খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  অ্যান্টিগা টেস্ট: শেষ দিনে বাংলাদেশের দরকার ২২৫ রান, হাতে ৩ উইকেট

পদ্মা সেতুর বদৌলতে মৎস্য চাষে ঘটবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন

রুহুল কুদ্দুস, সাতক্ষীরা

আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো বহুকাঙ্খিত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। অন্যান্য সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি  সাতক্ষীরায় মৎস্য চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেবে এই পদ্মা সেতু। কক্সবাজার হতে চিংড়ি পোনা সরবরাহ থেকে শুরু করে সাতক্ষীরার উৎপাদিত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানিতে নতুন করে গতি ফিরে আসবে। উপকৃত হবে দেশের সাদাসোনা খ্যাত  চিংড়ির শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।

উপকূলীয় জেলা হিসেবে সাতক্ষীরা চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ চাষে সমৃদ্ধ হলেও চিংড়ির পোনা আসে কক্সবাজার থেকে। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দেওয়ার কারনে ফেরি ঘাটে দীর্ঘসূত্রতা ও যানজটের কারণে বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পোনা ব্যবসায়ী ও ঘের মালিকরা। অক্সিজেন ফেল করে মারা গেছে কোটি কোটি চিংড়ি পোনা। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এক সময় কক্সবাজার থেকে বিমানে চিংড়ি পোনা পরিবহন শুরু হয়। এমনকি বেশ কয়েক বছর হেলিকপ্টারও চড়েছে চিংড়ি পোনা। কিন্তু পোনার দাম কমে যাওয়ায় সেটাও ধরে রাখা যায়নি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবার পাল্টাবে সেই পরিস্থিতি। ফেরি ঘাটের বিড়ম্বনার অবসানের মধ্যদিয়ে কম সময়ে পোনা এসে পৌছানোর কারনে চিংড়ি চাষে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা জেলায় বাগদা ও গলদা পোনার চাহিদা প্রায় ৩৫০ কোটি। এর মধ্যে বাগদা পোনার চাহিদা ৩৪০ কোটি এবং গলদা পোনার চাহিদা ১০ কোটি ৫৫ লক্ষ। সাতক্ষীরার প্রয়োজনীয় বাগদা পোনার প্রায় সবটাই আসে কক্সবাজার থেকে।

সূত্র আরো জানায়, সাতক্ষীরা জেলায় বর্তমানে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। যেখানে জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিক টনের মধ্যে একাংশ বিদেশে রপ্তানি এবং অবশিষ্ট মাছ দেশের অন্যান্য এলাকায় সরবরাহ করা হয়। বর্তমানে জেলাতে ৫০ হাজার ১৮টি পুকুরে কার্পজাতীয় মাছের চাষ হচ্ছে। এছাড়া জেলায় ১ লক্ষ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর লবনাক্ত জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। জেলায় মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে ২৫টি, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে ৪টি, মৎস্য আড়ৎ রয়েছে ৩২টি। এছাড়া ২৮৫টি মৎস্য ডিপো, ৪৪টি বরফকল, ১৫টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র এবং ৫৮টি পাইকারী মৎস্য বিপণন কেন্দ্রের মাধ্যমে সারা বছর মাছ বাজারজাত করা হয়।

স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সাতক্ষীরায় উৎপাদিত প্রায় এক লাখ টন চিংড়ি ও সাদা মাছ এখন দেশ বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌছাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে। রাজধানী ঢাকার মানুষ বরফ ছাড়াই সাতক্ষীরার জীবিত টাটকা মাছ কিনতে পারবে। ঘেরগুলো হতে রাতে ধরা মাছ ঢাকার বাজারে সকালে খুচরা ক্রেতারা এসে পৌছানোর পূর্বেই পৌছে যাবে। এমন প্রত্যাশা এখন সাতক্ষীরার মাছ ব্যবসায়ীদের।

