পর্যটন পৃথিবীর সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। পর্যটন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মায়ানমার ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। দেশটি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। এদেশে রয়েছে সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, প্রতœতাত্ত্বিক স্থান, ধর্মীয় তীর্থস্থান, পাহাড়, চা বাগান, সাফারি পার্ক, ইকো পার্ক ইত্যাদি। এসবের সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। এই সেতুকে ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পাশাপাশি পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থানগুলোও জেগে উঠেছে নতুন সম্ভাবনা।
জাতীয় অথনৈতিক উন্নয়নের প্রভাবক পদ্মা সেতু যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতিকল্পেই নির্মিত হয়েছে। সঙ্গত কারণে পদ্মা সেতু জাতীয় উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। পদ্মা সেতু চালুর আগেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন সেতু দেখতে আসছে অসংখ্য মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছুটির দিনগুলোতে বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ভ্রমণপিপাসু এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষের যেন আন্তরিকতার কমতি নেই। আদি পেশা বদল করে মাওয়া-জাজিরার অনেকেই এখন পর্যটনকেন্দ্রিক নতুন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করছেন। এ দিকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের পর্যটনের উদ্যোক্তারাও নতুন সেবা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আশা করা হচ্ছে সেতুটি চালু হলে শুধু যোগাযোগই নয়, পর্যটনের পাশাপাশি শিল্প-বাণিজ্যেও এগিয়ে যাবে এই এলাকার আপামর জনগণ।
পদ্মা পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য আকৃষ্ট করছে সব বয়সী মানুষকেই। মাওয়া-জাজিরায় সেতুর পুরো কাঠামো দাঁড়ানোর পর পর্যটকদের কাছে এসব এলাকার আকর্ষণ বেড়েছে কয়েকগুণ। এই সেতু দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন স্থানীয় পর্যটকরা। পদ্মার পাড় ও সেতুর আশপাশে নৌকায় চড়ে মন ভরে দেখছেন এ সেতু। শুধু সেতু ঘুরে দেখা ও ইলিশ খাওয়াসহ একদিনের ট্যুর প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু যাওয়া-আসা, খাওয়া, ঘোরাসহ জনপ্রতি ৮০০ বা ১০০০ টাকা ধার্য করেছে এসব প্রতিষ্ঠান।
পদ্মার পূর্ব পাড়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার অনেক স্থানেই গড়ে উঠেছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় অনেক মানুষই এখন নতুন নতুন পেশার সাথে জড়িত হচ্ছেন। যেমন- নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট ভাড়া দেয়ার ব্যবসা এখানে বেশ জমজমাট। অনেকে গড়েছেন হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট। ইতোমধ্যে শিমুলিয়া ঘাটের গোল চত্বরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক খাবার হোটেল ও কার পার্কিং ব্যবস্থা। পাশাপাশি অনেক বিলাস বহুল রিসোর্টও গড়ে উঠেছে।
আবার পদ্মা সেতুর পশ্চিম পাড়ে ভাঙ্গা ও ভাটিয়াপাড়ায় মহাসড়কের পাশে অনেক খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর কয়েক মাস পর থেকেই এই হোটেল ব্যবসা বেশ জমে উঠেছে। অনেকেই বাপ-দাদার পুরনো পেশা বাদ দিয়ে দর্শনার্থীদের সেবামূলক ব্যবসা গড়েছেন এখানে। আশা করা হচ্ছে আগামীতে পদ্মা সেতু দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থানে পরিণত হবে।
এছাড়া শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা থেকে শিবচরের মাদবর চর পর্যন্ত পদ্মা সেতুর ১০.৫ কিলোমিটার নদী শাসন এলাকাও এখন পর্যটকদের জন্য দৃষ্টিনন্দন বিনোদন কেন্দ্র। প্রতিদিন সেতুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে বহু মানুষ ওই এলাকা ঘুরতে আসেন। সেতু বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটনের ভাবনা তাদেরও আছে। সেতু নির্মাণের সাথে সাথেই পদ্মার দুই পাড়ের ৩টি সার্ভিস এরিয়ায় আবাসন ও সাইট অফিস স্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তীতে পর্যটনের কাজে এগুলো ব্যবহার করার পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের রয়েছে।
পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্য যে ঐতিহাসিক ও পর্যটন স্থানগুলো রয়েছে সেগুলোর জন্যও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। কেননা যোগাযোগের কারণে সুন্দরবন, বাগেরহাট ও কুয়াকাটায় যে হারে পর্যটকদের আগমন হতো এখন আরো সহজে কম খরচ ও সময়ে ওই সব স্থানে পর্যটকরা আসতে পারবে। পাশাপাশি পদ্মার দুই পাড়ে আরো নতুন নতুন পর্যটন এলাকা তৈরি হচ্ছে।
