ইসলামের ইতিহাসে ১২ রবিউল আওয়াল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (দঃ) ধরায় আগমন করেন এবং পৃথিবী হতে বিদায় নেন। পবিত্র আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মহানবী (দঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ যা বলেন সে সব সম্পর্কে লেখক কর্তৃক রচিত নিম্নে কবিতায় তার কিছু উল্লেখ করা হলো এ জন্য যে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (দঃ) উদযাপন বিষয়টি কতো অর্থবহ তা অনুধাবন করার জন্য।
এভাবে পাক কোরানে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরও অনেক আয়াতে নবী করিম (দঃ) সম্পর্কে যথা তার আগমন, তার অতি উত্তম আখলাক, তার মর্যাদা, তার উপরে দরুদ পেশ, তার প্রতি কোরান নাজিল, আল্লাহ এবং রাসুলের ফয়সালাই চুড়ান্ত ফয়সালা, মিরাজে গমন, আল্লাহ ও রাসুলের ডাকে চলে আসা, তার কণ্ঠস্বরের ওপর অন্যের কণ্ঠস্বর উঁচু না করা, তাকে ভালোবাসা, সর্ব্বোপরি উম্মতের তার আনুগত্য করা ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। এ থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় পাক কোরানই রাসুল (দঃ) এর আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত জীবন বৃন্তান্তের জীবন্ত দলিল। তাই মুসলমানদের এই একমাত্র উভয় জগতের মহান মহাপুরুষ নিয়ে মজলিস করা, তার ধরায় আগমন ও কর্ম জীবন নিয়ে আলোচনা করা, মহবতের সাথে তাকে স্মরণ করা, গবেষণা করা ইত্যাদি ঈমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিঃসন্দেহে জরুরী কাজ।
আল-কুরআনে মহানবী (দঃ)
আল্লাহর রাসুল হে প্রিয় নবী ইয়া রাসুলুল্লাহ,
আল্লাহর পথে আহবানকারী ‘দাঈয়ান ইলাল্লাহ’।
চির প্রদীপ্ত প্রদীপ তুমি হে ‘সীরাজাম মুনীরা’,
সারাবিশ্বের সতর্ককারী ‘লিল আলামীনা নাযীরা’।
মহত্তম চরিত্রের খুশবু তুমি ‘খুলুকুন আযীম’,
সম্মানিত রাসুল তুমি হে ‘রাসুলুন করীম’।
আদর্শ চরিত্র তোমার ‘উসওয়াতুন হাসানা’,
মুমিনের প্রতি দয়াবান অতি ‘বিল মুমিনীনা’।
মানবের সুসংবাদদাতা নবী তুমি হে ‘বশীর’,
উম্মতের সতর্ককারী রাসুল তুমি হে ‘নযীর’।
পরিষ্কার ব্যাখ্যাদাতা হে ‘রাসুলুম মুবীন’,
মুমিনের প্রতি কোমল ‘লাইলুন বিল মুমিনীন’।
তুমি অক্ষয় মহান জ্যোতি অনুপম হে নূর,
তোমার রওশনে হৃদয়ের জুলমত হবে দূর।
দোজাহানের করুণা তুমি ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’,
সকল আম্বিয়ার শেষ নবী ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’।
মুমিনের প্রাণাধিক প্রিয় ‘আওলা বিল মুমিনীনা’,
বলেন আল্লাহ আমার বান্দা রাসুল ‘আবদুনা’।
আত্মার পবিত্রতা সাধনকারী হে রাসুল ‘মুযাক্কী’,
ছিলেন মরুর প্রিয় নবী নিরক্ষর ‘নাবীয়ুল উম্মী’।
আল্লাহর স্পষ্ট প্রমাণ ও জ্যোতি নবী চিরদিন,
তিনি ‘বুরহান মির রাব্বিকুম ওয়া নূরুম মুবীন’।
রউফ-প্রেমময়-তুমি, পরম দয়ালু নবী রহীম,
কলবে নবীর জুল-জালালের ‘আলিফ লাম মীম’।
সত্যের সাক্ষ্যদাতা তুমি হায়াতুন্নবী ‘শাহীদ’,
আর্ত-মানবতার সহায় নবী উম্মতের সুহৃদ।
কিতাব ও হিকমতের শিক্ষাদাতা পেলেন নবুয়ত,
ছিলেন রাসুল ‘মুআল্লিমুল কিতাব ওয়াল হিকমত’।
মানবের মাঝে মানব নবী তিনি ‘বাশায়ার রাসুলা’,
পবিত্র কুরআনে বলেন আল্লাহ আমার নবী ‘রাসুলুনা’।
সার্বজনীন নবী আল্লাহর ‘রাসুলুল্লাহি ইলাইকুম জামীয়া’,
দ্বীন-দুনিয়ার দ্যুতি শান্তির দূত দেন খোদা পাঠাইয়া।
বিশ্ববাসীর রাসুল তিনি ‘রাসুলুন ইলা কাফফাতিন নাস’,
শানে যার সুরভী ঝরে আল ফাতিহা হতে আন নাস।
মুমিনের জননী নবীজায়াগণ ‘আযওয়াজুহু উম্মুহাতুম’,
আল্লাহর গোপন রহস্য প্রকাশিল জুড়ে জগত-ভূম।