সাতক্ষীরার সুলতানপুর বড়বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মৎস্য উৎপাদনে সাতক্ষীরায় নীরব বিপ্লব হবে। জেলার জনগোষ্ঠীর চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে অতিরিক্ত প্রায় এক লক্ষ মেট্রিক টন মাছ দেশের অন্যান্য জেলাসহ বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। মৎস্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ফলে জেলাতে একদিকে যেমন নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সমৃদ্ধি হয়েছে জেলার অর্থনীতি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সাতক্ষীরার মৎস্য সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি ভূমিকা রাখবে।

সাতক্ষীরা জেলা চিংড়িপোনা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডাক্তার আবুল কালাম বাবলা জানান, সাতক্ষীরার ঘেরের জন্য প্রয়োজনীয় বাগদা চিংড়ির রেণু’ র প্রায় ৮০ শতাংশ কক্সবাজারের উৎপাদিত হ্যাচারি থেকে আনা হয়। দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে সাতক্ষীরায় আনার কারণে অনেক সময় বাগদা রেণুর মান সঠিক থাকে না। ফলে এই রেণু ঘেরে ছাড়ার পর অনেক সময় চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। পদ্মা সেতু চালু হয় এখন অল্প সময়ের ব্যবধানে কক্সবাজার থেকে রেনু পোনা সাতক্ষীরা এসে পৌঁছাবে। এতে করে চিংড়ি চাষীরা উপকৃত হবেন। সাথে সাথে বাড়বে মাছের উৎপাদন।

সাতক্ষীরা বিনেরপোতাস্থ চিংড়ি  প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান দীপা সি ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীনবন্ধু মিত্র জানান, শুধুমাত্র পরিবহন সমস্যার কারণে আমাদের ফ্যাক্টরিতে প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানিতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। পদ্মা সেতু চালু হয় এখন আমাদের সেই সমস্যা আর থাকবে না। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি বিদেশে রপ্তানির জন্য চিটাগাং বন্দরে পৌঁছাতে পারবো। এতে করে ব্যবসায়ীদের সময় ও বাচবে খরচ ও কমবে।  পদ্মা সেতু চালু হয় দেশের চিংড়ি শিল্প আরো সমৃদ্ধ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

কেন্দ্রীয় মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সাবেক মৎস্য প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার আতাবুজ্জমান জানান, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় আদি কাল থেকেই সাতক্ষীরার মৎস্য সম্পদ বিদেশে রপ্তানি হয়। ৪৭ সালের আগে সাতক্ষীরার মাছ উঠতো কোলকাতার বাজারে। আশির দশকে বানিজ্যিক মৎস্য উৎপাদন শুরু হওয়ায় প্রতিবছরই জেলায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার প্রধান পেশা কৃষির পরই মাছের অবস্থান। জেলার প্রায় ১০ লক্ষ নারী ও পুরুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মাছ চাষের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দেশের প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ জড়িত থাকলেও সাতক্ষীরা জেলায় মৎস্য খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ জড়িত।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা যায়, সাতক্ষীরার চিংড়ি বিদেশে রপ্তানির বাজার দখল করেছে। এখানে উৎপাদিত হচ্ছে সব ধরনের সুস্বাদু সাদা মাছ। চিংড়ির পাশাপাশি কৈ, মাগুর, শিং, শোল, পাঙ্গাস, মনোসেক্স তেলাপিয়া, কার্প জাতীয় মাছ ছাড়াও জেলাব্যাপী কাঁকড়া ও কুচিয়ার চাষ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার ৫৫ হাজার ১২২টি বাগদা চিংড়ি ঘের ও ১১ হাজার ৬৩৮টি গলদা চিংড়ি ঘেরের এক চতুর্থাংশে আধা নিবিড় ও নিবিড় চিংড়ি চাষ করা গেলে জেলার চিংড়ি উৎপাদন ৮ থেকে ১০ গুণ বেড়ে যাবে বলে জানানো হয়। বেসরকারি হিসাবে বাগদা ও গলদা চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা আরো বেশি।

 

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!