রদের ন্যায় রাসুল (দঃ) কে চিনতে গেলে তার জন্ম, আগমন, চাল-চলন, আখলাকসহ পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে। সুরা আন আ’মের ২০ নং আয়াতে একই বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। তাই নবী করিম (দঃ) এর জন্ম ও জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা না করার অর্থ নবী করিম (দঃ) নাম শুধু মুখে উচ্চারণ করা অর্থাৎ সমুদ্রের ওপরে ঢেউ গোনার সামিল। কিন্তু সমুদ্রের অতল তলদেশে যে রহস্য ও মনি-মাণিক্য আছে তার অনুসন্ধান হৃদয়ের মহব্বত দিয়ে না করলে মোমিন হওয়া যাবে না।
আল্লাহপাক পাক কোরানে বলেন: ’’যখন তিনি তাদের অন্তর্গত নিরক্ষরগণের মধ্য হতে একজন রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের সম্মুক্ষে তাঁর নিদর্শনাবলী পাঠ করেন এবং তাদেরকে বিশুদ্ধ করেন এবং গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করেন এবং নিশ্চয়ই এর পূর্বে তারা প্রকাশ্যে বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলো।’’ (সুরা জুম’আ এর ০২ নং আয়াত) এই আয়াতেই মহান আল্লাহ নবী করিম (দঃ) এর আগমনের কথা উল্লেখ করেছেন। সুরা আল ইনশিরায় রাসুল করিম (দঃ) এর মর্যাদাকে সমুন্নত করার কথা আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। সুরা আল ফাতহ এর ৮ ও ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সাক্ষ্যদাতা ও সুসংবাদদাতা এবং ভয় প্রদর্শনকারীরূপে পাঠাইয়েছি এই হেতু যে তোমরা আল্লাহ ওপর ও তার রাসুলের ওপর ঈমান আনিবে তাকে সাহায্য দিয়ে শক্তিশালী করিবে এবং তাহার উপযুক্ত সম্মান করিবে; আর সকাল ও সন্ধ্যায় তার মহিমা প্রকাশ কর। এই আয়াত হতে এটাই স্পষ্ট যে নবী করিম (দঃ) কেয়ামত পর্যন্ত জন্মগ্রহনকারী উম্মতগণের কাজকর্ম, আমলের সাক্ষী হইবেন। দ্বিতীয়ত এই আয়াতে নবী (দঃ) এর উপর ঈমান আনার জন্য এবং তাকে তাযিম ও সম্মান করার জন্য নির্দেশ রয়েছে এবং এ নির্দেশ কেয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতদেরকে অবশ্য পালন করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় আমরা সবাই যাকে দেখছি না এবং যিনি বর্তমানে আমাদের সাথে নেই তাহলে তাকে তাযিম ও সম্মান কিভাবে করবো? সুতরাং একজন মোমিন উম্মতকে সর্বাবস্থায় নবী করিম (দঃ) কে বর্তমান হিসেবেই গণ্য করতে হবে। উপরোক্ত আয়াতে তাকে সাহায্য দিয়ে শক্তিশালী করার অর্থ পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন ও নবীর সুন্নাহ তিনি যেভাবে চেয়েছেন সেভাবে প্রতিষ্ঠা ও চালু রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তার প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের জন্য দরুদ শরীফ পাঠ করা, ভক্তিশ্রদ্ধা সহকারে তার সম্পর্কে আলোচনা করা, কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তার শান মানকে উন্নীত করা এবং স্মরণ করা, তাহলেই তো উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ হতে পারে। পাক কোরানে সুরা মায়েদা এর ৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,’ এবং যে কেহ আল্লাহ ও তাহার রাসুলকে এবং মোমেনগণকে বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে, এবং আল্লাহ দলই জয়ী হইবে।’ কোরানের এ সব আয়াত সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ ও চিন্তা করলে দেখা যায় তিনি ছাড়া উম্মতের অন্য কোনো গত্যন্তর নেই।