এখন আমরা সহি হাদিসসমূহ তত্ত্বতালাস করে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী উদযাপনের যথার্থতা খুঁজে দেখবো। সহীহ বোখারী তথা মেশকাত শরীফের এক হাদিসে উল্লেখ আছে ’’আদম যখন রুহ এবং খামিরের মধ্যে তখনও আমি নবী।’’ এখন প্রশ্ন হলো প্রথম মানব সৃষ্টির পূর্বে নবী করিম (দঃ) কোন অবস্থায় নবী ছিলেন? তখন শুধুমাত্র ফেরেশতা, জ্বিন, পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি ছিলো বলে জানা যায়। পরবর্ত্তিতে মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ’’বশর’’ হিসেবে আগমন করেন যা পাক কোরানে উল্লেখ আছে। ’’বলো, আমি তোমাদের মতো একজন মানুষ’’–এখানে উল্লেখ করা হয়নি যে মাটির মানুষ অথবা নূরের মানুষ। সুরা ‘মায়িদাহ’ এর ১৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন “ হে আহলে কিতাব! আমার রাসুল তোমাদের নিকট এসেছেন,…। তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আলো এবং সুস্পষ্ট কিতাব এসে গেছে। এখানে ‘আলো’ বলতে নবী করিম (দঃ) এবং ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলতে আল কুরআন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে হযরত শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রঃ) লিখেছেন: ’প্রিয় নবী হযরত রাসুলুল্লাহ সালালাহু আলাইহে ওয়াসালামের সম্মান মর্যাদা তেমনিভাবে করতে হবে, যেভাবে করা হতো তাঁর জীবদ্দশায়, তাঁর রেসালত সর্বকালের জন্যে, তিনি পৃথিবীতে অবস্থানকালে যেমন রাসুল ছিলেন, আজও তেমনি রাসুল রয়েছেন এবং থাকবেন। মসজিদে নববীতে এ জন্যে উচ্চস্বরে কথা বলা আদবের খেলাফ।’
উম্মত জননী হযরত আয়শা (রাঃ) বলেন, ‘আমি শুনেছি যে, হযরত হাসসানকে রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, তুমি যতক্ষণ আল্লাহ এবং তার রাসুলের পক্ষ থেকে কবিতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে থাকবে ততক্ষণ রুহুল কুদস জিবারাঈল (আঃ) তোমাকে সাহায্য করতে থাকবেন।।’ (বুখারী শরীফ হাদিস নং ৪৭১১, ২৭৭৩ আবু দাউদ) হযরত হাসসান বিন সাবিত (রাঃ) এর না’ত:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর,
আমার হৃদয়কে তিনি ইসলামের দিকে,
ধাবিত করলেন-একনিষ্ঠ করলেন দীনের পথে।
তোমার প্রশংসা করি আমার তেমন ভাষা নেই,
আমিতো নগণ্য কবি অন্ততঃ ভাষার দিক থেকে,
প্রশংসা পায় না নবী নিছক আমার এ ভাষায়,
নবীর ছোঁয়াচ পেয়ে এ কবিতা অমরত্ম পাবে।(অনুবাদঃ আবদুস সাত্তার)
উপরের হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় হুজুরপাক (দঃ) এর তার খোদ উপস্থিতে মসজিদের ভিতর সাহাবা (আঃ) না’ত শরীফ পাঠ করতেন এবং সকলে তা শ্রবণ করতেন।
ইমাম জালালউদ্দীন সূয়ুতী (রঃ) বলেন, ’হুজুর পাক (দঃ) জন্ম উপলক্ষ্যে মাহফিল করা, খাওয়া দাওয়া ও আপ্যায়ন করা এবং সমস্ত ভাল কাজের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ এবং আনন্দ প্রকাশ করা ইত্যদি আমাদের জন্য মুস্তাহাব।’ (আল-হাওয়ীলিল খাতাওয়া, প্রথম খন্ড)। দেওবন্দের বুজুর্গ ওস্তাদ হাজি এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কি (রহঃ) বলেন, ’প্রতি বছর আমি বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করে থাকি এবং কিয়ামে আরাম অনুভব করি’। অতএব নবী করিম (দঃ) এর আমল হতে আলোচনাসহ ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর মজলিস করা একটি উত্তম ব্যবস্থা, এতে যেমন সওয়াব পাওয়া যায় তেমনি দেলে শান্তি লাভ হয়। এই মজলিসে যা আলোচনা করা হয় তা পূর্ণ শরীয়তসম্মত, সুতরা এখানে বিদআত বলে কিছু নেই। আর যারা বিদআত ভাবেন, তাদেরকে কোনো অলি-বুজুর্গের উপস্থিতিতে মিলাদ-কিয়ামে যোগদান করে সব কিছু অন্তরের চোখ দিয়ে অনুধাবনের চেষ্টা করার জন্য সবিনয়ে অনুরোধ জানাই। শুধু কাগজ-কলমে ও বক্তব্যে তত্ত্বজ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় না।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ১২ রবিউল আউয়াল যথাযথ ভাব গাভীর্য ও আশা উদ্দীপনা সহকারে পালিত হয়। বরাবরই বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ দিনের একটি সুন্দর আয়োজন করে থাকে। সুতরাং ঈদ-ই-মিলাদন্নবী যথাযথ মর্যাদার সাথে পালনের মধ্যমে হযরত নবী করিম (দঃ) কে স্মরণ করে তার নৈকট্য ও শাফায়াত লাভের চেষ্টা করতে হবে এবং এর ফলে মহান আল্লাহও খুশী হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ০৩ অক্টোবর ২০২২ তারিখে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকীর ‘খুলনা গেজেট’-এ “কোরআন ও হাদিসের আলোকে পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সাঃ)” শিরোনামে একটি চমৎকার গবেষণাপ্রসূত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝবার শক্তি দিন! আমিন।
লেখক: কবি, অনুবাদক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক