মহাকালের বিচ্ছিন্নতা ঘুৃচিয়ে প্রমত্ত পদ্মার ওপর দিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে চলা মহাসেতু নির্মাণ কাজ শেষে এখন পাড়ি দেবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তত। বাঙালি জাতির পদ্মা পাড়ি দেবার দিবাস্বপ্ন এখন দিনে আলোর মতো পরিস্কার। সেতু বললে যে ছবিটি আমাদের সাদা কালো চোখের সামনে ভেসে আসে সেই ছবি দিয়ে কোনোভাবেই মেলানো সম্ভব নয় ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অবকাঠামোকে। প্রমত্তা এই পদ্মায় দ্বিতল সেতুর ওপর দিয়ে চার লেনে চলবে গাড়ি, নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদিত যেকোনো ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারবে অনায়াসে। সেতুর নিচতলা দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন যে লাইন দিয়ে গ্যাস পৌঁছাবে আশেপাশের জনপদসমূহে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের ফলে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট দিয়ে পদ্মা নদীর দুই প্রান্তকে যুক্ত করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যুক্ত করা একেবারেই সহজ ছিল না। নির্মাণ কাজের কোনো না কোনো পর্বে চ্যালেঞ্জ এসেছে অবধারিতভাবে। এখানে নদীশাসনটা যেমন চ্যালেঞ্জ ছিল তেমনি নদীর তলদেশে পাথর না থাকায় পাইলিং করাটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেতুর নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে বারবার। ভরা বর্ষায় পদ্মানদীর পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে চার থেকে সাড়ে চারমিটার। সাধারণত পাহাড়ি নদীতে স্রোত বেশি থাকে। কিন্ত সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগে এত স্রোত পদ্মার মতো তেমন কোথাও দেখা যায় না। এমন অবস্থা একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার নদী আমাজনেই দেখা দেয়। তাই সেতু বিশেষজ্ঞের মতে, পদ্মাকেই একমাত্র গভীরতম ও স্রোতস্বিনী ভিত্তির সেতু বলা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পদ্মাসেতু অমূল্য সম্পদ। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির হার ১.২৬% পর্যন্ত সামগ্রিক অর্থনীতিতে সংযুক্তি হবে। কিন্তু রেল সংযুক্তির ফলে এটি বেড়ে ২.০৩% হবে। দেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের একুশটি জেলার সঙ্গে রাজধানীর সংযোগই কেবল বাড়বে না বরং দেশ-বিদেশে ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মোংলা ও পায়রা বন্দরকে আন্তর্জাতিকমানের করা গেলে দেশের ব্যবসা-বানিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে। ইতোমধ্যে শিল্পপতি, উদ্যেক্তারা শিল্প অঞ্চল গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যেগ হাতে নিয়েছেন। যার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কর্মপ্রত্যাশী মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং বেকার সমস্যা সমাধানে কিছুটা ভূমিকা রাখবে। বেকাররা কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী না হয়ে বরং অকৃষিজখাতের কাজে সংযুক্ত হবে। রাজধানীর উপর চাপ কমবে আঞ্চলিক বিকেন্দ্রীকরণের কিছুটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। যে সমস্ত পচনশীল দ্রব্য তরমুজ, ফুলসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি সময়াভাবে বা দীর্ঘসূত্রীতার জন্য এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরে সমস্যা ছিল সেটি এখন দূর হবে এবং ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য ও পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। এছাড়াও এ সেতুটি ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হতে যাচ্ছে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেনের চেয়ে মালবাহী ট্রেন বেশি চলবে। ডাবল কনটেইনার নিয়ে ছুটে চলবে ট্রেন। ঢাকা ও চট্রগ্রামের সাথে যুক্ত হবে মোংলা ও পায়রা বন্দর। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে নতুন সোনালী স্বপ্ন এবং দেশের প্রবৃদ্ধিতে এ সেতু ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। একই সাথে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্যসামগ্রী সহজে ও স্বল্পব্যয়ে স্থানান্তর করা সহজ হবে। এই দ্রুততম যোগাযোগ দেশের পর্যটন শিল্পে অভূতপূর্ব অবদান রাখবে। সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দিয়েছে বিশাল সম্ভাবনা। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি করা সম্ভব। পদ্মাসেতু চালু হলেই সেই সম্ভাবনা হাতের নাগালেই এসে যাবে। পদ্মাসেতুর মাধ্যমে কক্সবাজার থেকে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটা পৌঁছানো সম্ভব। কক্সবাজার যেতে যেখানে ১০-১২ ঘন্টা সময় লাগে সেখানে কুয়াকাটা পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৬ ঘন্টা। ফলে পর্যটকের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে বেড়ে যাবে। পায়রা বন্দরের সাথে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় বলা আছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশেপাশে দ্বীপের সাথে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। তাহলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন সহজেই। এরই মধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এবং আশেপাশের এলাকায় বিনিয়োগ শুরু করেছে। যা দেশের ০.৮৪ শতাংশ দারিদ্র নিরসন করতে সক্ষম।
খুলনা ও বরিশাল অঞ্চল এ দারিদ্র্যর হার জাতীয় গড়ের তুলনায় অন্তত ১০ শতাংশ বেশি। পদ্মা সেতুর কারণে আঞ্চলিক পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ১.০১ শতাংশ এবং জাতীয় পর্যায়ে ০.৮৪ শতাংশ কমবে। জিডিপি বাড়বে ১.২ শতাংশ। ২০২২ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতুর কারণে এটা বাড়বে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতুর সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে জিডিপিতে আরো বেশি অবদান জোগানা সম্ভব হবে, এমনই অভিমত উদ্যোক্তা ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্টদের।
পদ্মাসেতু জাতীয় উন্নয়নের ধারক ও বাহক। প্রজন্মের গৌরব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখন নতুৃন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। আঞ্চলিক বিকেন্দ্রীকরণের হাতছানি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য খুলনা, বরিশাল অঞ্চল এখন কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-সংস্কৃতিতে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন দৃঢ়চেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের উপহার, বাঙালির উপহার ‘প্রমত্ত পদ্মাসেতু’ এক হয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। আমরা আনন্দে গেয়ে উঠি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। জয়তুঃ পদ্মাসেতু।
(লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)