মহান আল্লাহ নবী করিম (দঃ) কে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। (সুরা আম্বিয়া আয়াত নং ১০৭)। পাক কোরানে সুরা ইউনুসের ৫৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,’তুমি বল, তোমরা আল্লাহতায়ালার করুণা ও দয়া প্রাপ্ত হয়ে আনন্দ প্রকাশ কর’। প্রথম আয়াতে নবী করিম (দঃ) সারা সৃষ্টির জন্য রহমত ও অনুগ্রহস্বরূপ যে অনুগ্রহ ব্যাতিত আমরা এক মুহূর্ত চিন্তা করতে পারি না। কাজেই এ আয়াত হতে এটা স্পষ্ট যে রহমতস্বরূপ নবী করিম (দঃ) পৃথিবীতে সর্ব্ব ক্ষেত্রেই বর্তমান কারণ আল্লাহ অনুগ্রহ ছাড়া পৃথিবী চলতে পারে না এবং প্রত্যেক বান্দাই দয়া, অনুগ্রহ ও রহমতের প্রত্যাশী। দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহর তরফ হতে দয়া ও অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য আল্লাহ আনন্দ প্রকাশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই নবী করিম (দঃ) এর পৃথিবীতে জন্ম তথা আগমন উপলক্ষ্যে ১২ই রবিউল আওয়াল শরীয়তসম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশের যে সব মাধ্যম আছে সে সব মাধ্যমের দ্বারা আনন্দ প্রকাশ করা উচিত তাহলেই আল্লাহর আদেশ মান্য করা হবে। অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন ’’নিশ্চই তোমাদের নিজেদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট রাসুল আগমন করেছেন, আেমরা বিপদাপন্ন হও এটা তার পক্ষে অসহ্য; তিনি তোমাদের হিতাকাঙ্খী ঈমানদারগণের নিমিত্তে স্নেহশীল ও করুণাময়।’’ এই আয়াতে এটাই স্পষ্ট যে, উম্মতের ব্যথায় নবী করিম (দঃ) ব্যথিত হন এবং ঈমানদার তথা মোমিনদের জন্য তার অন্তরে দয়া ও করুণার উদ্রেক হয়। এতেই প্রমাণ হয় তিনি সর্ববস্থায় উম্মতগণের খোঁজখবর রাখেন। উদাহারণস্বরূপ মিশরের ইমাম বুসেরী(রঃ) কাসিদায়ে বুরদা রচনা করে নবী করিম (দঃ) এর সাহায্যে পক্ষাঘাত থেকে মুক্তি পান, ও বুটিদার ইয়ামেনী চাদর প্রাপ্ত হন। ১৯৩২ সালে নও মুসলিম খালেদ লতিফ গাবা (কে এল গাবা) The Prophet of the Desert পুস্তক রচনা করে ইংরেজদের হাতে বন্দী দশা হতে মুক্তি লাভ করেন (উভয় পুস্তকের একটি করে কপি আমার নিকট রক্ষিত আছে। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেছ দেহলবীর পিতা হযরত শাহ আব্দুর রহিম (রঃ) স্বপ্নে নবী করিম (দঃ) এর দাড়ি মোবারক প্রাপ্ত হন। এ রকম অজস্র ঘটনা ও মোযেযা বিভিন্ন পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে যা এ স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
এখন আমরা সহি হাদিসসমূহ তত্ত্বতালাস করে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উদযাপনের যথার্থতা খুঁজে দেখবো। সহীহ বোখারী তথা মেশকাত শরীফের এক হাদিসে উল্লেখ আছে ’’আদম যখন রুহ এবং খামিরের মধ্যে তখনও আমি নবী।’’ এখন প্রশ্ন হলো প্রথম মানব সৃষ্টির পূর্বে নবী করিম (দঃ) কোন অবস্থায় নবী ছিলেন? তখন শুধুমাত্র ফেরেশতা, জ্বিন, পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি ছিলো বলে জানা যায়। পরবর্ত্তিতে মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ’’বশর’’ হিসেবে আগমন করেন যা পাক কোরানে উল্লেখ আছে। ’’বলো, আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ’’এখানে উল্লেখ করা হয়নি যে মাটির মানুষ অথবা নূরের মানুষ। প্রসংগত উল্লেখ্য যে হযরত শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রঃ) লিখেছেন: ’প্রিয় নবী হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সম্মান মর্যাদা তেমনিভাবে করতে হবে, যেভাবে করা হতো তাঁর জীবদ্দশায়, তঁাঁর রেসালত সর্বকালের জন্যে, তিনি পৃথিবীতে অবস্থানকালে যেমন রাসুল ছিলেন, আজও তেমনি রাসুল রয়েছেন এবং থাকবেন। মসজিদে নববীতে এ জন্যে উচ্চস্বরে কথা বলা আদবের খেলাফ।’ হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমার দীদার লাভ করেছেন সে নিশ্চয়ই আমাকে দেখলো কেননা আমি সকল আকৃতিতেই দেখা দেই। অন্য এক হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, ’’যে আমাকে দেখলো সে সত্যিই আমাকে দেখলো, কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম নয়। এ হাদিস থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে হযরত নবীজি (দঃ) তার নিজ আকৃতিতে সুরত ধারণ করে হাজির হতে পারেন। মুসলীম শরীফের এক হাদিসে উল্লেখ আছে যে হযরত আবু কাতাদাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন, যে রাসুল (দঃ)কে প্রশ্ন করা হলো ’সপ্তাহে সোমবারে আপনি কেন রোজা রাখেন?’ এর উত্তরে নবী করিম (দঃ) বলেন, ’ এই সেই মহান দিন, যে দিন আমি জন্মগ্রহন করেছি। আর এই দিনে আমার নিকট ওহী নাজিল করা হয়েছে।’ এভাবেই হুজুর পাক (দঃ) নিজের মিলাদ শুরু করেছিলেন।
উম্মত জননী হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন, ’আমি শুনেছি যে, হযরত হাসসানকে রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, তুমি যতক্ষণ আল্লাহ এবং তার রাসুলের পক্ষ থেকে কবিতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে থাকবে ততক্ষণ রুহুল কুদস জিবারাঈল (আঃ) তোমাকে সাহায্য করতে থাকবেন।।’ (বুখারী শরীফ হাদিস নং ৪৭১১, ২৭৭৩ আবু দাউদ) হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) এর না’ত: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর,/আমার হৃদয়কে তিনি ইসলামের দিকে/ ধাবিত করলেন-একনিষ্ঠ করলেন দীনের পথে।/ তোমার প্রশংসা করি আমার তেমন ভাষা নেই/ আমিতো নগণ্য কবি অন্ততঃ ভাষার দিক থেকে/ প্রশংসা পায় না নবী নিছক আমার এ ভাষায়/ নবীর ছোঁয়াচ পেয়ে এ কবিতা অমরত্ন পাবে।(অনুবাদঃ আবদুস সাত্তার) উপরের হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় হুজুরপাক (দঃ) এর তার খোদ উপস্থিতে মসজিদের ভিতর সাহাবা (আঃ) না’ত শরীফ পাঠ করতেন এবং সকলে তা শ্রবণ করতেন। হযরত ইবনে আব্বাছ (রাঃ) একদা তার ঘরে পরিবারের লোকদের সমবেত করে হুজুরপাক (দঃ) এর জন্মকালের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করে আনন্দ প্রকাশ করছিলেন এবং আল্লাহতা’য়ালার প্রশংসা ও রাসুলের প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করছিলেন। এমনি মুহূর্তে হুজুর পাক (দঃ) সেখানে তশরিফ নিয়ে আসলেন এবং এ-সব শুনে ইরশাদ করলেন, ‘তোমাদের জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।’ (রাসুলুল কালাম মিন কালামি সায়্যেদিল আনাম)
মাওলানা শাহ ওলীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলবী (রহঃ) ’ফয়েজুল হারামায়েন’ কেতাবের পৃষ্ঠা ২৬-২৭ – এ লিখেছেন:’আমি ইতঃপূর্বে হযরতের পয়দায়েশের দিবসে মক্কা শরীফে উপস্থিত ছিলাম এবং লোকেরা নবী করিম (দঃ) এর ওপর মাওলিদুন্নবী নামক জন্মস্থানে একত্রিত হয়ে দরূদ পাঠ করছিলেন। তার পয়দায়েশের সময় যে অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশিত হয়েছিলো ও তার নবুয়াত লাভের অগ্রে যে সমস্ত ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছিলো তারা তদসমুদয়ের আলোচনা করছিলেন। ’ফয়েজুল হারামায়েন’) পৃষ্ঠা ২৬-২৭ (ইমাম জালালউদ্দীন সূয়ুতী (রঃ) বলেন, ’হুজুর পাক (দঃ) জন্ম উপলক্ষ্যে মাহফিল করা, খাওয়া দাওয়া ও আপ্যায়ন করা এবং সমস্ত ভাল কাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ এবং আনন্দ প্রকাশ করা ইত্যদি আমাদের জন্য মুস্তাহাব।’ (আল-হাওয়ীলিল খাতাওয়া, প্রথম খণ্ড)। দেওবন্দের বুজুর্গ ওস্তাদ হাজি এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কি (রহঃ) বলেন, ’প্রতি বছর আমি বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করে থাকি এবং কিয়ামে আরাম অনুভব করি’। অতএব নবী করিম (দঃ) এর আমল হতে আলোচনাসহ ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর মজলিস করা একটি উত্তম ব্যবস্থা, এতে যেমন সওয়াব পাওয়া যায় তেমনি দেলে শান্তি লাভ হয়। এই মজলিসে যা আলোচনা করা হয় তা পূর্ণ শরীয়তসম্মত।
হযরত ইমামে রব্বানি মোজাদ্দেদে আলফেসানী (রহঃ) এর দশম বংশধর হযরত শাহ আবুল খায়ের আবদুল্লাহ মহীউদ্দিন ফারুকী দেহলবী (রহঃ) পবিত্র মিলাদ শরীফ অনুষ্ঠান করতেন। ’১২ই রবিউল আউয়াল দিল্লীর খানকাহ শরীফে মিলাদ শরীফ অনুষ্ঠিত হতো। মজলিসকে খুব সাজানো গোছানো এবং আড়ম্বরপূর্ণ করা হতো। আঙ্গিনায় শামিয়ানা লাগানো হতো এবং বৈদ্যুতিক বাতিতে মহফিল আলোয় ভরে যেতো। এশার নামাজের পর তিনি নিজেই বক্তৃতা করতেন। বিরাট জনসমাগম হতো। সমস্ত খানকাহ শ্রোতাদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে যেতো। সুবহে সাদেকের সময় যে সময়টি বেলাদতে পাকের সময় (নবী (দঃ) পৃথিবীতে আগমনের সময়) কেয়াম করতেন। তার ওফাতের পূর্বে যে মজলিস হয়েছিলো সেখানে কেয়ামের সময় বললেন, ‘দেখ কিভাবে আনওয়ার (নূরের আলো) অবতীর্ণ হচ্ছে। ভালভাবে দেখে নাও, এরপর এই ধরণের আনওয়ার আর দেখার সৌভাগ্য হবে না’। (হযরত শাহ আবুল হাসান যায়েদ ফারুকী (রহঃ) কর্তৃক রচিত মাকামাতে খায়ের, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫)। উপরের যে সমস্ত বিখ্যাত সাহাবা (রাঃ) ও বুজুর্গানেদ্বীন ১২ রবিউল আউয়ালে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীপালন করেছেন, বর্তমানেও সেভাবে উদযাপন করা উচিত।
