বাংলাদেশে এখন সাজ সাজ রব। দেশ জুড়ে উৎসবের আমেজ। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে ভাসছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলদেশে এত বড় কর্মযজ্ঞ আর দ্বিতীয়টি হয়নি। কোনো স্থাপনার উদ্বোধন নিয়ে এত বড় উৎসবও হয়নি। এ-সেতুকে ঘিরে আমাদের আবেগ সীমাহীন। কারণ, এ-সেতু বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়। হাজারো বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে স্বপ্নের পদ্ম সেতু বাস্তবে ধরা দিয়েছে। এ-সেতুর মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ আবারও প্রমাণ করেছে বাঙালি বীরের জাতি। বাংলাদেশেকে চোখ রাঙিয়ে, ষড়যন্ত্র করে ‘দাবায়ে’ রাখা যায় না। বাংলাদেশ অতীতেও কারো কাছে মাথা নত করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। বাংলদেশের আছে অদম্য সাহস, আটুট মনোবল আর সীমাহীন ধৈর্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে-আদর্শ আমাদের মাঝে রেখে গিয়েছেন, সেই আদর্শ অনুসরণ করে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাঙালি জাতির গর্ব, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্ব, অদম্য সাহস আর মেধা বাঙালি জাতিকে মর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। কবি নজরুলের বাণী যেন পিতার মতো শেখ হাসিনাও অন্তরে লালন করেন- ‘বল বীর, উন্নত মম শির’।
২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই সেতুর উদ্বেধানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সর্বস্তরের মানুষ রওনা হচ্ছে উদ্বোধন স্থলে। কেউ বাসে করে, কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ বা অন্যান্য যান বাহনে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হয়ে থাকতে চান সবাই। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের ক্ষণ ঠাঁই পাবে ইতিহাসে। এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান না কেউ। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশে^র বিভিন্ন সুবিধাভোগী দেশও এ-সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভাসছে।
পদ্মা সেতু এখন কেবল একটি সেতু নয়, এটি সারা বিশ্বে বাঙালির অহংবোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ-সেতুটি বিস্ময়ের উদ্রেক করছে বিশ্ববাসীর। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে নিজস্ব অর্থায়নে বিশে^র অন্যতম বৃহৎ সেতুটি নির্মাণ করে ফেললো, ভাবা যায়! কী করে সম্ভব হলো এটি! শেখ হাসিনা কি ম্যাজিক জানেন? তিনি কি একজন ম্যাজিসিয়ান?
পদ্মা সেতু যাতে নির্মিত না হতে পারে, বাংলাদেশ যেন উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়ে- দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সে-ব্যাপারে কম হয়নি। একটি খোড়া অজুহাত তুলে, দুর্নীতির কল্পিত কাহিনি বলে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বিশ্বব্যাংক। সাফ জানিয়ে দেয়, পদ্মা সেতুতে তারা কোনো ঋণ সহায়তা দেবে না। সারা বিশ্ব সে-দিন মনে করে ছিলো, মনে করেছিলো এ দেশের সাধারণ মানুষও, পদ্মা সেতু বোধ হয় আর আলোর মুখ দেখবে না। কিন্তু একজন মানুষের দৃঢ়তা, সাহস, মেধা আর বুদ্ধিমত্তার কারণে, উল্টে যায় পাশার চাল, ব্যর্থ হয় দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। আর তিনি হলেন আয়রন লেডি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা। বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ সহায়তা ফিরিয়ে নিলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন- দেশীয় অর্থায়নেই নির্মিত হবে পদ্মা সেতু। সে-দিন বিশ^বাসি মনে করেছিল, শেখ হাসিনা শুধু কথার কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু তারা জানে না, বঙ্গবন্ধু যেমন শুধু কথার কথা বলেতেন না, তেমনি তার সুযোগ্য কন্যাও। প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্র আর মিথ্যা প্রচারণা ভন্ডুল করে, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নেই নির্মাণ করলেন পদ্মা সেতু। আর এ-কারণে পদ্মা সেতু এখন আর একটি সেতু নয়, সারা বিশে^র কাছে উন্নয়নের একটি মাইল ফলক।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থের চেয়ে বড় বিষয় ছিলো মনোবল। দেশি-বিদেশি কুচক্রি মহল তাই প্রথমেই চেয়েছিলো বঙ্গবন্ধু কন্যার মনোবল ভেঙে দিতে। আনলো দুর্নীতির অভিযোগ। কিন্তু তারা জানে না, শেখ হাসিনার মনোবল ভেঙ্গে দেয়া অত সহজ নয়। কারণ তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালন করেন না, জননীর মতোও আগলে রাখেন তাঁর পিতার নেতৃত্বে অর্জিত বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের প্রতি রয়েছে তার গভীর ভালোবাসা। তাঁর দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। এ-কারণেই তিনি দেশের জন্য যা করেন, তা ভালোবেসেই করেন, মন থেকেই করেন। আর এ ভালোবাসাই তাঁর শক্তির উৎস।
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে দাবি করে আসছিল পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের। পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু না থাকায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ মূলত ছিলো ‘নিজভুমে পরবাসি’। রাজধানীর ঢাকার সাথে এ-সব জেলার এক প্রকার যোগযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। নৌপথ ছিলো যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। কিন্তু নৌ-পথে যাতায়াত মন্থর আর ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এ-পথ দ্বারা উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব হয়নি। দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য উৎপাদেনের পর দ্রুত বিপননের সৃুযোগ না থাকায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ফলে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার দ্বারা অধিক ফসল ফলানোর চিন্তাও তরা করেনি। রাজধানীসহ অন্যান্য জেলার সাথে সড়ক যোগযোগ না থাকায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় আশারূপভাবে গড়ে ওঠেনি ভারি ও মাঝারি শিল্প-কলকারখানা। ফলে প্রবল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কৃষি এবং শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে এক ধরণের বন্ধাত্ব দেখা দেয়। পরিবেশ উন্নয়নও থমকে যায়। নতুন কর্মসংস্থান না থাকায় বেড়ে যায় বেকারত্ব।
বৃহত্তর বরিশাল ও রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছন্ন থাকে। এ-কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চাকা আশারূপভাবে ঘোরোনি। ২০৪১ সালের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে যে উন্নত দেশের কাতারে দাঁড় করানোর স্বপ্ন দেখছেন সেই স্বপ্নের রিলে রেসকে অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে পদ্ম সেতু। এ-কথা আর কেউ না জানলেও প্রধানমন্ত্রী জানতেন। আর এ-কারণেই তিনি পদ্মা সেতু নির্মানের অর্থিক ঝুঁকি নিয়েছেন। দেশ বিদেশের প্রকৌশলী ও হাজার হাজার শ্রমিক তাদের শ্রম ও মেধার সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে নির্মাণ করেছেন পদ্ম সেতু।
একটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাড়তি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। পদ্মা সেতুর নামের ক্ষেত্রে তিনি নদীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অনেকেই প্রস্তাব করেছিলেন পদ্মাসেতুর নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ রাখা হোকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাব নাকচ করে যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য তিনি চিরদিন এদেশের মানুষের কাছেই নয়, বিশ^বাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর এ-সিদ্ধান্ত নি:সন্দেহে তাঁর মর্যাদা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। পদ্ম সেতুর সাথে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য নয়, জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মাসেতুর মতো এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ সেতু নির্মাণ করার জন্য আমরা শুধু ধন্যবাদই নয়, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করছি। পদ্মাসেতুর এই শুভ যাত্রাকালে আমাদের এ-বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে, শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ যে-ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশের শামিল হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
(লেখক : উপাধ্যক্ষ, আলহাজ্ব সারোয়ার খান ডিগ্রি কলেজ, খুলনা)