পদ্মা সেতু চালুর আগেই দুই পাড়ের সংযোগ সড়কের উভয় পাশেই গড়ে উঠেছে পর্যটকদের জন্য নানা বিনোদনের আয়োজন। স্থানে স্থানে কার পার্কিং, চা-কফির দোকান, খাবার হোটেল, বিশ্রামাগার, যাত্রী ছাউনি নির্মাণও করা হচ্ছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার চাররাস্তা মোড়ে গোল চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় কয়েকটি স্থান। একই সাথে ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দুই পাশে এখন শুধু দেখা যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ। বিশেষ করে দপদপিয়া, বিমানবন্দর, গড়িয়ার পাড়, শিকারপুর এলাকায় মহাসড়কের দু’পাশে বেসরকারি খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন চলছে। এসবই হচ্ছে পদ্মা সেতুকে টার্গেট করে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড-এর মতে, ২০১৯ সালে দেশের মোট জিডিপির ২.৭ শতাংশ পর্যটন খাত থেকে এসেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মযাজক, ব্যবসায়ী, পর্রিরাজকগণ নিয়মিত ভাবে আসে এদেশে। এক হিসেব মতে, প্রতিবছর গড়ে ৯ থেকে ৯.৫ মিলিয়ন পর্যটক দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্থানে ঘুরতে আসে। তাঁদের বেশির ভাগ (৭০%) কক্সবাজার এবং বাকীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও উত্তরবঙ্গে যায়। ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে ১.৮ মিলিয়ন আয় করে। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ আরও উন্নত হবে। ফলে এই খাত থেকে আয় আরো বাড়বে। কারণ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে ১০-১২ ঘণ্টা যেখানে সময় লাগে সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ৬ ঘণ্টায়। ফলে নিঃসন্দেহে সেখানে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। এছাড়া পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশকিছু দ্বীপের সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হলে পর্যটকরা এ অঞ্চলের প্রতি আরো আকৃষ্ট হবে।
ইতোমধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। অর্থাৎ উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার ফলে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর আরো সচল হবে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ বৈদেশিক বাণিজ্য চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সেতুটি চালু হলে স্বল্প সময়ে মোংলা ও পায়রা বন্দর থেকে মালামাল খালাস হয়ে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরে পৌছাবে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ অনেকখানি কমে আসবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাছাড়া সাগরকন্যা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন, ভরতভায়না, মধুপল্লী, দক্ষিণডিহি, ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর মাজার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরা পাড়ের আধুনিক হোটেল-মোটেল-রিসোর্টসহ নতুন পুরানো পর্যটনকেন্দ্রগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে।
এক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপগুলো মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার মতো পর্যটন-উপযোগী হয়ে গড়ে উঠতে পারে। এছাড়া পৃথিবীর চারটি উত্তর-দক্ষিণ রেখা এবং তিনটি পূর্ব-পশ্চিম রেখা ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ১২টি জায়গায় ছেদ করেছে তার একটি পড়েছে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায়। সহজ কথায় কর্কট ক্রান্তি এবং ৯০ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার ছেদবিন্দুটি পড়েছে এখানে, যা সম্প্রতি আবিস্কৃত হয়েছে। ঠিক সেখানেই বঙ্গবন্ধুর নামে মানমন্দির নির্মাণের প্রস্তাব উঠেছে। মানমন্দিরটি নির্মিত হলে এটি হয়ে উঠবে এ অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। ফলে অভ্যন্তরীণ পর্যটকসহ সারাবিশ্ব থেকে মানুষ ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানটি দর্শন করতে আসবে। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে।
সেতুটি মাথা তুলে দাঁড়ানোর পর থেকেই প্রতিদিনই তা দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। সবার মধ্যেই একটি ইতিবাচক মনোভাবও তৈরি হয়েছে। তবে সেতুটির পর্যটনের দিকটি কাজে লাগাতে পরিকল্পিত উদ্যোগের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তার প্রেক্ষিতে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনাও নিয়েছে সেতু বিভাগ। এই সেতু ঘিরে পর্যটনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক উদ্যোক্তাই হয়তো এগিয়ে আসবেন। আর এসব পর্যটক ও উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তায় সহযোগিতা সরকারকে দিতে হবে। সেতুটির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর উভয় পাড়ে দুটি থানার উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে করে দেশে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভ্রমনের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠবে, ফলে দেশ অর্ধনেতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করবে।
(লেখক : সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর)
খুলনা গেজেট/ আ হ আ