ঐতিহাসিক সুত্র মতে মহানবী (দঃ) এর জন্ম দিবস বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে সর্বপ্রথম উদযাপিত হয় আরবেলা-তে ১২০৮ সালে ৬০৪ হিজরীতে সুলতান সালাহউদ্দীন এর শ্যালক আল-মালিক মুজাফফর আল-দিন কোকবুরির দ্বারা। এইসব কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিলো কুচকাওয়াজ, টর্চ-লাইট শোভাযাত্রা এবং পুরাতন রীতি অনুযায়ী মহানবী (দঃ) এর শান ও মর্যাদা সম্পর্কে কবিতা (না’ত) ইত্যাদি গাওয়া। আরও তথ্যসূত্রে পাওয়া যায় ৯৯৬ হিজরী ১৫৮৯ সালে বাদশাহ তৃতীয় মুরাদ ১২ রবিউল আওয়াল নবী করিম (দঃ) এর জন্ম দিনের সম্মানে মৌলুদ শরীফের আয়োজন করতেন। এ উৎসব খুব জাঁকজমকপূর্ণ হতো। এই উৎসব সকাল হতে জোহরের নামাজ পর্যন্ত সুলতান হতে শুরু করে সকল মন্ত্রী ও দরবারের উচ্চপদস্থ সভাসদবৃন্দসহ মুফতি প্রভৃতি সকলে উপস্থিত থাকতেন। উন্নতমানের পোষাক পরিধানসহ অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এই মৌলুদ শরীফ উদযাপিত হতো। তিনজন গায়ক এই না’ত শরীফ পাঠ করতেন। যখন নবী করিম (দঃ) এর জন্ম সম্পর্কে না’ত শরীফ উচ্চারিত হতো তখন পুরা জামাত উঠে দাঁড়াতেন এবং সে মুহূর্তে সুলতানের নিকট মক্কার শেরিফ কর্তৃক প্রেরিত আনুষ্ঠানিক পত্র (অফিসিয়াল লেটার) গ্রহনের জন্য তারা অগ্রসর হতেন। প্রতি বছর হাজীদের নিরাপত্তা ও হজ্জ্ব সম্পর্কে আরবের বাদশাহর নিকট সুলতান কর্তৃক প্রেরিত এটাই ছিলো পত্রের জবাব।এরপর খুব সম্মানের সাথে এই পত্রের জবাবটি রাজকীয় প্রধান বিচারপতির দফতরে রক্ষিত হতো। এই মৌলুদ উৎসব মাসের অনান্য দিনেও বিভিন্ন মসজিদে উৎযাপিত হতো এবং এ জন্য বহু অর্থও ব্যায় করা হতো। প্রজাতন্ত্র তুরস্ক ও আরও বিভিন্ন দেশে মৌলুদ শরীফ মসজিদসমূহে, বাড়িতে, অনান্য ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনে এখনও উৎযাপিত হয়। মজলিসে বিভিন্ন ব্যক্তির আমন্ত্রণ একটি সাধারণ ঘটনা। এ সময়ে গোলাপ পানি ছিটানো হয় এবং মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এই আন্তরিক আয়োজন মহানবী (দঃ) এর প্রতি চরম ভক্তি ও শ্রদ্ধার উৎকৃষ্টতম অভিব্যাক্তি ও নিদর্শন।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১২ রবিউল আউয়াল যথাযথ ভাব গাভীর্য ও আশা উদ্দীপনা সহকারে পালিত হয়। বরাবরই বাংলাদেশ টেলিভিষণও এ দিনের একটি সুন্দর আয়োজন করে থাকে। সুতরাং ঈদ-ই-মিলাদন্নবী যথাযথ মর্যাদার সাথে পালনের মধ্যমে হযরত নবী করিম (দঃ) কে স্মরণ করে তার নৈকট্য ও শাফায়াত লাভের চেষ্টা করতে হবে এবং এর ফলে মহান আল্লাহও খুশী হন।
লেখক: কবি, অনুবাদক, গবেষক ও শিক্ষবিদ
খুলনা গেজেট / এমএম